সানাউল হক সানি : পায়ে জোড়াতালি দেয়া স্যান্ডেল। জায়গায় জায়গায় রং ওঠা। কোচকানো শার্ট-প্যান্ট।
ষাটোর্ধ্ব একজন মানুষ। হাতে দুইটি সেন্টার ফ্রুট চকলেট। ফুটপাতে বসে মাথা নুইয়ে হাতে লেখা নোট পড়ছেন এক তরুণী। হঠাৎ মাথা উঁচিয়ে বললেন, বাবা একটু চা খেতে পারলে ভালো হতো। হন্তদন্ত হয়ে বাবা ছুটলেন চা আনতে। কিছুক্ষণ পর একগ্লাস রং চা নিয়ে হাজির।
কন্যা ফুটপাতে বসে একনিষ্ঠ মনে পড়ছে। একটু পর পর চায়ে চুমুক দিয়ে চায়ের গ্লাসটা তুলে দিচ্ছে বাবার হাতে। মন্ত্রমুগ্ধের মত কন্যার দিকে তাকিয়ে আছেন বাবা। সে এক স্বর্গীয় দৃশ্য।
পল্লবী মাজেদুল ইসলাম মডেল হাইস্কুল। বিসিএস প্রিলিমিনারি পরীক্ষার কেন্দ্র। সরকারি নির্দেশনা থাকায় পরীক্ষার্থীরা সাড়ে আটটার মধ্যেই হাজির। সেখানেই দেখলাম বাবা-মেয়ের এমন রসায়ন।
৯ টা ২৫ মিনিটে মেয়েটি কেন্দ্রে প্রবেশ করল। বাবা নানারকম দোয়া পড়ে ফুঁ দিলেন মেয়েটিকে। কপালে চুমো খেলেন। আশেপাশে মানুষ, কিছুটা লজ্জা মুখে মেয়েটি বলল, বাবা দোয়া করো।
অনেকটা ফাঁকা মাজেদুল ইসলাম মডেল হাইস্কুলের ফটক। ফুটপাতে বসে নিবিষ্ট মনে দোয়া পড়ে যাচ্ছেন এক্তেদার সরদার। আমি দোয়ায় ব্যাঘাত ঘটিয়ে গল্প জুড়ে দিলাম।
একসময় কাজ করতেন খুলনার একটি জুটমিলে। দুই মেয়েকে ছোট রেখেই স্ত্রী রোমেলা খাতুন মারা যান। চাকরি ছেড়ে এক্তেদার সরদার ফিরে এলেন টাঙ্গাইলের নিজ বাড়িতে। দুই মেয়েকে মানুষ করার ব্রত নিয়ে নানা টুকটাক কাজ করেই পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি করান। বড় মেয়ে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাশ করে এবার দ্বিতীয়বারের মত বিসিএস ট্রাই করছে। ছোট মেয়ে স্নাতকে পড়ছে ময়মনসিংহের বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে।
জীবনের সব স্বাদ-আহ্লাদ আমি মেয়েদের মধ্যে দিয়ে দেখি। ওদের মুখের হাসিই আমার অক্সিজেন। নিজে না খেয়ে থাকলেও মেয়ে দুটোকে বুঝতে দেইনি। প্রতি মাসের নির্দিষ্ট দিনেই খরচের টাকা পাঠিয়ে দেই।
বড় মেয়েটি বছর পাঁচেক আগে একটি কম্পিউটার কেনার কথা বলেছিল। অতোগুলো টাকা একসঙ্গে করার আমার জন্য তখন অসম্ভব। কিন্তু মেয়েটিকে কষ্ট দিতে চাইনি। স্ত্রীকে ভালোবেসে উপহার দেওয়া একজোড়া স্বর্ণের কানের দুল ছিল। ওটা বিক্রি করে মেয়ের হাতে টাকা তুলে দিয়েছিলাম। অনেকবার জানতে চেয়েছিল, টাকাগুলো কোথায় পেলাম ? বলেছি, ধার করেছি, আস্তে আস্তে শোধ দিয়ে দিব। কিন্তু ঠিকই একসময় জেনে যায়। ওইদিনই মাঝরাতে হঠাৎ ঘুম ভেঙে যায়, দেখি মেয়েটি আমার শিয়রে কাঁদছে। ছোট মেয়েটিরও আচলে মুখ লুকানো।
বাবাতো, সবকিছু বুঝতে পারি। বলেছিলাম, তোর মায়ের স্মৃতিটা বিক্রি করে দিয়েছি বলে মন খারাপ করেছিস। তোরা দুই বোনইতো তার স্মৃতি। তোরা বড় হ, আমি বেশি খুশি হব।
এক্তেদার সরদার কাঁদছেন। অঝোরে কাঁদছেন। মেয়েরা বড় অফিসার হবে এতেই তার তুষ্টি। চোখ মুছতে মুছতে বললেন, অনেক কিছু বলে ফেললাম বাবা, কিছু মনে করোনা।
মধ্যবিত্ত পরিবারে এমন গল্পগুলো ঘুরেফিরে চোখের জল ঝড়ায়। তবুও এক্তেদার সরদারের মতো বাবারা সর্বস্ব উজার করে কন্যা-পুত্রের পাশে সীসা ঢালা প্রাচীর হয়ে পাশে থাকেন।
৪১ তম বিসিএসেও অনেকে ক্যাডার হবে। যার বেশিরভাগই এক্তেদার সরদারের মতো পরিবার থেকে উঠে এসেছে। বাবার শরীরের রক্ত পানি করা টাকা, মায়ের শত বিনিদ্র রাত, পরিবারের সবটুকু সুখ-আহ্লাদ বিসর্জনে অনেকেই রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ শ্রেণীর চাকরি করবে।
সবার জন্য অগ্রীম শুভ কামনা।
আমরা সবাই অতীত ভুলে যাই। সেবাপ্রার্থীদের থেকে স্যার শুনতে চাই। তুচ্ছতাচ্ছিল্য ব্যবহার করি। ছেড়াজুতো আর ময়লা জামা-কাপড়ে ভদ্রপাড়ার অফিসগুলো এলাউ করে না। কিন্তু এই এক্তেদার সরদারের মত বাবাদের তেল চিটচিটে জামা, ছেড়া জুতোর বদৌলতেই আমরা মানুষ হয়ে আছি। এমন অসংখ্য এক্তেদার সরদাররা কোনো অফিসে গেলে সম্মান দেওয়াটা ভদ্রতা নয়, তাদের অধিকার।
লেখক : শব্দ শ্রমিক।