শনিবার, ২১ ডিসেম্বর ২০২৪

প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চল নিয়ে চীন-অস্ট্রেলিয়ার প্রতিযোগিতা কেন?

বৃহস্পতিবার, জুন ২, ২০২২
প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চল নিয়ে চীন-অস্ট্রেলিয়ার প্রতিযোগিতা কেন?

আন্তর্জাতিক ডেস্ক:

চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই বর্তমানে প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে এক ম্যারাথন সফরে রয়েছেন যার উদ্দেশ্য এই অঞ্চলের দেশগুলোর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক তৈরির মাধ্যমে সেখানে বেইজিংয়ের প্রভাব বৃদ্ধি করা। টানা দশ দিন ধরে চীনের কোনো পররাষ্ট্রমন্ত্রীর একই অঞ্চলের এতোগুলো দেশ সফরে যাওয়াকে নজিরবিহীন ঘটনা হিসেবেই দেখা হচ্ছে।

বলা হচ্ছে, তার এই সফরের সময় ওই অঞ্চলের আটটি দেশের সঙ্গে চীন বাণিজ্য, কৌশলগত ও নিরাপত্তা সংক্রান্ত চুক্তি স্বাক্ষর করার ব্যাপারে আগ্রহ প্রকাশ করেছে। চীনের এই পরিকল্পনায় নড়েচড়ে বসেছে অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ড। তাদের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রও উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। এর পাশাপাশি চীনের সঙ্গে সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে তারা প্রশান্ত মহাসাগরীয় এই দ্বীপরাষ্ট্রগুলোকে সতর্ক করে দিয়েছে।

এর আগে সলোমন আইল্যান্ডসের সঙ্গে চীনের একটি চুক্তি স্বাক্ষরের খবর ফাঁস হয়ে যাওয়ার পর প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের নিরাপত্তা নিয়ে এই তিনটি দেশ গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে। তাদের আশঙ্কা এই চুক্তি অনুসারে চীন হয়তো সেদেশে সামরিক ঘাটি বিশেষ করে নৌঘাঁটি গড়ে তুলতে পারে। যদিও দু’টি দেশ এরকম কোনো উদ্দেশ্যর কথা অস্বীকার করেছে।

সলোমন আইল্যান্ডসের জন্য সবচেয়ে বড় দাতা দেশ অস্ট্রেলিয়া। এর আগে দেশটিতে যখন সামাজিক বিশৃঙ্খলা দেখা দিয়েছিল তখন দাঙ্গা দমনে অস্ট্রেলিয়া এই দ্বীপরাষ্ট্রে তাদের সৈন্য পাঠিয়েছিল।

টার্গেট যেসব দেশ
চীনা পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের যেসব দেশ সফর করছেন তার মধ্যে রয়েছে সলোমন আইল্যান্ডস, ফিজি, কিরিবাস, সামোয়া, টোঙ্গা, ভানুয়াতু, পাপুয়া নিউ গিনি এবং টিমোর লেস্ট।

বিশ্লেষকরা প্রশান্ত মহাসাগরীয় দেশগুলো ঘিরে চীনের এই পরিকল্পনাকে উচ্চাকাঙ্ক্ষী এক পরিকল্পনা বলে উল্লেখ করছেন, যার মধ্যে রয়েছে সাইবার নিরাপত্তা থেকে শুরু করে নিরাপত্তা সহযোগিতা বৃদ্ধি করা। বেইজিংয়ের এই পরিকল্পনা ধীরে ধীরে দৃশ্যমান হচ্ছে।

সংবাদদাতারা বলছেন, এসব চুক্তিতে এই অঞ্চলের দেশগুলোতে চীনের অর্থ সহায়তায় পুলিশ বাহিনীর প্রশিক্ষণের জন্য একাডেমি গড়ে তোলার পাশাপাশি সাংস্কৃতিক যোগাযোগ বৃদ্ধির কথাও বলা হয়েছে। এসবের পেছনে উদ্দেশ্য একটাই - প্রশান্ত মহাসাগরীয় দেশগুলোকে চীনের আরও কাছাকাছি নিয়ে আসা। অর্থাৎ উভয়পক্ষের মধ্যে রাজনৈতিক আস্থা বৃদ্ধি করা।

তবে বিবিসির ইভেট ট্যান জানাচ্ছেন, ওই অঞ্চলের বেশ কয়েকটি দেশ চীনের সঙ্গে এধরনের চুক্তি করতে অস্বীকৃতি জানানোর পর বেইজিংয়ের এই উদ্যোগ স্থবির হয়ে পড়েছে। সমঝোতার কিছু কিছু বিষয় নিয়ে এসব দেশের পক্ষ থেকে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে বলে তিনি জানাচ্ছেন।

চীনের কেন আগ্রহ
প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপগুলোর দিকে চীনের নজর দীর্ঘদিনের। গত কয়েক বছর ধরেই বেইজিং এসব দেশের সঙ্গে তাদের বাণিজ্যিক ও কূটনৈতিক তৎপরতা বৃদ্ধির চেষ্টা চালিয়ে আসছে।

অস্ট্রেলিয়ার একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠান লোয়ি ইন্সটিটিউটের এক হিসেবে দেখা গেছে, ২০০৬ সাল থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত চীন ওই অঞ্চলে প্রায় ১৫০ কোটি ডলার দিয়েছে বৈদেশিক সাহায্য হিসেবে, যা অনুদান এবং ঋণ হিসেবে দেওয়া হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এর পেছনে চীনের নানা ধরনের আগ্রহ কাজ করেছে।

লোয়ি ইন্সটিটিউটের একজন গবেষক মিহাই সোরা বিবিসি নিউজকে বলেছেন, ঐতিহাসিকভাবে দেখা গেছে যে সংঘাতের সময় রসদ সরবরাহ ও নিয়ন্ত্রণের ব্যাপারে প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চল ভৌগলিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।

তিনি বলেন, ‘প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে প্রভাব বিস্তার করতে পারার অর্থ হচ্ছে আপনার সঙ্গে রয়েছে পুরো একটি অঞ্চল। জাতিসংঘের মতো আন্তর্জাতিক কোনো জায়গায় ভোটাভুটির মাধ্যমে যখন কোনো বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় তখন হয়তো তারা আপনার প্রতি অনেক বেশি সহানুভূতিশীল হতে পারে।’

সোরা বলছেন, প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে চীনের এই আকাঙ্ক্ষার পেছনে একটি দীর্ঘমেয়াদী লক্ষ্যও রয়েছে। তিনি বলেন, এর মাধ্যমে তাইওয়ানের প্রতি আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক সমর্থন দুর্বল করাও চীনের একটি উদ্দেশ্য।

উদাহরণ হিসেবে বলা যেতে পারে যে গত কয়েক বছরে প্রশান্ত মহাসাগরীয় কয়েকটি দেশ কূটনৈতিকভাবে তাইওয়ানকে সমর্থন দেওয়া থেকে সরে গিয়ে চীনের পক্ষে চলে গেছে। এরকম দু’টি দেশ হচ্ছে- কিরিবাস এবং সলোমন আইল্যান্ডস।

মিহাই সোরা বলছেন, ‘সর্বশেষ কারণ সম্পদ: প্রশান্ত মহাসাগরীয় সম্পদের প্রধান ভোক্তা দেশ চীন এবং চীনের উন্নয়নের জন্য এসব অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তাই চীন যাতে এসব সম্পদ আরও সহজে পেতে পারে সেটাকেও বেইজিং অগ্রাধিকার দিচ্ছে।’

অস্ট্রেলিয়ার উদ্বেগ
তবে চীনের ক্রমবর্ধমান এই আগ্রহ অস্ট্রেলিয়া সরকারের জন্য উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। কারণ প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলকে অস্ট্রেলিয়া তাদের ব্যাকইয়ার্ড বা ‘বাড়ির পেছনের উঠোন’ বলে বিবেচনা করে থাকে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে চীনের প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা মোকাবিলা করার জন্য ক্যানবেরা সরকার ওই অঞ্চলের দেশগুলোতে সাহায্য তৎপরতা বৃদ্ধি করেছে।

এই দেশগুলোকে বলা হয় ‘প্রশান্ত মহাসাগরীয় পরিবার’ এবং এই পরিবারের সঙ্গে পুনরায় যোগাযোগ ও সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ করার উদ্দেশ্য অস্ট্রেলিয়ার সরকার ২০১৮ সালে ‘প্যাসিফিক স্টেপ-আপ’ নামে একটি নীতি গ্রহণের কথাও ঘোষণা করে।

একইসাথে চীনের ঋণ ও বিনিয়োগ মোকাবিলার জন্য অস্ট্রেলিয়াও এসব দেশগুলোকে অবকাঠামো খাতে বহু কোটি ডলারের অর্থ সাহায্য দিতে শুরু করে। তবে এবছরের শুরুর দিকে চীনের সঙ্গে প্রশান্ত মহাসাগরীয় দেশ সলোমন আইল্যান্ডসের একটি নিরাপত্তা চুক্তি স্বাক্ষরের পর অস্ট্রেলিয়া খুবই চিন্তিত হয়ে পড়ে। ক্যানবেরা সরকার এই সমঝোতার তীব্র সমালোচনা করে।

অস্ট্রেলিয়ার পূর্ব উপকূল থেকে ২ হাজার কিলোমিটার দূরে সলোমন আইল্যান্ডস। একারণে ক্যানবেরার পক্ষ থেকে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয় যে এই দ্বীপরাষ্ট্রটির সঙ্গে চীনের নিরাপত্তা চুক্তির ফলে প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চল অস্থিতিশীল হয়ে পড়বে।

শুধু তাই নয়, এই চুক্তিকে প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে ৮০ বছরের ইতিহাসে অস্ট্রেলিয়ার পররাষ্ট্র নীতি সংক্রান্ত ব্যর্থতা হিসেবে উল্লেখ করে তৎকালীন বিরোধীদল লেবার পার্টি সরকারের তীব্র সমালোচনা করে। গত সপ্তাহে অস্ট্রেলিয়ার নতুন পররাষ্ট্রমন্ত্রী পেনি উং-ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় দেশ ফিজি সফর করেন, একইসময়ে চীনা পররাষ্ট্রমন্ত্রীও ওই অঞ্চল সফরে বের হন।

এই দু’টি সফর ইঙ্গিত দেয় যে প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলকে কেন্দ্র করে চীন ও অস্ট্রেলিয়ার মধ্যে প্রতিযোগিতা বেড়েই চলেছে।

চুক্তি নিয়ে আপত্তি
বিশ্লেষকরা বলছেন, চীনের পরিকল্পিত এই চুক্তির ফলে এই অঞ্চলের ভারসাম্য বদলে যেতে পারে। তাদের অনেকে আশঙ্কা করছেন, এরকম চুক্তি হলে প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের দেশগুলোর সার্বভৌমত্ব ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।

এছাড়াও এই দেশগুলো ভূ-রাজনৈতিক কৌশলগত প্রতিযোগিতার মাঝখানে পড়ে যেতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। উল্লেখ করা যেতে পারে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় যেসব রক্তাক্ত যুদ্ধের ঘটনা ঘটেছে তার কয়েকটি হয়েছে এই প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে।

সংবাদদাতারা বলছেন, চীনের প্রস্তাবিত চুক্তির একটি খসড়া ফাঁস হয়ে গেছে যাতে দেখা যাচ্ছে দক্ষিণ প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে বেইজিং তার তৎপরতা উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি করছে। এসব তৎপরতার মধ্যে রয়েছে পুলিশ বাহিনীর প্রশিক্ষণের ব্যাপারে আর্থিক সহযোগিতা থেকে শুরু করে চীন ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় দেশগুলোর মধ্যে মুক্ত বাণিজ্য এলাকা গড়ে তোলা।

বিবিসির ইভেট ট্যান বলছেন, প্রশান্ত মহাসাগরীয় কিছু কিছু দেশ এই চুক্তির ব্যাপারে ক্রুদ্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে। মাইক্রোনেশিয়ার প্রেসিডেন্ট বলেছেন, চীনের এই প্রস্তাব ‘কুটিল’ এবং এর ফলে ‘সরকার ও অর্থনীতির ওপর চীনের প্রভাব নিশ্চিত হবে।’

ড. পাওয়েলস বলছেন, ‘ফিজি, সামোয়া, মাইক্রোনেশিয়া, নিউয়ে এবং পালাও যেসব বিবৃতি দিয়েছে তাতে এটা পরিষ্কার যে প্রস্তাবিত চুক্তিকে ঘিরে ঐক্যমত্যের অভাব রয়েছে।’

বলা হচ্ছে এই উদ্বেগের কারণেই প্রশান্ত মহাসাগরীয় অনেক দেশ চীনের সঙ্গে এমন একটি চুক্তিতে স্বাক্ষর করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে।

অস্ট্রেলিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী পেনি উং-এর সফর এবং প্রশান্ত মহাসাগরীয় দেশগুলোতে অস্ট্রেলিয়ার প্রভাব ধরে রাখার চেষ্টার কারণেই কি এমনটা হয়েছে? অস্ট্রেলিয়ার গ্রিফিথ ইউনিভার্সিটির শিক্ষক ড. টেস নিউটন কেইন মনে করেন, প্রশান্ত মহাসাগরীয় দেশগুলোর সম্মিলিত তৎপরতার কারণেই- চীনের প্রস্তাবিত চুক্তি অগ্রসর হতে পারেনি।

অনেক বিশ্লেষক মনে করেন, চুক্তিটিকে ঘিরে প্রশান্ত মহাসাগরীয় দেশগুলোর মধ্যে যে উদ্বেগ তৈরি হয়েছে সে বিষয়ে বেইজিং তাদের আশ্বস্ত করতে পারেনি।

এখন কী হবে?
ড. পাওয়েলস মনে করেন আঞ্চলিক পর্যায়ে চীনের কূটনৈতিক চেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে। কিন্তু তিনি মনে করেন চীন এখন এসব দেশগুলোর সঙ্গে তাদের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক অনেক গুণে বৃদ্ধি করবে।

প্রস্তাবিত চুক্তিটি সই হচ্ছে না - এই খবর প্রকাশিত হওয়ার পর চীন তার অবস্থান তুলে ধরে একটি বিবৃতি দিয়েছে যাতে বলা হয়েছে প্রশান্ত মহাসাগরীয় দেশগুলোর সঙ্গে ‘কৌশলগত অংশীদারিত্ব আরও গভীর করার ব্যাপারে চীন প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।’

বিশ্লেষকরা বলছেন, চীনের এই অবস্থান তুলে ধরার অর্থ হচ্ছে- প্রশান্ত মহাসাগরীয় পরিবারে চীনের প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা অব্যাহত থাকবে এবং এই লক্ষ্যে তারা এই দেশগুলোর সঙ্গে তাদের আলাপ আলোচনা চালিয়ে যাবে। এবং দীর্ঘ মেয়াদে ওই অঞ্চলে নিরাপত্তা বিষয়ক প্রভাব বিস্তারের আকাঙ্ক্ষা চীনের রয়েই যাবে।

সূত্র : বিবিসি বাংলা

এমআই 


Somoy Journal is new coming online based newspaper in Bangladesh. It's growing as a most reading and popular Bangladeshi and Bengali website in the world.

উপদেষ্টা সম্পাদক: প্রফেসর সৈয়দ আহসানুল আলম পারভেজ

যোগাযোগ:
এহসান টাওয়ার, লেন-১৬/১৭, পূর্বাচল রোড, উত্তর বাড্ডা, ঢাকা-১২১২, বাংলাদেশ
কর্পোরেট অফিস: ২২৯/ক, প্রগতি সরণি, কুড়িল, ঢাকা-১২২৯
ইমেইল: somoyjournal@gmail.com
নিউজরুম ই-মেইল : sjnewsdesk@gmail.com

কপিরাইট স্বত্ব ২০১৯-২০২৪ সময় জার্নাল