শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪

নারী দিবসে মোনালিসার রহস্যময়তা

সোমবার, মার্চ ৭, ২০২২
নারী দিবসে মোনালিসার রহস্যময়তা

সৈয়দ মুন্তাছির রিমন:

জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের কবিতায় মানব সভ্যতা বিকাশে নারী-পুরুষের সমান অবদানের কথা বর্ণনা করেছেন-‘‘বিশ্বের যা কিছু মহান সৃষ্টি চির কল্যাণকর অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর। আর নারী মানে ব্যুৎপত্তি ইংরেজি ভাষায় "woman" শব্দটি প্রায় ১০০০ বছর আগের wīfmann থেকে এসেছে। যা পরে wīmmann থেকে wumman, ও অবশেষে আধুনিক বানান "woman" শব্দটি । প্রাচীন ইংরেজিতে, wīfmann মানে "নারী" (আক্ষরিক অর্থে "নারী-ব্যক্তি"), যেখানে ওয়ার মানে "পুরুষ"। আমাদের প্রতিটি সমাজ ব্যবস্থায় পুরুষের কাছে নারীর বাঁধাধরা কয়েকটি রূপ আছে। মা, বোন, স্ত্রী ও কন্যা। এর বাইরে যে কোন রূপী নারী তার কাছে আর সাধারণ নারী নন। তারা হয়ে যান পরনারী।

বিশ্বজুড়ে ৮ মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবস। এই দিবসে সব মেয়েদের সম্মান জানানো হয়। আজ নারীরা কারও উপরে নির্ভরশীল নয়। উল্টে তাঁদের উপরই দাঁড়িয়ে আছে পরিবার। আবার কখনও তাঁদের উপরেই নির্ভর করে পরিবার, সমাজ কিংবা কোনও দেশের ভাগ্য। বিশ্বজুড়ে নারীদের সম্মান জানাতে, তাঁদের যোগ্যতা ও মেধাকে কুর্নিশ জানাতে পালিত হয় আন্তর্জাতিক নারী দিবস। 

যেহেতু নারী দিবস। আর ১৮৩৭ খ্রিঃ ফরাসি দার্শনিক ও ইউটোপীয় সমাজবাদী চার্লস ফুরিয়ে প্রথম নারীবাদ শব্দটির আনুষ্ঠানিক ব্যবহার করেছিলেন বলে ধারণা করা হয়। নারীবাদ (feminism) এবং “নারীবাদী(feminist) শব্দ দুটি ফ্রান্স ও নেদারল্যান্ডসে প্রথম প্রকাশিত হয় ১৮৭২ এ, যুক্তরাজ্যে ১৮৯০ এ, এবং যুক্তরাষ্ট্রে ১৯১০ এ। সাধারণ ভাবে ফেমিনিজমের অর্থ হচ্ছে বিপ্লব। এটি এমন একটি বিপ্লব বা অঙ্গীকার। যা মানুষের জীবনকে ভালোবাসায় পূর্ণ করে দিতে চায়। এই দর্শন যা নারীর জন্য সবক্ষেত্রে পুরুষের সমান অধিকার ও স্বাধীনতাকে সমর্থন করে। এর মূললক্ষ্য হচ্ছে জেন্ডার ডিস্ক্রিমিনেশন উচ্ছেদ করা অর্থাৎ নারী পুরুষের মধ্যে সাম্যাবস্থা নিয়ে আসা।

আমরা অনেকেই মনেকরি যুগের হাওয়া বদলে গেছে। আধুনিক নারীর মনে কোনো ব্যথা নেই। কিন্তু আধুনিক সমাজেও আজ ওত পেতে বসে আছে ঘুণে ধরা মানুষ।  তাদের আদিম মানসিকতা দিন দিন নানা রকমের অবমাননাকর ও আপত্তিকর মন্তব্য করে বিষিয়ে তুলছে নারীর স্বাভাবিক জীবন। নারীর প্রতি সহিংসতা বন্ধ করতে হলে দূর করতে হবে নারী-পুরুষ বৈষম্য। পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতা সমূলেই উৎপাটন করতে হবে। প্রতিটা নারীকে সোচ্চার হতে হবে। আওয়াজ তুলতে হবে। প্রতিনিয়ত নিজের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে হবে লড়াই ও প্রতিবাদ করে।

বাংলাদেশের সমাজ ব্যবস্থায় নারীর অবস্থান প্রান্তিক। এই প্রান্তিকতা সৃষ্টি হয়েছে বিদ্যমান সমাজ কাঠামোতে নারীর অর্থনৈতিক অবস্থানের কারণে। নারীর অর্থনৈতিক অবদান অদৃশ্য হয়ে যায় কারণ তারা অধিকাংশ কাজকর্ম গৃহস্থালীতে সম্পন্ন করেন। নারীর গৃহশ্রমের অর্থনৈতিক মূল্য নির্ধারণ করা হয় না বলে তা জাতীয় আয়ে অন্তর্ভুক্ত হয় না। কৃষিতে নারীর প্রচুর অবদান থাকলেও নারীকে কৃষকের মর্যাদা দেয়া হয় না। নারীর কাজকে ঘরের কাজ ও মূল্যহীন কাজ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। শিল্প ও অন্যান্য কর্মক্ষেত্রে নারীর ব্যাপক হারে অংশগ্রহণ করছেন। কিন্তু দেখাযায় যে অর্থোপার্জনের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত থাকার পরও বাংলাদেশে নারীর সামাজিক অবস্থানের পরিবর্তন এখনও সম্ভব হয়নি। কর্মক্ষেত্রে নারী নানাবিধ নিপীড়ন ও নির্যাতনের শিকার হন। নারীরা ঘরে ও ঘরের বাইরে সন্ত্রাসের শিকার হচ্ছেন। এসিড নিক্ষেপ, হত্যা, ধর্ষণ, যৌন হয়রানি বৃদ্ধি পাচ্ছে। নারী নির্যাতনের বিষয়টি সঠিকভাবে বোঝার জন্য নারী-পুরুষ সম্পর্কে ক্রিয়াশীল নীতি-নৈতিকতা, মূল্যবোধ ও মতাদর্শের আলোকে বুঝতে হবে। বাংলাদেশে নারীর সামাজিক অবস্থান বদলের উদ্দেশ্যে নারী আন্দোলন বিচ্ছিন্নভাবে সংঘটিত হচ্ছে। কিন্তু নারী আন্দোলনের শক্তিশালী মতাদর্শিক ভিত্তি এখনো তৈরী হয়নি।

এই সমাজ ব্যবস্থার বেড়াজ্বালে আটকে পড়া নারীর প্রতি দৃষ্টি পরিবর্তনের কোন বিকল্প নেই। প্রস্প্রতি বিশ্বে সবচেয়ে আলোচনা-সমালোচনার জন্ম দিয়েছেন ভারতের এক নারী। যিনি তার সম্মান ও পবিত্রতা রক্ষা করতে গিয়ে প্রতিবাদী হয়ে উঠেন। তিনি ভারতের কর্নাটকের ছাত্রী মুসকান খান।  হিজাব পরে তার স্কুটি পার্ক করে ক্লাসের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলেন।  কিন্তু তখন বেশ কিছু মানুষ তাকে অনুসরণ করে। গেরুয়া রঙের স্কার্ফ পরিহিত একদল ব্যক্তি 'জয় শ্রী রাম' শ্লোগানে তার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে আর চিৎকার করছে। মুসকান তখন ভিড়ের দিকে ফিরে দু'হাত তুলে 'আল্লাহু আকবার' বলে চিৎকার করতে থাকেন। তার অপরাধ ছিল বোরকা পড়া ও নেকাপ পড়ে নিজেকে সামলে নেয়া। এই উপমহাদেশের নারীর প্রতি দৃষ্টি দুই ধরনের হয়ে থাকে। এক যখন কোন নারী পুরুষের নিজ পরিবারের সদস্য হয় তখন সম্মানের চোখে দেখে আর দুই অন্য নারীকে পুরুষ তার ভোগের পণ্য হিসেবে সম্মোধন বা দৃষ্টি স্থাপন করতে চায়। নারীকে পণ্য হিসেবে গড়ে ভোগ করতে চায়। আবার যারা দৃষ্টি দেয় তাদের মাঝেও বিভক্ত আছে এক শুভ বা সুস্থদৃষ্টি অন্যটি অসুস্থ দৃষ্টি। এই অসুস্থ দৃষ্টির কারনে নারীর প্রতি এতো সহিংসতা দেখা যায়। এই সমাজের সুস্থ দৃষ্টি নারীকে কিভাবে দেখতে চায়? কিংবা কিভাবে চললে পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের দৃষ্টি পরিবর্তন হতে পারে? 
নারী? তুমি কি সেই ছবি যা  শুধু পটে আকাঁ এক নারী। সংসারের বাহিরে সবাই এক রকম দেখবার প্রত্যাশা করে। ছবির মত সুন্দর স্থির, অচ ল, ছবির মত কাঁদেনা, হাসেও না ও অনুভূতিহীন। ছবির মত সংসারে চৌকানো ফ্রেমে বাধা। ছবির মত নারীর পটে বিবি হয়ে সেজে গুজে বসে থাকা। শুধুই সংসারের সৌন্দর্য্য বন্ধন করবে। কিন্তু সেই নারীর মধ্যে সুখ-দু:খের অনুভূতি গুলো প্রবল। সংসারের চৌকানো ফ্রেমের বাইরে বেরুবার জন্য আপ্রাণ যার প্রচেষ্ঠা। যে নারী কারও প্রচন্দের নয়। না সমাজের না সংসারের।

নারীকে হতে হবে মোনালিসার মত রহস্যময়ী এক ছবি। যে সব দিকই সামলাবে। মানে মোনালিসার ছবিকে যেমন মানুষ নিজের প্রচন্দ মত ব্যাখ্যা করে। যেমন কেউভাবে মোনালিসার মুচকি দুষ্টমী হাসি হাসছে, কেউ ভাবে আসলে মোনালিসা কান্না চেপে হাঁসছে। আবার ডেন্টিস্টরা ভাবেন মোনালিসার দাঁত গুলো আঁকা বাকা ছিল বলেই মোনালিসার হাসিটা এরকম। এর মধ্যে রহস্য-ফহস্য কিছু নেই। সব ধারনার সঙ্গেই নিরব মোনালিসা নিজেকে মানিয়ে নেয়, প্রতিবাদ করে না, ক্ষুব্ধ হয়না। সমাজও চায় প্রতিটি নারী হউক মোনালিসার ছবির মত রহস্যময় নীরব এক নারী। যে সব কিছুর সঙ্গে মানিয়ে নেয় নিজেকে। তার সম্পর্কে সব ব্যাখ্যাতেই সে সন্তুষ্ট থাকে। নারীকে কখনও পটে আঁকা ছবির ভূমিকায় নিরবে অভিনয় করে যেতে হয়। তাই কয়েকটি খুব পরিচিত নমুনা তুলে ধরলাম।
 নারী বাড়ীর লক্ষী। তাই তার রাগ থাকতেই নেই। বাড়ীর কর্তা, কর্তার মা বাবা সহ বয়োজ্যৈষ্ঠ আত্মী পরিজনের কটু কথা, রাগ বক্রোক্তিতেও তাকে স্থিরহাতে সংসার নামক নৌকার হাল ধরে রাখতে হবে এবং বিন্দু মাত্র বিচলিত  হলে চলবে না।

 নারী সাংসারিক কর্তব্য পালনে সামান্য অবহেলা হলে স্বামী তাকে ভুল দরিয়ে দিতে পারেন, রাগ করতে পারেন, ক্ষুদ্র হতে পারেন। কিন্তু একই কারণে স্ত্রী রাগ করতে বা ক্ষব্ধ হতে পারবে না। ক্ষুব্ধ হওয়া তার একতিয়ারের মধ্য পড়ে না। তিনি মানুষ নন। অতি মানবী। অতএব রাগ বা মেজাজ থাকতেই নেই। নারী তুমি চুপ থাক পুনঃবার মোনালিসা হয়ে যাও।

নারীকে এমন হতে হবে যেনো শ্বশুড় কুলের আত্মীয়রা যারা যেমন পছন্দ করে। সে তাকে ঠিক তেমনি ভাবে দেখতে পারে। ঐ মোনালিসার হাঁসির মত। হাঁসিটিকে যার যার দৃষ্টিভঙ্গি থেকে ব্যাখ্যা করে সবার সন্তুষ্ট থাকে। তেমনি নারী মোনালিসার মত বহুরূপী হতে হবে। যদি শ্বশুড়ালয়ের কারো আধুনিকা প্রচন্ড হয় তাহলে সে যেন মনে করতে পারে তুমি সত্যি আধুনিকা। আবার কারো শান্ত বউ পছন্দ হলে সে যেন তোমার মাঝে শান্ত রূপটাই আবিষ্কার করতে পারে। নারী আবার তুমি মোনালিসার মত হয়ে যাও। নিজেদের মত করে একটু মুচকি হাসো। যে যার পছন্দ মত এই হাসির ব্যাখ্যা করে নিবে।

নারীর মনে প্রতিহিংসা থাকতে পারে না। ধরুন একটি ছেলে তার পছন্দমত একটি মেয়েকে বিয়ে করে আনল। ছেলের বাড়ীর আত্মীয়রা সেই ছেলের সালাম গ্রহণ করল। অথচ ছেলের বউকে দেখলেই মুখ ঘুরিয়ে নিল। কিন্তু দুজনই একই অপরাধে অপরাধী। অথচ দোষী হবে নারী তাকে শত অপমান হজম করে ক্ষমাশীল হতে হবে। আর এত কিছুর পরও নিজের পরিবারে তাকে সুখী সুখী অভিনয় করে যেতে হবে। যেমন করে গেছে লিওনার্দো দ্যা ভিনজির মোনালিসা। কে জানে কত না বলা কষ্ট, কত দুঃখকে গোপন রেখেই রহস্যময় হাঁসি হাঁসতে হয়েছে তাকে। তাই তুমি আজ মোনালিসাকে অনুকরন বা অনুসরন কর। এই জগত সংসারের মানব গুলো মোনালিসার মতো তোমার মোহমায়ার রহস্য উদঘাটনে ব্যস্ত সময় কাটায়। তাই নারী পণ্য কিংবা বোঝা নয় বরং ফুল বাগানের মতো এই জগত, সংসার ও সমাজের সৌর্ন্দয। আর তাদের নিরাপত্তা, শান্তি ও সুখের ধরনি গড়ে দেয়া পুরুষ শাসিত সমাজ এবং রাষ্ট্রের দায়িত্ব।

লেখকঃ সাংবাদিক ও কলামিস্ট।
প্যারিস-ফ্রান্স।  


Somoy Journal is new coming online based newspaper in Bangladesh. It's growing as a most reading and popular Bangladeshi and Bengali website in the world.

উপদেষ্টা সম্পাদক: প্রফেসর সৈয়দ আহসানুল আলম পারভেজ

যোগাযোগ:
এহসান টাওয়ার, লেন-১৬/১৭, পূর্বাচল রোড, উত্তর বাড্ডা, ঢাকা-১২১২, বাংলাদেশ
কর্পোরেট অফিস: ২২৯/ক, প্রগতি সরণি, কুড়িল, ঢাকা-১২২৯
ইমেইল: somoyjournal@gmail.com
নিউজরুম ই-মেইল : sjnewsdesk@gmail.com

কপিরাইট স্বত্ব ২০১৯-২০২৪ সময় জার্নাল