মোঃ ইমরান মাহমুদ : ভাষা আন্দোলন, আইয়ুব বিরুধি আন্দোলন, ছয়দফা আন্দোলন ও মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেয়া বৃহত্তর ময়মনসিংহের আওয়ামী রাজনীতিবিদ আব্দুর রহমান সিদ্দিক। তাঁর জন্ম ১৯২৮ সালে জামালপুর জেলার মেলান্দহ উপজেলার ঘোষেরপাড়া ইউনিয়নের ছবিলাপুর গ্রামে। বাবার নাম আলহাজ মনির উদ্দিন আহামেদ। মায়ের নাম নসিমন খাতুন। তিনি ১৯৪৬ সালে বালিজুরি এফএম উচ্চবিদ্যালয় হতে মেট্রিক পাশ করে ময়মনসিংহের আনন্দ মোহন কলেজে ভর্তি হন। তার বড় ভাই ছিলেন গৌরীপুর রেলস্টেশনের স্টেশন মাস্টার, সেই সুবাদে গৌরীপুর এবং ময়মনসিংহ দুজায় গাতেই তিনি প্রগতিশীল রাজনীতি এবং সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডে জড়িয়ে পড়েন ।
১৯৪৮ সালে তিনি কলেজে তিনি খাদ্য নীতি বিরুধী আন্দোলনে অংশ নিয়ে সর্বপ্রথম জেলে যান। জেল থেকে ছাড়া পেয়ে তিনি নেত্রকোনায় আদিবাসীদের সাথে টঙ্ক বিরুধি আন্দোলনে জড়িত হন। এরপর তিনি জামালপুরে ফিরে “প্রবাহ সাহিত্য মজলিসে” যোগ দিয়ে ভাষা আন্দোলনে জোড়ালো ভুমিকা পালন করেন। ১৯৫২সনের ২২শে ফেব্রুয়ারি জামালপুর থেকে সিদ্দিকিসহ আট জন গ্রেপ্তার হন। জেল থেকে বের হয়ে তিনি ময়মনসিংহ জেলা আওয়ামীলীগের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে পরেন। ১৯৫৩ সনে আওয়ামীলীগের কেন্দ্রীয় কাউন্সিলের সময় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের সাথে সিদ্দিকি বিভিন্ন জেলা থেকে আগত অতিথিদের থাকা খাওয়াসহ দেখভালের দায়িত্ব পালন করেন যা বঙ্গবন্ধুর “অসমাপ্ত আত্মজীবনী” বইতে উল্লেখ আছে। ১৯৫৪ সালে তিনি আওয়ামী নেতৃতাধীন যুক্তফ্রন্ট প্রার্থীর পক্ষে নিজ এলাকায় ভূমিকা রাখেন । ১৯৫৫ সালে তিনি ময়মনসিংহ জেলা আওয়ামীলীগের প্রচার-সম্পাদক নির্বাচিত হন । এরপর কুখ্যাত আইয়ুব বিরোধী আন্দোলনে অংশ নেয়ায় তাকে ৯২(ক) ধারায় গ্রেপ্তার করে দেড় বৎসর জেলে আটকে রাখে । জেল থেকে বের হয়ে তিনি জেলা বিড়ি শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি নির্বাচিত হন ।
সিদ্দিকি ও হাতেম আলী তালুকদার , জেলার আওয়ামিলীগ নেতা মাওলানা আলতাব আলীর প্রকাশনায় “এই দুর্ভিক্ষে” নামে একটি পুস্তিকা প্রকাশ করেন, যার ফলে ততকালীন সামরিক শাষক তাদের নামে হুলিয়া জারি করেন। ১৯৫৮সালে আইয়ুব খান সামরিক শাসন জারি করলে প্রকাশ্যে রাজনীতিতে তিনি নিষিদ্ধ হয়ে যায় । সশস্ত্র যুদ্ধের মাধ্যমে দেশ স্বাধীন করার মানষে সিদ্দিকি, আলি আসাদ এবং আরএম সাইদ ইস্টবেঙ্গল লিবারেশন পার্টি গঠন করে প্রকাশ্য রাজনীতি নিষিদ্ধ থাকায় তিনি বিড়ি শ্রমিকইউনিয়নের কার্যক্রমের আড়ালে ইস্ট বেঙ্গল লিবারেশন পার্টির কার্যক্রম চালাতে থাকেন । ১৯৫৯সালের শেষের দিকে তিনি আলি আসাদ ও আরএম সাইদকে সাথে নিয়ে ভারত সরকারের সহযোগিতার প্রত্যাশায় ভারত গমন করেন। তৎকালিন পশ্চিম বঙ্গ কংগ্রেস নেতা সুরেন ঘোষের সহায়তায় প্রধানমন্ত্রী শ্রীনে হেরুর সাথে দেখা করেন । তারা ভারত থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতার দাবি সম্বলিত লিফলেট ছাপিয়ে আনেন, ফেরার পথে ভারতে অবৈধ অনুপ্রবেশের দায়ে ভারতীয় পুলিশের হাতে
গ্রেপ্তার হয়ে এক মাস জেল খাটেন । দেশে ফিরে দেখেন তাদের সবার নামে হুলিয়া জারি হয়েছে। তখন সিদ্দিকি ও আলি আসাদ ঢাকা চলে আসেন ।
লিফলেট বিভিন্ন জেলার রাজনৈতিক নেতা ও বারের সম্পাদকদের কাছে প্রেরন করেন। এ বিষয়ে বিস্তারিত আছে ১৯৮৭ সনের “সাপ্তাহিক বিচিত্রার ”বিজয় দিবস সংখ্যার প্রচ্ছদ প্রতিবেদনে । ১৯৬০ সনের শুরুর দিকে পল্টন মাঠের পার্শে গোপন বৈঠক চলাকালে সিদ্দিকি গ্রেপ্তার হন । দীর্ঘ কাল জেলে কাটিয়ে ১৯৬৩ সালের শেষের দিকে তিনি মুক্তি পান । এরপর দেশব্যাপী ঐতিহাসিক ছয় দফা আন্দলন শুরু হলে তিনি ঝাপিয়ে পড়েন । আন্দলনের মধ্যে ১৯৬৬সনের ৮ই মে বঙ্গবন্ধু গ্রেপ্তার হন, ৯ই মে গৌরীপুর থেকে সিদ্দিকি গ্রেপ্তার হন। ১১ই মে ময়মনসিংহ জেলা আওয়ামীলীগ এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বঙ্গবন্ধু , আব্দুর রহমান সিদ্দিকিসহ আওয়ামিলীগের সব নেতা কর্মীর মুক্তি দাবি করে আন্দোলন কর্মসূচি ঘোষণা করে । সারাদেশব্যাপী তীব্র আন্দলনের পর আইয়ুব সরকার ১৯৬৯ সালের ২২ ফেব্রুয়ারী বঙ্গবন্ধু, মনিসিং , সিদ্দিকিসহ ৩৪ নেতার মুক্তি দানের প্রেসনোট জারি করেন । তারা মুক্তি পান । মার্চের প্রথমপ সপ্তাহে ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ সিদ্দিকিসহ ৩৪ নেতাকে নাগরিক সংবর্ধনা দেন।
১৯৭০ সালে কেন্দ্রীয় নেতাদের সাথে মত বিরোধ হলে তিনি দলত্যাগ করে ভাষানী ন্যাপে যোগদান করেন এবং ময়মনসিংহ জেলা ন্যাপের সাধারন সম্পাদক নিযুক্ত হন । ১৯৭১এর মহান মুক্তিযুদ্ধে তিনি ভারতের আশ্রিত শরণার্থী শিবিরেও বাংলাদেশের মানুষকে অস্ত্র সহায়তা ও ট্রেনিং এর দাবিতে অনশন করেন । তিনি কলকাতা থেকে “সংগ্রামিবাংলা” নামে প্রত্রিকা পকাশ করে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে প্রচারণা চালান । সিদ্দিকি পত্রিকাটির প্রধান সম্পাদক ও প্রকাশ করেছিলেন।
পত্রিকাটির ঐতিহাসিক গুরুত্ব অনুধাবন করে জাতীয় জাদুঘর, শাহবাগ তা সংরক্ষন করেছেন । স্বাধীনতার পরও তিনি মানুষের অধিকার আদায়ের রাজনীতি করেছেন।
১৯৭৪ এর ভয়াবহ দুর্ভিক্ষের সময় লঙ্গর খানা খোলা ও খাদ্য দপ্তর ঘেরাও এর অপরাধে তিনি জামালপুর থেকে গ্রেপ্তার হন, এবং প্রায় একবছর তিন মাস জেলেকাটান । মেজর জিয়ার শাসনামলে ভাষানী ন্যাপ বিলুপ্ত করে প্রায় সবাই বিএনপিতে যোগদান করেন। কিন্তু সিদ্দিকি, তার রাজনৈতিক আদর্শ বিসর্জন না দিয়ে হাজি দানেশ, রাশেদ খান মেননদের সাথে প্রগতিশীল রাজনৈতিক দল গঠন করেন । ১৯৭৯ সনে তিনি আওয়ামীলীগ থেকে জামালপুর-৩ আসনে সংসদ সদস্য নির্বাচনে অংশ নেন।
১৯৮০সনের দিকে সিদ্দিকি রাজনীতি থেকে বিদায় নেন । রাজনৈতিক জীবনে সিদ্দিকি প্রায় ১২বৎসর জেলে কাটান । ১৯৯৩ সনের ১৬ ইঅক্টোবর তিনি মৃত্যু বরন করেন । তাকে নিজ গ্রাম ছবিলাপুরে সমাহিত করা হয়।
এমআই