মো. মাইদুল ইসলাম: 'মাগো, ওরা বলে সবার কথা কেড়ে নিবে। তোমার কোলে শুয়ে গল্প শুনতে দিবে না! বলো, মা তা কি হয়?' পাকিস্তানি হানাদাররা আমাদের কাছ থেকে বাংলা ভাষা কেড়ে নিতে চেয়েছিলো। তারুণ্যর শক্তির কাছে যেকোন কিছু হার মানতে বাধ্য। এদেশের তরুণেরা মাতৃভাষাকে রক্ষা করেছে। মায়ের ভাষার জন্য বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দিতে পিছপা হননি। গৌরবোজ্জ্বল মাতৃভাষা আন্দোলনের আজ ৭০ বছর পূর্ণ হলো। একুশে ফেব্রুয়ারির তাৎপর্যকে ধারণ করতে হলে ভাষা আন্দোলনের মূল চেতনা—অধিপত্যবাদবিরোধী চেতনা ও শক্তির দিকে আমাদের ফিরে তাকাতেই হবে। সেখানেই আমাদের মুক্তি নিহিত। একুশে মানেই ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারির আন্দোলন। একটি দিনকে কেন্দ্র করে পৃথিবীর ইতিহাসে এত আলোড়ন, লেখালেখি, সাহিত্য রচনা আর দ্বিতীয় দিন নিয়ে নেই। সালাম, জব্বার, শফিক, বরকত ও রফিকের প্রাণের বিনিময়ে অর্জিত এই বাংলা ভাষা ও ভাষা আন্দোলন নিয়ে বর্তমান তরুণদের ভাবনা ও প্রত্যাশা তুলে ধরেছেন সময় জার্নাল প্রতিবেদক।
ওমর আহমেদ অভ্র
ভাষা আন্দোলন সম্পর্কে যতই জেনেছি একজন বাংলাদেশী হিসেবে গর্ববোধ করেছি। আমি খুবই সৌভাগ্যবান কারণ মায়ের ভাষায় কথা বলবার জন্য যে জাতি পুষ্পাঞ্জলির মতই নিজের প্রাণকে সমর্পণ করেছিলেন, আমি সে জাতির একজন উত্তরসূরী। মায়ের ভাষার কি মহিমা। মায়ের ভাষার কি শক্তি! মায়ের ভাষার কি আবেগ! আমার কাছে একুশ মানে মাথা নত না করা। একুশ মানে শক্তি। একুশ মানে জয়।
ভাষা নদীর স্রোতের মতো বহমান। সময়ের সাথে ভাষা পরিবর্তনশীল। ভাষার পরিবর্তন খুবই স্বাভাবিক। কিন্তু খুব দুঃখ লাগে ভাষার সম্মান রক্ষা করবার জন্য প্রাণ দিয়েছেন যে জাতি সে জাতির উত্তরসূরী হিসেবে আমরা খুব বিশ্রীভাবে ভাষার সম্মান নষ্ট করছি, ভাষাকে অপমান করছি। অনর্থক বাংলা শব্দের সাথে বিদেশী শব্দ মিশিয়ে খিচুড়ি ভাষা চর্চা করছি। এভাবে সময়ের পর সময় বিদেশী শব্দের অবৈধ প্রবেশ করানোর ফলে কত কত বাংলা শব্দ যে হারিয়ে গিয়েছে তা অনুমান করার সাহস আমার নেই। আমি প্রতিটি ভাষাকে সম্মান করি। ভাষা চর্চাকে আমি উৎসাহিত করি। আমার আপত্তি কেবল অনর্থক মিশ্রণে। আমার বয়সীদের, বন্ধুদের দেখি বাংলায় কথা বলবার সময় ইংরেজি শব্দ ব্যবহার করে। এবং এতে তাদের মধ্যে কোন লজ্জাবোধ নেই, হীনমন্যতা নেই উল্টো কোথাও যেন একটা আনন্দ পান। কিন্তু কখনো তো এমনটা হয় না যে ইংরেজিতে কথা বলবার সময় বাংলা শব্দ ব্যবহার করে এমন আনন্দ পেয়েছে। বরং তখন লজ্জা পান। নিজের ভাষায় প্রতি এমন অসুস্থ আচরণ করে কি আনন্দ যে তারা পায় আমি জানি না। এসব দেখলে খুব কষ্ট লাগে। এই জন্যই কি ভাষা আন্দোলন করেছিলেন? এ কেমন ভাষা শহীদদের রক্তের প্রতিদান আমরা দিচ্ছি?
বাংলা ভাষায় অনেক শব্দের ব্যবহার কমে গিয়েছে, অনেক শব্দ হারিয়ে গিয়েছে। আমাদের উচিত সে শব্দগুলো খুঁজে বের করা। এবং সে শব্দগুলো চর্চা করা, ব্যবহার করা। সর্বোপরি নিজের ভাষাকে সম্মান করা। নিজের ভাষাকে অস্বীকার করে আধুনিক হওয়া যায় না। বরং নিজের ভাষাকে সম্মান করলেই আধুনিক হওয়া যায়। মীর মশাররফ হোসেনের একটি কথা বলে শেষ করছি, ❝মাতৃভাষায় যাহার ভক্তি নাই সে মানুষ নহে❞।
নিফাত সুলতানা মৃধা
ভাষা আন্দোলন আমাদের অস্তিত্বের সঙ্গে জড়িত। প্রতিবছরই ভাষা আন্দোলনের এই দিনটিকে ঘিরে আমাদের মধ্যে আবেগ কাজ করে। বেদীতে ফুল দিয়ে শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানানোর বিশেষ দিন হিসেবেই পালন করি আমরা৷ তবে পূর্বের তরুণ প্রজন্মের দেশের এবং সংস্কৃতির প্রতি টান ছিল প্রাকৃতিক। বর্তমানে অপ-সাংস্কৃতিক ও যন্ত্র নির্ভর তরুণ সমাজ কিছুটা হৃদয়গ্রাহী হচ্ছে না। তাই আমাদের ভাষার প্রতি টান বাড়ানো উচিত। বাংলা ভাষা, ইতিহাসকে রক্ষা করা উচিত।
মোঃ ইকবাল হোসেন
২১ আমার কাছে কোনো সংখ্যা নয়, এটি উজ্জীবিত এক বিস্ময় উদ্ভাবনার নাম। এটি একটি চেতনার প্রতীক বলে আমি মনে করি। ২১শে ফেব্রুয়ারী নিয়ে ভাবতে গেলে চলে যেতে হবে আজ হতে ৭০ বছর পূর্বে, ১৯৫২ সালের এই দিনে আমার বাংলার দামাল ভাইদের বুজের তাজা রক্তের ইতিহাসে গড়া আজকের এই ২১শে ফেব্রুয়ারী। আমি প্রত্যাশা করি, আমার ভাইয়ের ভাষা, মায়ের ভাষা যেন বিকৃত না হয়।
ভাষা আন্দোলন শুরু হয় ১৯৪৮ সালে, রাষ্ট্রের রাষ্ট্র ভাষা নিয়ে যখন পুরো পাকিস্তান উত্তাল তখন এই পূর্ব পাকিস্তানের দামাল ছেলেরা তাদের মায়ের ভাষা ছাড়া অন্য ভাষা মেনে নিতে পারেনি, তারা আন্দোলন গড়ে তুলে এবং ১৯৫২ সালের বুকের তাজা রক্ত ঢেলে বুলেটে প্রাণ দিয়ে নিজের বাংলা ভাষার স্বীকৃতি নেয়। আমার মনে হয় আমরা সফল কিন্তু কিছু কিছু মানুষ এখনো পাকিস্তানের এজেন্ডা বাস্তবায়নে কাজ করার চেষ্টা করছে। আমরা তরুণ প্রজন্ম তা মেনে নিবো না,গত ৭০ বছরেও তারা পারেনি আর ভবিষ্যতেও পারবেনা,আমরা তরুণরা সদা জাগ্রত।
দেশের সর্বক্ষেত্রেই তরুণদের ভূমিকা অপরিসীম, আমরা যদি দেশের সূচনা লঘ্ন দেখি সেখানেও তরুণদের ভূমিকা ছিলো, দেশের ক্লান্তিলঘ্নে আপোষহীনভাবে তরুণরা কাজ করে, প্রয়োজনে তারা নিজেদের প্রাণ বিসর্জন দেয়। তরুণরা ভাষার মান রক্ষার্থে, বাংলা ভাষায় কথা বলবে এবং সর্বক্ষেত্রেই যদি বাংলা ভাষাকে প্রাধান্য দেয় তাহলেই ভাষার মর্যাদা বৃদ্ধি পাবে বলে মনে করি।
আমি বলবো ২১ একটি চেতনা, পাকিস্থান থেকে পরাধীনতার নাম ঘুচানোর প্রথম ধাপ "২১"। আমরা ১৯৫২ সালের ২১ শে ফেব্রুয়ারী সফল হওয়ার পর আমাদের চেতনা বৃদ্ধি পায়। এর পরবর্তীতে দেশে বিভিন্ন আন্দোলন গড়ে তোলা হয় এবং পরাম্পরায় সফলতা ছুঁতে ছুঁতে ৭১ সনে মহান মুক্তিযুদ্ধ এর মাধ্যমে আমরা পাই স্বাধীন সার্বভৌমত্ব। আমি মনে করি আমার দেশ সৃষ্টিতে ২১শের অবদান রয়েছে এবং ১৯৭১ এর বীজ ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারিতেই রোপণ করা হয়েছিলো।
মাহমুদা হক মনিরা
২১ শে ফেব্রুয়ারি, দিনটির কথা মনে পড়লেই ভেতরে এক অদ্ভুত শিহরণ জাগে। ভাষার জন্য জীবন বাজি রাখার মতো ভাবনা সত্যি ভীষণ শক্ত। তারা শুধু ভাবনাতে নয়, কাজেও প্রমাণ করেছেন।
এখনো সেই সময়টা খুব মনে পড়ে, যখন ভোরে পচ্ছন্দের ফুল হাতে খালি পায়ে স্কুলের ছোট্ট শহীদ মিনারে যেতাম। সবাই একসাথে গেয়ে উঠতাম সেই চেনা গান- "আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি, আমি কি ভুলিতে পারি... "
আমাদের ভাষার গায়ে শহীদদের রক্তের দাগ আজীবন থেকে যাবে। সত্যিকার অর্থে তাদের তখনই সম্মান দেওয়া হবে যখন আমরা এই ভাষার সঠিক চর্চা করবো। আমাদের তরুণদের ভাষার সঠিক ব্যবহারেই আমাদের ভাষার সম্মান অক্ষুণ্ণ থাকবে, তাই আমাদেরকেই সচেতন হতে হবে।
জাহিদ হাসান রাকিব
১৯৫২'র ফেব্রুয়ারীতে রফিক, সালাম, বরকতদের তাজা রক্তের বিনিময়ে কথা বলার যে স্বাধীনতা আমরা অর্জন করেছিলাম তা আজ উচ্চারিত হচ্ছে বিকৃত সুরে। প্রতিনিয়তই হচ্ছে মায়ের ভাষার অপব্যবহার। আজ আমরা বাংলা বলতে পারি শুধুমাত্র ভাষা শহীদদের ত্যাগের বিনিময়ে। বাঙালি জনগণের ভাষা আন্দোলনের মর্মন্তুদ ও গৌরবোজ্জ্বল স্মৃতিবিজড়িত এই দিনে শপথ করি, "রক্তে কেনা বাংলা আমার লক্ষ শহীদের দান, এই ভাষারই দূষণ-মিশ্রণ-বিকৃতি করি যেন বর্জন৷"
শুধু আনুষ্ঠানিকতা নয়, ভাষার সৌন্দর্য ও গুরুত্ব আমাদের সকলকেই উপলব্ধি করতে হবে।
সময় জার্নাল/এমআই