শনিবার, ২১ ডিসেম্বর ২০২৪

শিল-পাটা

বৃহস্পতিবার, ফেব্রুয়ারী ৩, ২০২২
শিল-পাটা

আনোয়ারুল কাইয়ূম কাজল :

বাংলাদেশের গ্রাম বাংলার মানুষের বাড়ীতে হলুদ, মরিচ,আদা, রশুন, কিংবা নানা রকমের ভর্তা বানাতে ব্যবহার হতো শীল পাথরের পাটা। রান্নায় রসদ জোগানো বিভিন্ন মসলা মিহি বা গুড়া করার জন্য একসময় শিলপাটার বিকল্প বলতে কিছু ছিল না। প্রতিটি পরিবারে এ শিলপাটার ব্যবহার ছিলো ব্যাপক। আধুনিকতার ছোঁয়ায় ধীরে ধীরে হারাতে বসেছে শীলপাটার ব্যবহার। শীলপাটা বিকল্প হিসেবে এযুগের মানুষ ব্যবহার করছে বিভিন্ন আধুনিক ইলেক্ট্রনিক্স সামগ্রী। কেননা এযুগের মানুষ আধুনিকতায় ঝুকে পরছে। শীলপাটা দিয়ে বেটে খাওয়ার চাইতে আধুনিক ইলেক্ট্রনিক্স সামগ্রী দিয়ে সেসব জিনিস করে খাওয়া খুব সহজ।

সময়ের বিবর্তন ও আধুনিক প্রযুক্তির প্রবাহে ধীরে ধীরে কমতে থাকে শিলপাটার ব্যবহার। শিলপাটা এখন বিলুপ্তির পথে। কেবল মসলাই নয়, মেহেদি পাতা বাটা থেকে শুরু করে নানান ধরণের খাবারের ভর্তা বাটার কাজটিও সারা হতো শিলপাটায়। বর্তমানে বাসা-বাড়িতে শিলপাটার খুব একটা ব্যবহার চোখে না পড়লেও বিয়ে-শাদির অনুষ্ঠানে বাবুর্চির গ্রুপে আসা মহিলারা এসব অনুষ্ঠানের রান্নার মসলা শিলপাটাতেই বাটাবাটি করে থাকে। আর তাই এসব অনুষ্ঠানের খাবারের স্বাদই ভিন্ন।

শিলপাটা কী?
*********
শিলপাটা হচ্ছে দুই খণ্ড পাথর যা প্রধানতঃ রান্নাঘরে মশলা পেষার জন্য ব্যবহৃত হয়। পাটা ট্রাপিজয়েডাকার এবং মেঝেতে রাখা হয়। পাটার 
ওপর মশলা- যেমন শুকনো মরিচ, ধনিয়া, হলুদ, জিরা ইত্যাদি রেখে শিল দিয়ে  ডলা দিতে হয়। শিল একটি দীঘল পাথর খণ্ড, যা প্রস্থে কিঞ্চিৎ গোলাকার। দুই হাতে শিল আঁকড়ে ধরে পাটার ওপর মশলা পিষতে হয়। 

লোকসংস্কৃতি ও ঐতিহ্যবাহী গ্রামীণ শিল্প
*******************************
শিলপাটা শুধু মাত্র রান্নাঘরের জিনিস পত্র নয়। এটি হারিয়ে যাওয়া লোকসংস্কৃতি ও ঐতিহ্যবাহী গ্রামীণ শিল্প। একসময়  প্রতিনিয়ত দেখা মিলতো শিলপাটা ধারকাটা কারিগরদের হাঁক-ডাক ছাড়তে-ছাড়তে এ গাঁও সে গাঁও হেঁটে কাজের সন্ধানে। হাতুড়ি, ছেনি নিয়ে কারিগররা বিভিন্ন বাড়ির সামনে গিয়ে হাক-ডাক তুলতো  পাটা খোদাইবেন-ডেকছির কাছা লাগাইবেন  ইক্যাদি …’। 

শিল কাটা ও! শিল কাটা ও!! 
রবি ঠাকুর যখন খুব ছোট্ট তখনও, ছুটির দিনের অলস দুপুরে এরা হেঁকে যেত , "শিল কাটা"ও - বলে।  
আমাদের ছোট বেলায়ও এদের হাঁক শুনতে পেতাম , বিশেষ করে শুক্র শনিবারে তো এরা আসবেই। এক অদ্ভুত সুর তুলে লোকগুলি বাড়ি বাড়ি ঘুরে ঘুরে শিলপাটা কাটার কাজ করত। কাটতো মানে ছোট ছোট লোহার ছেনি, সরু একখণ্ড বাটালি এবং একটি ছোট হাতুড়ি দিয়ে ঠুকে ঠুকে শিলপাটার  উপরে মাছ, পাখি, লতা পাতা ইত্যাদির ডিজাইন ফুটিয়ে তুলতো।

শিল পাটার কারিগর-শিল্পী
*******************
শিলপাটা কাটার লোকজন, প্রত্যেকেই  ছিলেন শিল্পী মানুষ বা নান্দনিক ডিজাইনার, এরা বাড়ির সামনে  এলেই ছোটরা হৈ হৈ করে এসে এঁদের ঘিরে বসত। মুগ্ধ হয়ে বসে বসে দেখতো  তাঁদের হাতের কাজ। ছোট্ট হাতুড়ি আর ছেনি দিয়ে ঠুক ঠুক করে কিভাবে পাথরের গায়ে আস্তে আস্তে ফুটে উঠছে পাখি, মাছ কিংবা উদিত চাঁদ-সূর্য। শিলের মধ্যে অবশ্য কোন ডিজাইন করা হতো না, ঠুকে ঠুকে সারা শরীরটা খালি অমসৃণ করে দেওয়া হত। পাটার উপরে অর্ধচন্দ্রাকৃতি জায়গাটিতে চাঁদ , সুর্য,অাম,কাঁঠাল,নৌকা,ধানেরশীষ,গাছ,লতা-  পাতার ছবি করা হতো।
আর মাঝখানের বৃহত্‍ বর্গাকার অংশে পাখি, মাছ ইত্যাদির ছবি ফুটিয়ে তোলা হত। মাছের ডিজাইন, কেন জানিনা, বাচ্চাদের খুব পছন্দের বিষয় ছিল। পরে জানতে পারি মাছের নকশা ফুটিয়ে তোলাও আদতে ফার্টিলিটি কাল্টকেই নির্দেশ করে। মাঝখানের বড় বর্গাকার অংশের চারদিকে চারটি ত্রিভুজেও খোদাই করে বিভিন্ন চিত্র ফুটিয়ে তোলা হত।

কারিগরদের জীবিকার পথও  রুদ্ধ 
***************************
শিলপাটার ব্যবহার কমে যাওয়ার পাশাপাশি শিলপাটা ধারকাটা কারিগরদের জীবিকার পথও অনেকটা রুদ্ধ হয়ে পড়েছে। শিলপাটা ধারকাটা কারিগরদের অনেকেই এ পেশা ছেড়ে ভিন্ন পেশায় জীবিকা নির্বাহ করছে। আর যারা আছে তারা মানবেতর জীবনের সঙ্গে যুদ্ধ করে কোনরকমে টিকে রয়েছে।আগে পাটা খোদাই কাজের কদর ছিল এখন কমে গেছে। অনেকেই এ কাজ ছেড়ে যুগালী, ইট ভাঙার কাজ করছে। কেউ কেউ বাপ-দাদার এ পেশায় টিকে থাকলেও মানবেতর জীবন পার করছে।

নিম্নবিত্ত পরিবারে শিলপাটার ব্যবহার
******************************
মধ্যবিত্ত ও অভিজাত পরিবারে বাজারের প্যাকেট মসলা আর আদা, পেঁয়াজ, রসুন, জিরা পিষানোর জন্য ইলেকট্রনিক্স ব্ল্যান্ডার মেশিন শিলপাটার জায়গা দখল করে নিয়েছে। শিলপাটায় এক সময় মেহেদি পাতা বাটা হতো। আদা, হলুদ, মরিচ, ধনিয়া, জিরা, পেয়াজ বাটার জন্য শিলপাটা ছাড়া আর কোনো উপকরণ ছিলো না। শত ব্যস্ততায় ঘরের গৃহিণীরা চুলোয় রান্না শুরুর আগে শিলপাটায় মসলা বাটাবাটির কাজটি সেরে নিতেন। গ্রামে কি শহরে সবাই নির্ভরশীল ছিলো এই শীলপাটায়। প্রতিটি ঘরে শিলপাটার ব্যবহার ছিল সচল। আধুনিক যুগে থেকেও কিছু সংখ্যক মানুষ এখনো শীল পাথরের ব্যবহার ভুলে যাননি গ্রাম-গঞ্জে ও শহরের নিম্নবিত্ত পরিবারে এখনো শিলপাটার ব্যবহার রয়েছে।

সময়ের বিবর্তনে এখন রান্নায় প্যাকেটের গুঁড়ো মসলা জনপ্রিয় হয়ে ওঠেছে। শিলপাটায় মসলা বাটার কথা ওঠলে ভ্রু কুঁচকে ওঠেন গৃহিনীরা।
সবাই এখন নির্ভর করে বাজারের মেশিনের প্যাকেট মসলায় তাই আর এখন  শীলপাটার  তেমন প্রয়োজন হয় না। যে কারণে কারিগরদের জীবিকার পথও  হয়েছে রুদ্ধ, তাই হারিয়ে যাচ্ছে এ লোকসংস্কৃতি ও ঐতিহ্যবাহী গ্রামীণ শিল্প। 

লেখক : গবেষক ও গণমাধ্যমকর্মী। 



Somoy Journal is new coming online based newspaper in Bangladesh. It's growing as a most reading and popular Bangladeshi and Bengali website in the world.

উপদেষ্টা সম্পাদক: প্রফেসর সৈয়দ আহসানুল আলম পারভেজ

যোগাযোগ:
এহসান টাওয়ার, লেন-১৬/১৭, পূর্বাচল রোড, উত্তর বাড্ডা, ঢাকা-১২১২, বাংলাদেশ
কর্পোরেট অফিস: ২২৯/ক, প্রগতি সরণি, কুড়িল, ঢাকা-১২২৯
ইমেইল: somoyjournal@gmail.com
নিউজরুম ই-মেইল : sjnewsdesk@gmail.com

কপিরাইট স্বত্ব ২০১৯-২০২৪ সময় জার্নাল