শনিবার সকাল সাড়ে নয়টায় জাতীয় প্রেসক্লাবের তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া মিলনায়তনে "জরায়ুমুখের ক্যান্সার নির্মূলে বৈশ্বিক কৌশল: বাংলাদেশ প্রেক্ষিত" শীর্ষক গোলটেবিল আলোচনায় মূল বক্তব্য রাখেন মার্চ ফর মাদার মোর্চার প্রধান সমন্বয়কারী ক্যান্সার রোগতত্ত্ববিদ ডা. মোঃ হাবিবুল্লাহ তালুকদার রাসকিন। পাঠকদের জন্য বক্তব্যটি হুবহু তুলে ধরা হলো।
উপস্থিত সূধী ও গণমাধ্যমের প্রিয় সহযোদ্ধাগণ,
শুভেচ্ছা নিন।
জানুয়ারি মাসকে সচেতনতা মাস হিসেবে পালনের পাশাপাশি ২০১৮ সাল থেকে জানুয়ারির দ্বিতীয় শনিবার বাংলাদেশে বেসরকারিভাবে জরায়ুমুখের ক্যান্সার সচেতনতা দিবস পালন করে আসছে মার্চ ফর মাদার (জননীর জন্য পদযাত্রা) নামের প্ল্যাটফর্ম।
আজ ৫ম বারের মত এই দিবস উদযাপনের অংশ হিসেবে ১৭টি সংগঠনের সমন্বয়ে গোলটেবিল আলোচনা, পদযাত্রা ও লিফলেট বিতরণ কর্মসূচি হাতে নেয়া হয়েছে।
"জরায়ুমুখের ক্যান্সার নির্মূলে বৈশ্বিক কৌশল: বাংলাদেশ প্রেক্ষিত" শীর্ষক গোলটেবিল আলোচনায় আপনাদের স্বাগত জানাচ্ছি।
সূচনা বক্তব্যে আমি কয়েকটি ভাগে কিছু বিষয় তুলে ধরবো, যার উপর উপস্থিত আলোচকগণ তাদের মূল্যবান বক্তব্য ও মন্তব্য তুলে ধরবেন।
♦ জরায়ুমুখের ক্যান্সার প্রতিরোধযোগ্য এবং প্রথমাবস্থায় নির্ণয় হলে ও সঠিকভাবে চিকিৎসা পেলে নিরাময়যোগ্য। এখনও বিশ্বব্যাপি নারীদের মধ্যে চতুর্থ স্থানে এর অবস্থান। ২০১৮ সালে এই ক্যান্সারে মৃত্যু হয়েছে তিন লাখের বেশি নারী। শতকরা ৯০ ভাগ মৃত্যু হয়েছে নিম্ন ও মধ্য আয়ের দেশগুলিতে। এতে প্রতিফলিত হয় বৈশ্বিক অসাম্যের চিত্র। জরায়ুমুখের ক্যান্সারের এই বিপুল বোঝার কারণ স্বাস্থ্যসেবায় সীমিত প্রবেশাধিকার, স্ক্রিনিং ও চিকিৎসা সুবিধা গড়ে না উঠা।
একটি জনস্বাস্থ্য সমস্যা হিসেবে এই ক্যান্সার নির্মূলে নেয়া হয়েছে একটি উচ্চাভিলাষী, সমন্বিত ও অন্তর্ভুক্তিমূলক কৌশল।
২০১৮ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ডিজির আহবানের পর ২০২০ সালের বিশ্ব স্বাস্থ্য সম্মেলনে এই কৌশল গৃহীত হয়।
♦বৈশ্বিক কৌশল
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার বৈশ্বিক কৌশলের শিরোনাম Global Strategy to accelerate the elimination of cervical cancer as a public health problem.
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ২০৩০ সালের মধ্যে জরায়ুমুখের ক্যান্সার নির্মূলে (ইলিমিনেশন) ৩ দফা লক্ষ্য ও কৌশল ঘোষণা করেছে। ৯০-৭০-৯০ নামে পরিচিত এই কৌশলে রয়েছে:
√ ১৫ বছরের নীচের কিশোরীদের ৯০% এইচপিভি টিকাদানের আওতায় আনা।
√ ৩৫ ও ৪৫ বছর বয়সে নারীদের ৭০% কে উচ্চমানের স্ক্রিনিং এর আওতায় আনা।
√ জরায়ুমুখের ক্যান্সার ও ক্যান্সার পূর্বাবস্থার রোগীদের ৯০% কে চিকিৎসা দেয়া।
উল্লেখ্য, ইংরেজি এলিমিনেশন শব্দের প্রতিশব্দ হিসেবে নির্মূল বলা হলেও এর অর্থ প্রতি লাখে আক্রান্তের সংখ্যা চার বা এর নীচে থাকা।
♦ আমরা জানি, জরায়ুমুখের ক্যান্সারের প্রায় শতভাগের সাথে এইচপিভি নামের ভাইরাসে সংক্রামিত হওয়ার সম্পর্ক আছে। তাই এই ক্যান্সারের প্রাথমিক প্রতিরোধে এইচপিভি টিকাদান অতি জরুরি।
♦এর পাশাপাশি অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ রিস্ক ফ্যাক্টর, যেমন বাল্যবিবাহ, অল্প বয়সে সন্তানধারণ, অনেক সন্তানের মা হওয়া, ঘন ঘন সন্তান প্রসব, ব্যক্তিগত অপরিচ্ছন্নতা- এসব বিষয়ে সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধির বিকল্প নেই।
♦ টিকাদান
বাংলাদেশে ২০১৬-১৭ সালে সরকারীভাবে বিনামূল্যে গাজীপুর জেলায় প্রায় ৩১ হাজার ১০ বছর বয়সী কিশোরীকে দুই ডোজ টিকা দেয়া হয়েছে। সারাদেশে এই কার্যক্রম এই বছর শুরু হওয়ার কথা। আমরা জেনেছি, গ্লোবাল এলায়েন্স ফর ভেক্সিনেশন এন্ড ইমুনাইজেশন এর কাছে দেশব্যাপী এইচপিভি টিকাদান কর্মসূচি প্রদানের আবেদন গৃহীত হয়েছে এবং টিকা প্রাপ্তি সাপেক্ষে এ বছর তা শুরু হবে। এর বেশি তথ্য আমরা এখনও জানতে পারি নাই।
সারাদেশের কিশোরীদের (৯-১৪ বছরের) টিকাগ্রহণে উদ্বুদ্ধ করা একটি বড় চ্যালেঞ্জ, যা সবার সম্মিলিত অংশগ্রহণ ছাড়া দুরূহ।
♦ স্ক্রিনিং
দেশে জাতীয় ক্যান্সার নিয়ন্ত্রণ কৌশল, কর্মপরিকল্পনা ও কর্মসূচি নেই।
নেই জাতীয় ক্যান্সার স্ক্রিনিং কর্মসূচী।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে স্তন, জরায়ুমুখ ও মুখগহ্বরের ক্যান্সার স্ক্রিনিং এমনকি উন্নয়নশীল দেশেও বাস্তবায়ন সম্ভব।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্যোগে ভায়া পরীক্ষাভিত্তিক জরায়ুমুখের ক্যান্সার স্ক্রিনিং এর কর্মসূচি চালু হয় ২০০৫ সালে। পরবর্তীতে সরকার এই উদ্যোগে অর্থায়ন করে। স্তন ক্যান্সার স্ক্রিনিং এর জন্য ক্লিনিক্যাল ব্রেস্ট এক্সামিনেশন অর্থাৎ চিকিৎসক দিয়ে স্তন পরীক্ষা পরে এর সাথে যুক্ত হয়েছে। বিভিন্ন পর্যায়ের প্রায় ৪০০ স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রে ভায়া সেন্টার চালু হয়েছে। চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীদের প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে।
১৫ বছরে এই কর্মসূচী লক্ষ্যমাত্রার ১০% এর নীচে সফলতা অর্জন করতে পেরেছে। এই নিম্নহারের প্রধান কারণ:
√ জাতীয় ক্যান্সার নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির আওতায় জাতীয় ক্যান্সার স্ক্রিনিং কর্মসূচী হিসেবে প্রনীত ও পরিচালিত না হওয়া
√ জাতীয় পর্যায়ের গুরুত্বপূর্ণ অংশীজনদের সম্পৃক্ত না হওয়া
√ প্রশিক্ষণ ও তত্ত্বাবধানসহ স্বাস্থ্যসেবার বিভিন্ন ধাপে বিকেন্দ্রীকরণ না করা
√ চিকিৎসাকেন্দ্রভিত্তিক অসংগঠিত স্ক্রিনিং থেকে দীর্ঘ ১৫ বছরে সমাজভিত্তিক সংগঠিত স্ক্রিনিং-এ উন্নীত করার জন্য পাইলট কার্যক্রম শুরু করতে না পারা
√ স্ক্রিনিং কেন প্রয়োজন, এটি যে ইনভেসিভ অর্থাৎ কাটাছেঁড়া বা কষ্টদায়ক কোন পরীক্ষা নয়, এসব বিষয়ে সাধারণ মানুষকে সচেতন ও উদ্বুদ্ধ করার যথেষ্ট উদ্যোগ না থাকা।
√ পেশাজীবি, স্বেচ্ছাসেবী জাতীয় ও স্থানীয় সংগঠনগুলোকে এই কাজে সম্পৃক্ত না করা
√ সর্বোপরি, স্ক্রিনিং যে কোন ক্লিনিক্যাল প্রোগ্রাম নয়, এটি একটি জনস্বাস্থ্য কর্মসূচি, কর্মসূচি প্রণয়ন ও পরিচালনার কোন পর্যায়ে এই বিষয়টি প্রতিফলিত না হওয়া।
♦ চিকিৎসা
দীর্ঘমেয়াদী ও ব্যয়বহুল চিকিৎসা ব্যয় নির্বাহ করা এই ক্যান্সারের অধিকতর ঝুঁকিপূর্ণ অস্বচ্ছল ও দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য দুঃসাধ্য। বেসরকারি হাসপাতাল অর্থনৈতিক নাগালের বাইরে। রাজধানীকেন্দ্রিক সরকারী চিকিৎসা তেমনিভাবে ভৌগোলিক নাগালের বাইরে। সারাদেশ থেকে আগত বিপুল সংখ্যক ক্যান্সার রোগীর দীর্ঘ অপেক্ষমান তালিকা তো আছেই।
আশার কথা, ৮টি বিভাগীয় শহরে ১০০ শয্যার পূর্ণাঙ্গ ক্যান্সার চিকিৎসা কেন্দ্র প্রতিষ্ঠার কাজ শুরু হয়েছে, আগামীকাল মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করবেন। আশা করা যায়, একনেকে অনুমোদিত ডিপিপিতে অন্তর্ভুক্ত ক্যান্সার প্রতিরোধ ও গবেষণাসহ ক্যান্সারের সাতটি বিশেষায়িত বিভাগ এখানে চালু হলে ক্যান্সার সেবা সাধারণ মানুষের নাগালের আনার একটি ধাপ অগ্রসর হবে।
জরায়ুমুখের ক্যান্সার নির্মূলের বৈশ্বিক লক্ষ্যমাত্রা অর্জনসহ দেশের সার্বিক ক্যান্সার সেবা উন্নয়ন সুষম ও সর্বজনীন করতে ব্যাপক আলোচনা, পর্যালোচনা, সকল অংশীজনের অংশগ্রহণ ও চলমান কার্যক্রমকে একটি জাতীয় ক্যান্সার নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির আওতায় এনে ঢেলে সাজানো দরকার।
সবাইকে ধন্যবাদ।
ডা. মোঃ হাবিবুল্লাহ তালুকদার রাসকিন
প্রধান সমন্বয়কারী
মার্চ ফর মাদার