মো. মোস্তাফিজুর রহমান
'হয় যদি বদনাম হোক কারো/আমি তো এখন আর নই কারো'- চির সবুজ জাফর ইকবাল একটি নয়, দুটি নয়-চলচ্চিত্রের এরকম অসংখ্য জনপ্রিয় গানে রূপালি পর্দায় ঠোঁট মিলিয়ে দর্শক-শ্রোতার কাছে অমর হয়ে আছেন চিরসবুজ-স্বনামধন্য-সুদর্শন-স্মার্ট-স্টাইলিশ-পোশাক সচেতন সবার প্রিয় নায়ক জাফর ইকবাল। তাঁর অভিনীত প্রতিটি ছবিই দেখতে ছুটে যেতাম সিনেমা হলে। অন্যরকম ভালোলাগা আর উন্মাদনা কাজ করতো মনে। বলতে গেলে ৯০ দর্শক পেরুনোটাই ছিল চলচ্চিত্রের স্বর্ণালী যুগের শেষ সময়।
প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে আসা আমার সিনেমা দেখার হাতেখড়ি ছিল হোস্টেলের সিনিয়র ভাইদের হাত ধরে। প্রথম প্রথম নাচ-গান কী, কারা নাচে, ফাইটিং কী, নায়ক-নায়িকা কী, এমন জিনিস এভাবে দেখে কী লাভ তার কিছুই বুঝতাম না। শুধু ভাইদের সাথে পাশের সীটে বসে সময় কাটাতাম। এভাবেই ক্রমে ক্রমে একদিন রূপালি ফ্রেমের রাজ্জাক-শাবানা-আলমগীর-ববিতা-রোজিনা-ইলিয়াস কাঞ্চন-জসিম-জাফর ইকবাল ভক্ত হয়ে গেলাম। যদিও গ্লামার জগতের কল্যাণে পরবর্তীতে সালমান শাহ, মৌসুমী, শাবনূর অভিনীত গোটা ক'টি ছবি দেখার সুযোগ হয়েছে।
একসময় চলচ্চিত্র মুক্তি পেতো দর্শক আমাকে পেতো না। পরবর্তীতে এমন সিনেমা প্রেমী দর্শক হয়েছি যে, দেখার মত নতুন ছবি পেতাম না। মানে সব ছবি দেখা শেষ হয় যেতো। এমনও হতো-গানের কারণে, কাহিনী কিংবা অভিনয়ের মুগ্ধতায় এক ছবি একাধিকবার দেখা হয়ে যেতো। এতো সব ছবি দেখতে গিয়ে স্কুল-কলেজ জীবনে কত যে ক্লাস ফাঁকি দিয়েছি, কত যে শিক্ষকের হাতে মার খেয়েছি, কত যে রেলিং টপকিয়ে হোস্টলে প্রবেশ করেছি! কত যে মিথ্যা বলেছি, কত যে ঝগড়া করেছি! কত যে টাকা শেষ করেছি! আহারে! বৃহত্তম বিনোদন জগত চলচ্চিত্রের সোনালী দিনের সেই বিনোদন আজ কোথায়! মনে পড়ে শৈশবের দূরন্তপনা সেই সময়গুলোর কথা! যদি ফিরে পেতাম আবার!
রূপালী জগতের চিরসবুজ নায়ক বীর মুক্তিযোদ্ধা জাফর ইকবালের আজ মৃত্যুদিন। প্রায় ১৫০টি ছবিতে অভিনয় করেন তিনি। বন্ধুদের নিয়ে ১৯৬৬ সালে ব্যান্ড দল গঠন করেন। ভালো ইংরেজী গান করতেন এবং ভালো গীটারও বাজাতেন। এজন্য চলচ্চিত্রে আবহ সংগীতের কাজও করতেন। সিনেমায় প্রবেশ 'আপন পর' ছবির মাধ্যমে। বেতারের কল্যাণে চলচ্চিত্রের পর্দায় যেসব জনপ্রিয় গানের চিত্রায়নে জাফর ইকবাল আজও বেঁচে আছেন শ্রোতা হৃদয়ে-
১) কত যে তোমাকে বেসেছি- উসিলা
২) তুমি আমার জীবন- অবুঝ হৃদয়
৩) শোন সোমা সোমা- প্রতিরোধ
৪) আমার বাবার মুখে- নয়নের আলো
৫) আমার সারাদেহ- ঐ-
৬) ভেঙ্গেছে পিঞ্জর- ভাইবন্ধু
৭) চাঁদের সাথে আমি- আশির্বাদ-
৮) একটাই কথা আছে- বন্ধু আমার
৯) আমি তোমার ভালোবাসার চিঠি পেলাম- দোষী
১০) আমি তোমার মনের মত ছিলাম- গর্জন
১১) সকালটা যে আমার বিকেলটা- যোগাযোগ
১২) প্রেমের আগুনে জ্বলে- ফকির মজনুশাহ
১৩) ফুল ফোটা ফাগুনে- প্রেমিক
১৪) হয় যদি বদনাম- বদনাম
১৫) জয় আবাহনী জয় মোহামেডান- সন্ধি
১৬) এই যে দুনিয়া- ঐ
১৭) ও বাবারে দেইখ্যা যারে- চোর
১৮) ধুততারা শুকতারা- লক্ষ্মীর সংসার
১৯) হয়তোবা কিছু লোক কভু ভালোবাসতে- মিস লংকা
২০) তুমি সেই সে তুমি ওগো- চোরের বউ
২১) যারে যাবে যদি যা- আপন পর
২২) শোন ভাইরা শোন- একমুঠো ভাত।
চলচ্চিত্র ছাড়াও নিজের কণ্ঠে গেয়েছেন কিছু গান-
১) সুখে থাকো ও আমার নন্দিনী
২) যেভাবেই বাঁচি বেঁচেতো আছি, জীবন আর মরণের...
৩) এক হৃদয়হীনার কাছে...
৪) হয় যদি বদনাম...
১৯৮৪ সালে 'বদনাম' ছবিতে নিজের কণ্ঠে গান করেন তিনি। মূলত গীটার বাদক ছিলেন। প্রখ্যাত সুরকার ও সংগীত পরিচালক আলাউদ্দিন আলী তাঁর ছবিতে প্রথম আবহ সংগীতের কাজ করান। 'আপন পর' ছবির মাধ্যমে চলচ্চিত্রে প্রথম অভিনয় করেন। প্রায় ১৫০ ছবিতে অভিনয় করেন। তারমধ্যে চিত্রনায়িকা ববিতার সাথে জুটিবদ্ধভাবে ৩০টি ছবিতে অভিনয় করেন। সামাজিক, বাণিজ্যিক এবং 'মাস্তান' নামের মারদাঙ্গা ছবিতেই তিনি অভিনয়ের মাধ্যমে দর্শকের নজর কেড়েছেন।
তিনি একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা। যুদ্ধ করছেন দেশের জন্যে। চিরসবুজ প্রিয় নায়ক জাফর ইকবালের প্রতি জানাই বিনম্র শ্রদ্ধা।
লেখক : উপ-পরিচালক, বাংলাদেশ বেতার, ঢাকা।