ডা. শহীদুল ইসলাম :
আমার নয় বছর বয়সে চতুর্থ শ্রেনীতে পড়াকালীন সময় পাঠ্যসূচি বহির্ভূত বই পড়ায় হাতেখড়ি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আমার চাচাতো ভাই সন্ধ্যা নদীর ওপাড়ে জুগিরকান্দা বাজারে অবস্থিত নবারুন সাহিত্য মজলিস পাঠাগার থেকে "সোনা পুতুলের বিয়ে" বইটি এনে দেন।
সেই যে বই পড়া শুরু তারপর থেকে এক নাগাড়ে চার যুগ তেলাপোকার মতো সর্বভুক প্রানী হয়ে হাতের কাছে যখন যা পেয়েছি তা-ই পড়ে শেষ করেছি। এক বেলা ভাত না খেলেও চলতো কিন্তু বই না পড়ে একদিনও চলতো না।
হাইস্কুলে পড়া পর্যন্ত শরৎচন্দ্রের বই-ই সবচেয়ে প্রিয় ছিল। দশম শ্রেণিতে পড়ার সময় বঙ্কিমচন্দ্রের দেবী চৌধুরানী ও গোর্কির "মা" পড়ি। কলেজ জীবনে ও মেডিকেল কলেজের ছাত্রাবস্থায় আরও দু'বার "মা" পড়েছি। যেমন "প্রথম আলো" পড়েছি তিনবার। এযাবৎ পঠিত আমার প্রিয় কিছু বইয়ের নাম ---
প্রথম আলো, সেই সময়, পূর্ব পশ্চিম, উত্তরাধিকার, কাল পুরুষ, কাল বেলা, সাতকাহন, দূরবীন, মানবজমিন, গনদেবতা, লা মিজারেবল, ন হন্যতে, লা নুই বেঙ্গলি, শেষের কবিতা, পথের পাঁচালি, আরন্যক, চট্টিমুন্ডা ও তার তীর, তিস্তা পাড়ের বৃত্তান্ত, আমলকির মৌ, শবনম, কোলকাতার কাছে, নিশিকুটুম্ব, কেরু সাহেবের মুন্সী, প্রথম প্রতিশ্রুতি, বাবর ( এটি উপন্যাস, বাবরের যাপিত জীবন নিয়ে পিরিমকুল কাদিরভের লেখা)। এখানে প্রিয় বইসমুহের সব নাম আসেনি। আরও অনেক আছে। কিন্তু এ মুহূর্তে মনে পড়ছে না। তবে আমার অত্যন্ত প্রিয়ভাজন ও স্নেহভাজন জয়ের ( Joynal Abedin) প্রথম ও দ্বিতীয় উপন্যাস যথাক্রমে "শেকল" ও "বিভ্রম" আমার মনে আলাদা একটা জায়গা করে নিয়েছে, আপ্লূত করেছে, মুগ্ধ করেছে। এই দুটি বই পড়ে একটানে শেষ করতে গিয়ে আমি "প্রথম আলো" উপন্যাসের মতো পুরো রাত জেগে পড়েছি। তা দিয়েই বোঝা যায় এই বই দুটো কি পরিমাণ আগ্রহ ও আকর্ষণ সৃষ্টি করেছে। প্রসঙ্গক্রমে বলে ফেলি, বিভ্রম উপন্যাস কেনার পড়ে হঠাৎ উৎসর্গ পত্র পড়তে গিয়ে চমকে যাই। বইটি আমাকে উৎসর্গ করা- যা ছিলো আমার কাছে মধুর চমক। যারা বই দুটি পড়েন নি তাঁদের বলবো, পড়ে দেখুন। আপ্লূত হবেন নিশ্চিতভাবেই। দু-একদিন হয়তো কাটবে ঘোরের মাঝে। এর অন্যথা হলে সব দায় আমার।
চার যুগ বা আটচল্লিশ বছর একাধারে বই পড়ে আজ থেকে পাঁচ বছর আগে ২০১৫ সনের শুরুর দিকে আমি লেখালেখি শুরু করি। অনেক কিছু না জেনে না বুঝে প্রথমেই শুরু করি একটা উপন্যাস লেখা। নিজের টাইমলাইনে ১০৩ পর্বের ধারাবাহিক এ উপন্যাসে পাঠকের প্রতিক্রিয়া আমাকে চমকে দিয়েছিলো। তাঁদের সমর্থন, সমালোচনা এবং উৎসাহ অনুপ্রেরণা আমি কৃতজ্ঞতার সাথে সারাজীবন মনে রাখবো। ঐ পাঠককুলের পঞ্চাশ জন আমি ও আমার পরিবারকে নিয়ে নিঝুম দ্বীপ উপন্যাসের ঘটনাস্থল অর্থাৎ নিঝুম দ্বীপ ভ্রমণে যান। ঐ ভ্রমণ ছিলো আমার অসংখ্য ভ্রমণের মধ্যে অন্যতম ঘটনাবহুল, উপভোগ্য ও সেরা একটি ভ্রমণ। ঐ ভ্রমণের পর ২০১৮ সনের বইমেলায় আমার প্রথম বই "নিঝুম দ্বীপ" প্রকাশিত হয় এবং দুই সপ্তাহে ৫০০ কপি বিক্রি হয়ে যাওয়ায় পরপর তিনদিন মেলা থেকে পাঠক বই না পেয়ে খালি হাতে ফিরে অভিযোগ করেছে। তিনদিন পর বই ছাপিয়ে পাঠকদের সন্তুষ্ট করা হয়।
প্রথম বইয়ের সাফল্যে এরপর নিয়মিত লিখতে উদ্বুদ্ধ হই। পরপর তিন বছর তিনখানা উপন্যাস প্রকাশিত হলেও ২০২০ এ পেন্সিল পাবলিকেশন্স থেকে আমার প্রথম গল্প সঙ্কলন "নিষিদ্ধ গল্প" প্রকাশ করার জন্য নির্বাচিত হওয়ায় আমি গভীর আনন্দ অনুভব করি। পাবলিকেশন্স সংশ্লিষ্ট সকলের প্রতি আমার বিনয়াবনত কৃতজ্ঞতা।
মাস তিনেক যাবত নিজের টাইমলাইন বা পেন্সিল সহ অন্যান্য সাহিত্য গ্রুপে আমার নতুন লেখা খুব কম পোস্ট করা হচ্ছে। তার একটা কারন হলো, এর আগের চার মাস প্রতিদিন বিকেল পাঁচটায় পেন্সিলে নিয়মিত গল্প বা উপন্যাসের পর্ব পোস্ট করতে গিয়ে মানসিক ভাবে ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলাম। ঐ সময়ে লেখা প্রায় আশি হাজার শব্দের সাঁইত্রিশ পর্বের ধারাবাহিক উপন্যাস "ক্ষত" পাঠক হৃদয়ে যে জায়গা পেয়েছে তা আমাকে গভীরভাবে আপ্লূত করেছে। এতোটা সাড়া পাওয়ার প্রত্যাশা আমার কল্পনায়ও ছিলো না। বোদ্ধা পাঠকবৃন্দের নিকট কৃতজ্ঞতার শেষ নেই। এরপর বড়ো গল্প "নীলাঞ্জনা" "অথৈ সাগর" "কিপ্টা জামাই" "শ্বেতমহল" সহ অন্ততঃ গোটা বিশেক গল্প লিখে আসলেই ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলাম। প্রতিদিন নিয়ম করে তিনবেলা লিখতে গিয়ে এবং ঠিক পাঁচটায় পর্ব পোস্ট করতে গিয়ে আমার দৈনিক বরাদ্দ থেকে দুই ঘন্টা ঘুম কর্তন করতে হয়েছে এক নাগাড়ে চার মাস। তাই শরীর ও মনকে বিশ্রাম দিতে কিছুদিন বিরতিতে চলে যাই।
তাহলে কি লেখালেখি একেবারে বন্ধ?
না, তা নয়। ইদানীং বেশ কয়েকটি গল্প লিখে শেষ করেছি। তার ভিতরে একটা গল্প "মজিদ মিয়ার মর্জি" লিখতে গিয়ে আমি কেঁদে ফেলেছি। চোখ মুছে মুছে লেখা এগিয়েছি। গল্পটা লিখে ভীষণ তৃপ্তি পেয়েছি।
আরও বেশ কিছু গল্প অসমাপ্ত অবস্থায় আছে। ভ্রমণ বিষয়ক গল্পই আছে তিনটি। আশা করি খুব তাড়াতাড়ি ওগুলো সমাপ্ত করে ফেলবো। কিন্তু সময়টা ব্যায় করছি বই পড়ে। গত বইমেলায় কেনা ষাটখানা বইয়ের অনেকগুলো এখনো পড়া হয়নি। লেখালেখির জন্য সময় বের করতে গিয়ে পড়াশোনার সময় বের করা কষ্টকর হয়ে গেছে।
লিখতে হলে প্রচুর পড়াশোনা করা দরকার। এর কোনো বিকল্প নেই। একমাত্র কেউ অসাধারণ মেধাবী হলেই শুধু না পড়েও হয়তো লেখা যায়। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ বা নজরুল যুগে যুগে ক'জন হয়?
আমি এ মুহূর্তে তিন খানা বই পড়ে শেষ করতে চাই। এর মাঝে কবি অনেক আগে পড়লেও নতুন করে পড়বো। বাকি দুটি বই আমার প্রিয় দু'জন লেখকের। এশরার লতিফ ও তাবাসসুম নাজ অসাধারণ লিখেন। সম্পর্কে তাঁরা দু'জন আমার বন্ধু, ভাই ও বোনের মতো হলেও লেখনীর মেধার কারনে আমার কাছে শ্রদ্ধা ও ভালবাসার জায়গা করে নিয়েছেন। গত সপ্তাহে পেন্সিল অফিসে গিয়ে এই বইগুলো রুম্মান ভাইয়ের ( Shahadat Rumon) কাছ থেকে সংগ্রহ করেছি।
মনের ভিতর নিজস্ব একটা ভূবন তৈরি করতে, বোধ ও মনন সৃষ্টি করার জন্য বই পড়ার বিকল্প কিছু নেই।
আসুন আমরা সবাই পাঠাভ্যাস গড়ে তুলি। সন্তানদের বই পড়তে উৎসাহ দেই। ওরা ভালো ভালো বই পড়লে একদিন সুনাগরিক হিসেবে নিজেকে গড়ে তুলে এ দেশকে সুনেতৃত্ব দিয়ে এগিয়ে নিয়ে যাবে।
বই কিনুন, বই পড়ুন। সৃজনশীল কাজে সহায়তা করার সাথে সাথে আত্মোন্নতি সাধন করুন। বই হোক আমাদের নিত্য সাথী।
লেখক : সাবেক সিভিল সার্জন মুন্সিগঞ্জ