সময় জার্নাল প্রতিবেদক : নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (নোবিপ্রবি) খাদ্যপ্রযুক্তি ও পুষ্টি বিজ্ঞান বিভাগের মাস্টার্সের ছাত্র পুষ্টিবিদ মুরাদ পারভেজ। ছাত্র অবস্থায় বিয়ে করে চরম সমস্যার মুখে পড়েন মুরাদ। পরিবারের আর্থিক অবস্থা ভালো না থাকায় অভাব ছিলো চারিদিকে। অভাব কাটিয়ে উঠতে স্ত্রীর অনুপ্রেরণায় উদ্যোক্তা জগতে পদার্পণ করেন। সেই মুরাদ আজ সফল উদ্যোক্তা।
অনার্স প্রথমবর্ষে থাকা অবস্থায় তার সম্পর্ক হয় পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের ছাত্রী তামান্না মিমি সুলতানার সঙ্গে। সেই সম্পর্কের জের ধরেই অনার্স দ্বিতীয় বর্ষে এসে মুরাদ বিয়ে করেন তাকে। মিমি তখন অনার্স প্রথম বর্ষে অধ্যয়ন করছিলেন। ছাত্র অবস্থায় বিয়ে করে চরম আর্থিক সমস্যার মুখে পড়েন মুরাদ। এই সময়ে স্ত্রীর অনুপ্রেরণায় প্রতিষ্ঠা করেছেন অনলাইন আমের হাট ‘ম্যাঙ্গো লাভার’ এবং মাটির তৈজসপত্রের প্রতিষ্ঠান ‘পোড়ামাটি’।
গত বছরের ৮ মার্চ যেদিন দেশে প্রথম করোনা রোগী শনাক্ত হয় ঠিক সেদিনই প্রকাশ হয় মুরাদের স্নাতকের ফলাফল। এরপর দেশজুড়ে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ক্রমেই বাড়তে থাকে। সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ায় আসে লকডাউনের ঘোষণা। দেশের সার্বিক পরিস্থিতি অস্বাভাবিক হয়ে গেলেও বসে থাকেননি স্নাতক শেষ করা মুরাদ।
পুষ্টিবিজ্ঞান নিয়ে পড়াশোনা করায় তিনি স্বপ্ন দেখতে লাগলেন নিরাপদ খাদ্য নিয়ে কাজ করার। সেই স্বপ্ন পূরণ হয় ওই বছরের জুন মাসে এসে। বাগানের শতভাগ কেমিক্যালমুক্ত আম দেশের বিভিন্ন প্রান্তে সুলভ মূল্যে সরবরাহ করা এবং সবাইকে অনলাইনে কেনাকাটার প্রতি আগ্রহী করে তোলার লক্ষ্যকে সামনে রেখে জুন মাসেই তিনি পুরোদমে কাজ শুরু করেন রাজশাহীর আম নিয়ে।
প্রথম বছরেই অনলাইনে ৬ হাজার কেজি আম বিক্রি করেন তিনি। অন্য আম ব্যবসায়ীদের মতো ক্রেতাদের থেকে অগ্রিম টাকা নেননি মুরাদ। আম হাতে পেয়েই ক্রেতারা তাকে টাকা দিতো। কোনো কারণে আম খারাপ হলে আবার নতুন করে আম পাঠাতেন তিনি। আম বিক্রির লাভের টাকায় দুটি গরু কিনেন মুরাদ। পাশাপাশি শুরু করেন মাটির তৈরি তৈজসপত্রের ব্যবসা।
অনলাইনে গত নয় মাসে সারাদেশে প্রায় ৬৩০টি পানির জার বিক্রি করেন তিনি। ক্রেতাদের বিশ্বস্ততা অর্জন করে এরপর আবার চলতি বছরে এসে মাত্র ৩৩ দিনে ২৩ টন আম বিক্রি করেছেন তিনি। শুধু করোনাকালীন সময়ে অনলাইনে মোট ৩৫ লাখ টাকার আম ও মাটির তৈজসপত্র বিক্রি করেছেন পুষ্টিবিদ মুরাদ। এখনও চলছে তার ব্যবসা।
আম ব্যবসায়ে তিনি ১৩ জন শ্রমিকের কর্মসংস্থানের সৃষ্টি করেছেন। গাছ থেকে আম সংগ্রহ, পরিবহণ ও প্যাকেজিংয়ের কাজে নিযুক্ত করেছেন তাদেরকে। এ ছাড়া কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া ৪৩ জন শিক্ষার্থী ও এক পুলিশ সদস্য তার থেকে পণ্য কিনে পুনরায় বিক্রি করে উপার্জন করছেন। তাদেরকে পাইকারি মূল্যেই পণ্য দেন মুরাদ।
নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান হওয়ায় মুরাদ পারভেজের ফেলে আসা দিনগুলো ছিলো সংগ্রামমুখর। অতীতের কষ্টের কথা স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে মুরাদ পারভেজ বলেন, আমার জন্ম দরিদ্র কৃষক পরিবারে। যতটুকু মনে পড়ে একদম ছোটবেলায়ও বাবার সঙ্গে মাঠে কৃষি কাজ করতে যেতাম। দুইবেলা নিয়ম করে ছাগল নিয়ে মাঠে যেতাম, গরুর জন্য ঘাস কাটতাম। উচ্চমাধ্যমিক পর্যন্ত পড়াশোনার পাশাপাশি এগুলো ছিল আমার নিত্যদিনের কাজ।
মা গরুর দুধ বিক্রি করে পড়ালেখার খরচ যোগাতেন। বাবার দুটো সংসার ছিল, তাই বাবার পক্ষে সব চাহিদা পূরণ করা সম্ভব হতো না। পরিবারের আর্থিক সমস্যার কারণে নবম শ্রেণিতে ওঠার আগে কখনো প্রাইভেট পড়ার সুযোগও হয়নি- জানান মুরাদ।
মুরাদের মেধা, বুদ্ধিমত্তা ও পরিশ্রমের ফল ভোগ করছে পরিবারও। পরিবারকেও পূর্ণ সাপোর্ট দিচ্ছেন তিনি। মুরাদ গর্ব করে বলেন, অনলাইনে পণ্য বিক্রি করে আমি আমার পরিবারে অবদান রাখছি এটাই আমার বড় পাওয়া। পরিবারের সাপোর্টও সবসময় ছিল।
মুরাদ আরও বলেন, স্ত্রীর অনুপ্রেরণায় আমার উদ্যোক্তা জীবন শুরু। আমার বাবাও আমাকে সহযোগিতা করেছেন। শাশুড়িও আমার পাশে ছিলেন সবসময়। বাবা অত্যন্ত মেধাবী হওয়া স্বত্বেও অভাবের কারণে মেট্রিক পরীক্ষা দিতে পারেননি। দারিদ্র্যতার মধ্যেও বাবা চেয়েছেন আমি বড় হই।
চাকরি নয়, ব্যবসার সঙ্গেই যুক্ত থাকতে হতে চান পুষ্টিবিদ মুরাদ। অনলাইন প্লাটফর্মকে কাজে লাগিয়ে হতে চান বড় উদ্যোক্তা। তিনি বলেন, চাকরি করার ইচ্ছে নেই আমার। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে সরকারি জব কিংবা বড় কোনো কোম্পানিতে চাকরি করতে হবে বিষয়টা এমন না। বিজনেস করেও, উদ্যোক্তা হয়েও সুন্দরভাবে পরিবারকে সাপোর্ট দেয়া যায়, নিজের বেকারত্ব দূর করা যায়।
নিজের স্বপ্নের কথা জানিয়ে মুরাদ বলেন, আমি স্বপ্ন দেখি বড় উদ্যোক্তা হওয়ার। এখন তো বাজারে ভেজাল খাদ্যের সয়লাব। নিরাপদ খাদ্য নিয়ে বড় পরিসরে কাজ করতে চাই আমি। অনলাইন প্লাটফর্মে মানুষের বিশ্বস্ততা অর্জন করারও ইচ্ছে আমার। কেননা এখন অনলাইনের প্রতি মানুষের নেগেটিভ ধারণা জন্মে গেছে। সেই ধারণা পাল্টাতেই আমি আগে প্রোডাক্ট দেই, পরে টাকা নেই।
সময় জার্নাল/এসএ