ডা. জয়নাল আবেদীন টিটো :
আজ ২৫শে ডিসেম্বর, বড়দিন ।
খৃস্টপূর্ব ৪ সনে, অর্থাৎ আজ থেকে ২০২৫ বছর আগে ফিলিস্তিনের জেরুসালেমের কাছে বেথেলহাম নামক স্থানে যিশু খ্রিষ্ট জন্ম গ্রহণ করেন ।
তার জন্ম সম্বন্ধে জেনেছি কোরআন পড়ে। কোরআনে তাঁর ও তাঁর মাতা মেরি বিষয়ে একটি সুরা আছে। সেই সুরার নাম মারিয়াম। কিন্তু বাইবেলে মেরির নামে কোন অধ্যায় নেই।
অল্প বয়সেই মারিয়ামকে তাঁর পিতামাতা আল্লাহর (ইবাদাতের) জন্য উৎসর্গ করেন। মসজিদের পূর্ব দিকে একটি নিভৃত কক্ষ মারিয়ামের জন্য নির্ধারণ করা হয়। সেখানে থেকে তিনি ইবাদাত বন্দেগী করতেন। কোন পুরুষের সমুখে তিনি তেমন একটা আসতেন না।
হঠাৎ একদিন জিবরাঈল ফেরেশতা মানুষের রূপ ধারণ করে তাঁর কাছে উপস্থিত হলেন। সতী-সাধ্বী-কুমারী নারী তাঁর আপন কক্ষে এক অচেনা পুরুষকে দেখে ভয় পেয়ে গেলেন। হতচকিত মুহূর্তে শুধু এটুকুই বলতে পারলেন, "আপনি যদি ধর্মভীরু হয়ে থাকেন, তাহলে আপনার থেকে পরম করুণাময়ের কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করছি"।
"তোমার প্রভু আল্লাহ্র পক্ষ থেকে আমি তোমার কাছে দূত হয়ে এসেছি, তোমাকে একটি পূত পবিত্র সন্তানের সুসংবাদ দিতে"
জিবরাঈল বললেন ।
"কেমন করে আমার সন্তান হবে ? কোন পুরুষ কোনদিন আমায় স্পর্শ করেনি । খারাপ চরিত্রের নারীও তো আমি নই"
বিস্ময়মাখা কণ্ঠে মারিয়ামের উত্তর ।
জিবরাঈল বললেন, এমনিই হবে। আল্লাহ্ যা চান তা এভাবেই সৃষ্টি করেন। তোমার প্রভু বলে পাঠিয়েছেন, "এটা করা আমার জন্য খুবই সহজ। তোমার পুত্রকে আমি সব মানুষের জন্য নিদর্শন বানাতে চাই, আর সে হবে আমার পক্ষ থেকে সবার জন্য রহমত। এর সিদ্ধান্ত অনেক আগে থেকেই হয়ে আছে। তিনি যখন কোন সিদ্ধান্ত নেন, তখন বলেনঃ 'হও', এবং তা হয়ে যায়।"
মারিয়ামের দুচোখে বিস্ময়।
জিবরাঈল বলে চলছেন, তোমার প্রভু বলে পাঠিয়েছেন, "তোমার ছেলের নাম হবে মাসীহ ঈসা। সে দুনিয়া এবং আখিরাতে সম্মানিত হবে। দোলনায় থাকা অবস্থায় সে মানুষের সাথে কথা বলবে, এবং পরিণত বয়সেও কথা বলবে। সে হবে সত্যনিষ্ঠ। আল্লাহ্ তাঁকে তাঁর কিতাব শিক্ষা দিবেন, প্রজ্ঞা দান করবেন, তাওরাত এবং ইঞ্জিল শিক্ষা দিবেন।"
এটুকুন বলে জিবরাঈল শূন্যে মিলিয়ে গেলেন। মারিয়ামও আগের মত ইবাদাতে মগ্ন হয়ে পড়লেন। মাঝে মাঝে জিবরাঈল মারিয়মের কাছে আসেন, আঙ্গুর, বেদানা, নাশপাতি সহ নানা ফল ফলাদি নিয়ে; কখনও শরীরী রূপে, কখনও অশরীরী রূপে।
কোনো একদিন মারিয়াম গর্ভবতী হন। সন্তান প্রসবের সময় ঘনিয়ে এলে তিনি চলে যান অনেক অনেক দূরে, মানবচক্ষুর আড়ালে।
সন্তান প্রসবের সময় হলে প্রচণ্ড প্রসব ব্যাথায় তিনি একটি খেজুর গাছের নিচে আশ্রয় নেন।
ফুলের মত নিস্পাপ, সুন্দর এক শিশুর জন্ম হল।
লোকে যদি কলঙ্কিনী বলে, এই ভয়ে তিনি নিজে নিজেই বলে উঠেন, "হায়! এর আগেই যদি আমার মরণ হত! আমি যদি মানুষের স্মৃতি থেকে চিরদিনের জন্য মুছে যেতাম!"
তখন এক অদৃশ্য কণ্ঠ থেকে আওয়াজ এলো, "দুঃখ করো না। তোমার প্রভু, তোমার রব্ব তোমার নিচে একটি জলধারা সৃষ্টি করে দিয়েছেন। তুমি এ খেজুর গাছের কাণ্ড ধরে একটু নাড়া দাও, তাজা তাজা খেজুর তোমার উপর ঝরে পড়তে থাকবে। খেজুর খাও, পানি পান কর, আর (অলৌকিক শিশুর মুখ দেখে) নিজের চোখ জুড়াও। কোন মানুষ দেখতে এলে বলবে, আমি পরম করুণাময়ের জন্য রোজা রাখার মানত করেছি। আজ আমি কারো সাথে কথা বলব না।"
পরে মারিয়াম তাঁর শিশুসন্তানকে নিয়ে তাঁর সম্প্রদায়ের মধ্যে চলে এলেন। তাঁর সম্প্রদায়ের লোকেরা আশ্চর্য হয়ে বলল, "হে মারিয়াম, তুমি এক মহাকাণ্ড করে ফেলেছ। তোমার পিতা কোন খারাপ মানুষ ছিলেন না; তোমার মা-ও তো কোন দুশ্চরিত্রা নারী ছিলেন না। তুমি এমন করলে কেমন করে?"
মারিয়ামে ইশারায় তাঁর ছেলের সাথে কথা বলতে বললেন। লোকেরা বলল, 'আমরা এতটুকু কোলের শিশুর সাথে কথা বলব কেমন করে!'
অলৌকিক শিশুটি বলে উঠল, "আমি আল্লাহ্র বান্দা। তিনি আমাকে কিতাব দিয়েছেন, আমাকে নবী বানিয়েছেন। আমি যেখানেই থাকি না কেন, তিনি আমাকে কল্যাণময় করেছেন। তিনি আমাকে আদেশ দিয়েছেন, আমি যেখানে থাকি আর যতদিন জীবিত থাকি, ততদিন যেন সালাত আদায় করি, যাকাত আদায় করি। তিনি আরও আদেশ দিয়েছেন, আমি যেন আমার মায়ের প্রতি অনুগত থাকি। আমার প্রভু আমাকে অহংকারী, স্বেচ্ছাচারী, হতভাগা বানাননি...... ।
শান্তি আমার প্রতি -- যেদিন আমি জন্ম নিয়েছি, শান্তি আমার প্রতি--যেদিন আমি মৃত্যবরণ করব, শান্তি আমার প্রতি--যেদিন আমাকে মৃত্যুর পর পুনরায় জীবিত করে উঠানো হবে"।
###
যিশু সবসময় বলতেন, "আল্লাহ্ই আমার প্রভু এবং তোমাদেরও প্রভু। তোমরা শুধুমাত্র তারই ইবাদাত কর। এটাই সরল সঠিক পথ।’’
বনি ইসরাইল -- যাদেরকে আমরা ইহুদী বলে জানি, তাদেরকে উদ্দেশ্য ঈসা বা যীশু বললেন, 'আমি তোমাদের প্রভুর পক্ষ থেকে তোমাদের কাছে নিদর্শন নিয়ে এসেছি'।
'কেমন নিদর্শন, দেখাও দেখি ?' বনী ইসরাইলের লোকেরা বলল।
ঈসা মাসীহ (যীশু খৃস্ট) কাদামাটি দিতে পাখির একটি আকৃতি তৈরী করলেন। তারপর আল্লাহ্র নাম নিয়ে এতে ফুঁ দিলেন। সেটা সত্যি সত্যই পাখি হয়ে উড়ে গেল।
এক জন্মান্ধ লোকের চোখে হাত বুলিয়ে দিলেন, সে অন্ধ লোক তার চোখের দৃষ্টি ফিরে পেল।
এক কুষ্ঠ রোগীর শরীরে হাত বুলিয়ে দিলেন, তার কুষ্ঠ পুরোপুরি নিরাময় হয়ে গেল।
তাঁর সামনে এক মৃত ব্যক্তিকে আনা হল। আল্লাহ্র নাম নিয়ে তিনি সে মৃতকে জীবিত করলেন।
একেকজন এসে জিজ্ঞেস করত, সেই ব্যক্তির ঘরে কী সঞ্চিত আছে, আর কি-ই বা লুকানো আছে, ঈসা মাসিহ তা সঠিকভাবে বলে দিতে পারতেন।
এসব দেখে অল্প সংখ্যক মানুষ তাঁকে আল্লাহ্র নবী হিসাবে বিশ্বাস করল। তবে বেশীর ভাগ মানুষ এসব নিদর্শনকে জাদু-তামাশা মনে করল।
তিনি একদিন রাস্তা দিয়ে কোথাও যাচ্ছিলেন। পথিমধ্যে এক লোক এসে তাঁকে গালি দিল। প্রত্যুত্তরে যীশু তাঁর জন্য হাত তুলে দুয়া করলেন। তাঁর অনুসারীরা বলল, "হুজুর, ঐ ব্যাটা আপনাকে গালি দিল, আর আপনি (অভিশাপ না-দিয়ে) তাঁর জন্য দুয়া করলেন? প্রাজ্ঞ ঈসা বললেন, "যার তহবিলে যা আছে, সে তাই তো অন্যকে দান করে"।
ঈসার জনপ্রিয়তা বাড়ছিল, একই সাথে বাড়ছিল তাঁর প্রতি বিদ্বেষীর সংখ্যা। বিশ্বাসীদের সংখ্যা বাড়তে থাকায় হিংসুকরা তাঁকে দুনিয়া থেকে সরিয়ে দিতে একমত হল। খ্রিস্টীয় ৩০ বা ৩৩ সালে তিনি এ পৃথিবী থেকে উর্ধ্বলোকে অন্তর্ধান করেন।
.........................................................
শব্দার্থঃ
ঈদ= খুশী/ আনন্দ
মিলাদ= জন্ম
নবী= মানুষকে পথ প্রদর্শনের জন্য আল্লাহ্ কর্তৃক প্রেরিত মহাপুরুষ ।
ঈদে মিলাদুন্নবী অর্থ নবীর জন্ম উপলক্ষে খুশি / আনন্দ
ঈসা= যীশু
মাসীহ= খৃষ্ট
ঈসাহ মাসীহ অর্থ যীশু খৃষ্ট
যীশু খৃষ্ট ঈসা মাসীহ'র প্রকৃত জন্মতারিখ কবে, সেটা আজও নির্ধারণ করা সম্ভব হয়নি। ২২১ খ্রিস্টাব্দে স্যাক্সটাস জুলিয়াস আফ্রিকানাস, ২৫ শে ডিসেম্বর যীশু খৃস্টের জন্ম তারিখ বলে মত দেন, এবং পরে এটাই জনপ্রিয়তা পায়।
...........................................................
Zainal Abedin Tito
২৫শে ডিসেম্বর, বড়দিন