মঙ্গলবার, ০৩ ডিসেম্বর ২০২৪

নেই খাদ্য,বাসস্থান,চিকিৎসা কষ্টে আছেন তারা

সুনামগঞ্জে বন্যা সিলেটও প্রায় বিচ্ছিন্ন, অসহায় মানুষ

শনিবার, জুন ১৮, ২০২২
সুনামগঞ্জে বন্যা সিলেটও প্রায় বিচ্ছিন্ন, অসহায় মানুষ

সময় জার্নাল ডেস্ক: সিলেট-সুনামগঞ্জে স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যায় মানবিক বিপর্যয় নেমে এসেছে। গ্রাম কী শহর-সবই পানিতে একাকার। সিলেট রেলওয়ে স্টেশন, ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর, ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, বিদ্যুৎকেন্দ্রসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায়ও পানি ঢুকে পড়েছে।
এমনকি কয়েকটি আশ্রয়কেন্দ্রেও পানি প্রবেশ করেছে। নানা জায়গায় সড়ক-সেতু ভেঙে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। ওসমানী বিমানবন্দরে ফ্লাইট ওঠানামা বন্ধ। রেললাইন ডুবে যাওয়ায় কয়েকটি স্থানে রেল যোগাযোগও বন্ধ হয়ে গেছে।

সিলেটে এমন এমন জায়গায় পানি উঠেছে, যেখানে গত ৬০ বছরেও কখনো পানি উঠেনি। দুই জেলার প্রায় ৪০ লাখ মানুষ পানিবন্দি। অনেকের ঘরে খাবার নেই। বিশুদ্ধ পানি নেই। দুদিন ধরে বিদ্যুৎ সংযোগও বিচ্ছিন্ন।

ফলে সন্ধ্যা নামতেই গোটা অঞ্চলে ভূতুড়ে পরিবেশ তৈরি হয়। নেই মোবাইল নেটওয়ার্ক। ইন্টারনেট সেবাও বন্ধ। মোমবাতি আর জ্বালানি তেলের সংকটে অনেক বাসায় জ্বলেনি আলোও। এর মধ্যে টানা বৃষ্টি আর ক্ষণে ক্ষণে বজ পাত।

নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে আর্তনাদ করছেন মানুষ। অনেকে পানি-স্রোত ভেঙে ছুটছেন। সবচেয়ে বিপদে আছে শিশু ও বয়স্করা। আটকে পড়াদের উদ্ধারে কাজ করছেন সেনা, নৌবাহিনী, বিজিবি ও কোস্টগার্ডের সদস্যরা। এতে বিমানবাহিনীর ৪টি হেলিকপ্টার যুক্ত করা হয়েছে। এছাড়া ফায়ার সার্ভিসের সব ছুটি বাতিল করে সদস্যদের মাঠে রাখা হয়েছে। 

বানভাসি মানুষ জানিয়েছেন, সারা দেশের সঙ্গে সুনামগঞ্জ জেলার যোগাযোগ স্থাপনকারী সিলেট-সুনামগঞ্জ সড়ক তলিয়ে যাওয়ায় বৃহস্পতিবার থেকে পুরো জেলা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। জেলার সঙ্গে উপজেলা সদরের সড়কগুলোও ডুবে যাওয়ায় প্রতিটি উপজেলা এখন কার্যত বিচ্ছিন্ন। ভেসে যাচ্ছে গবাদি পশু, পুকুরের মাছ। নষ্ট হচ্ছে মৌসুমি ফসল। 

সিলেটের জেলা প্রশাসক মজিবর রহমান বলেন, পর্যাপ্ত আশ্রয়কেন্দ্র প্রস্তুত রয়েছে; কিন্তু উদ্ধার করে নিয়ে আসার মতো পর্যাপ্ত যানবাহন নেই। এমতাবস্থায় পানিবন্দি মানুষকে উদ্ধারে সেনাবাহিনীর পাশাপাশি নৌবাহিনীর বোট ও ডুবুরি দল যোগ দিয়েছে।

সেনাবাহিনীর ১৭ পদাতিক ডিভিশন, সিলেট সেনানিবাসের প্রধান মেজর জেনারেল হামিদুল হক বলেন, আটটি উপজেলায় আমরা সেনা মোতায়েন করেছি। সেনা সদস্যরা পানিবন্দি মানুষকে উদ্ধার করে নিরাপদ স্থানে নেওয়া, বেসামরিক প্রশাসনের সহায়তায় অস্থায়ী আশ্রয়কেন্দ্র নির্বাচন এবং উদ্ধারকৃতদের থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করা, চিকিৎসা সহায়তা দেওয়া, খাদ্য গোডাউন, পাওয়ার স্টেশন এবং অন্যান্য স্থাপনা রক্ষায় কাজ করছে। এছাড়া সীমিত পরিসরে খাদ্য ও সুপেয় পানি সরবরাহে কাজ করছে। 

সিলেটের বিভাগীয় কমিশনার মুহাম্মদ মোশাররফ হোসেন বলেছেন, সিলেট ও সুনামগঞ্জের ১২ উপজেলায় বন্যা পরিস্থিতি সবচেয়ে খারাপ। এসব এলাকায় আমরা সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছি।

সিলেট দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ শাখা জানিয়েছে, ১৭ লাখ ৫০ হাজার টাকা, ৭ হাজার ৯০০ বস্তা শুকনো খাবারের প্যাকেট বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। মন্ত্রণালয় আরও ৮ হাজার প্যাকেট খাবার ও ৩০ লাখ টাকা বরাদ্দ দিয়েছে। 

এদিকে সিলেট-সুনামগঞ্জ ছাড়াও দেশের আরও অন্তত ১২ জেলার নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। এসব জেলায় বন্যায় ৬ জনের মৃত্যু হয়েছে। 

সিলেট ও সুনামগঞ্জ : বন্যার পানি উঠেছে হাসপাতাল, কলেজ, বাসাবাড়ি, আড়ত, দোকানপাটে। নগরীর মাছিমপুর, ছড়ারপাড়, শাহজালাল উপশহর, তেরোরতন এলাকা ডুবে আছে তিন দিন ধরে।

সোবহানীঘাট, মেন্দিবাগ, নাইওরপুল, মিরাবাজার, টিলাগড়, শেখঘাট, তালতলা, মাছুদীঘির পাড়, জামতলা, মির্জাজাঙ্গাল, বন্দরবাজার, জিন্দাবাজার, দাড়িয়াপাড়া এলাকার রাস্তাঘাট ডুবে আছে।

তিন দিন ধরে পানিবন্দি নগরীর যতরপুরের বাসিন্দা রাবেয়া আক্তার বলেন, বাসা পানিতে ডুবানো, দুটি এতিম বাচ্চা নিয়ে একটি ভবনের ছাদে আছি। কিন্তু কেউ একটু খবরও নিল না। কোথায় থাকি, কী খাই। তিনি বলেন, বাচ্চারাসহ আমি গত বন্যায় ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়েছিলাম দুর্গন্ধযুক্ত পানি খেয়ে। এবারও খাবার নেই, পানি নেই। 

মাছিমপুরে পানিবন্দি রমেন্দ্র সিংহ বাপ্পা বলেন, আর কদিন পানিতে থাকতে হবে জানি না। কষ্ট বেশি হয়ে যাচ্ছে, তাই বৃদ্ধ ও শিশুদের অন্যত্র পাঠিয়ে আমি ঘর পাহারায় আছি। 

বিভিন্ন সূত্রে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, সুনামগঞ্জ শহরের অধিকাংশ বাসার চুলা পানির নিচে তলিয়ে যাওয়ায় রান্নাবান্না বন্ধ আছে। ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় সংকট আরও বেড়েছে। এ অবস্থায় শহরে খাদ্যসংকট তৈরি হয়েছে। বিশুদ্ধ পানিও পাওয়া যাচ্ছে না। টানা বৃষ্টিপাত আর পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় বানভাসি মানুষের আশঙ্কা আরও বাড়ছে। 

ছাতক ও দোয়ারাবাজার উপজেলার বন্যাকবলিত দুই ব্যক্তি জানিয়েছেন, যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ায় প্রসূতি ও অসুস্থ ব্যক্তিদের ভোগান্তি বেড়েছে। পানি ক্রমাগত বাড়ছে। অনেক বাড়িতেই কোমরসমান পানি। মানুষ আতঙ্কে আছে। আপাতত জীবন রক্ষার জন্য মানুষ নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে প্রাণান্তকর চেষ্টা করছে।

আবহাওয়া অধিদপ্তরের আবহাওয়াবিদ শাহনাজ সুলতানা জানান, আগামী তিন দিন সিলেট বিভাগে আরও বৃষ্টি হবে। ভাঙতে পারে অতীতের সব রেকর্ড। এতে বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি হতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। 

বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন : বিদ্যুৎ স্টেশনগুলোয় পানি প্রবেশ করায় সুনামগঞ্জে তিন দিন ধরে বিদ্যুৎ নেই। সিলেটে বন্যাকবলিত বিভিন্ন উপজেলায় শুক্রবার থেকে বিদ্যুৎ সংযোগ বন্ধ রয়েছে। এছাড়া সিলেট শহর এলাকায় প্রধান গ্রিড পানিতে ডুবে যাওয়ায় শনিবার টানা ৬ ঘণ্টা বিদ্যুৎহীন ছিল সিলেট ও সুনামগঞ্জ।

সন্ধ্যা ৬টায় গ্রিড চালু করা হলে কিছু এলাকায় বিদ্যুৎ সংযোগ স্বাভাবিক হয়। বিদ্যুৎ না থাকায় স্থানীয়রা মোমবাতি ও কেরোসিন তেলের বাতি জ্বালাচ্ছেন। কিন্তু এ দুটিরও সংকট দেখা দিয়েছে। তাছাড়া বিভিন্ন সড়কে পানি ওঠায় ঘর থেকেই বের হতে পারছেন না মানুষ।

তাই বাজারে গিয়ে মোমবাতি বা তেল সংগ্রহও কঠিন হয়ে পড়েছে। সিলেট সদরের সঙ্গে সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন কোম্পানীগঞ্জ আর গোয়াইনঘাটের। নগরীতে ৩৬টিসহ জেলায় মোট ৪৭৩টি আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে। 

বিদ্যুৎ বিভাগ সিলেটের প্রধান প্রকৌশলী আব্দুল কাদের জানান, সাকার মেশিন দিয়ে পানি সেচে সেনাবাহিনীর বিশেষ উদ্যোগে বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি সন্ধ্যায় চালু করা গেছে। তবে বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হচ্ছে গুটি কয়েক এলাকায়।

বন্যার পানিতে বিদ্যুতের সাব-স্টেশনগুলো ডুবে যাওয়ায় জ্বালানি গ্যাস ও তেল বিক্রি বন্ধ থাকে পাম্পগুলোতে। তাছাড়া অফিস-আদালতসহ বিভিন্ন দপ্তর জেনারেটর নির্ভর হয়ে পড়েছে। এ সময় জ্বালানি তেল ১০-২০ টাকা বেশি দরে খোলাবাজারে বিক্রি করেন অসাধু ব্যবসায়ীরা।

জিন্দাবাজারের অফিসকর্মী রুবেল মিয়া বলেন, পাম্পে তেল বিক্রি বন্ধ ছিল তাই খোলাবাজার থেকে প্রতি লিটারে ১০ টাকা দরে কিনেছি। 

বন্যার্তদের উদ্ধার তৎপরতা : বন্যাকবলিত এলাকার মানুষকে উদ্ধার করে আশ্রয়কেন্দ্রে নিয়ে আসাই এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ভুক্তভোগী অনেকেই বলছেন, তারা ত্রাণের আগে চান নিরাপদ আশ্রয়।

কিন্তু দুর্গত এলাকা থেকে মানুষকে আশ্রয়কেন্দ্রে নিয়ে আসার জন্য পর্যাপ্ত নৌকা-ভেলা নেই। সিলেট ও সুনামগঞ্জে বন্যাদুর্গত এলাকায় পানিবন্দি লোকজনকে উদ্ধারে শুক্রবার বিকাল থেকে সেনাবাহিনীর ১০ প্লাটুন, ৬টি মেডিকেল টিম কাজ শুরু করে। শনিবার সকাল থেকে নৌবাহিনীর ৩৫ সদস্য দুটি টিমে ভাগ হয়ে কাজ শুরু করেছে। 

জেলা প্রশাসন সূত্র জানায়, নৌবাহিনীর ৩৫ সদস্যের একটি দল শুক্রবার রাতে সিলেট এসে পৌঁছায়। শনিবার সকাল থেকে ৩৫ সদস্যের দল কোস্টগার্ডের একটি ক্রুজ ও বিমানবাহিনীর চারটি হেলিকপ্টার দিয়ে উদ্ধার কাজ শুরু করে।

সিলেট সদর উপজেলার জালালাবাদ ইউনিয়নে একটি টিম সকাল থেকে কাজ শুরু করে। আরেকটি টিম কোম্পানীগঞ্জে কাজ শুরু করেছে। বিকালে নৌবাহিনীর আরও ৬০ সদস্যের একটি দল সিলেট এসেছে। তারা আরও দুটি ক্রুজ নিয়ে উদ্ধার কাজে যোগ দেন। 

সেনাবাহিনীর উদ্ধারকারী টিমের মোবাইল নাম্বার : বানভাসি মানুষদের উদ্ধারে নিয়োজিত সেনাবাহিনীর টিমের মোবাইল নাম্বার সরবরাহ করেছে র‌্যাব-৯। সিলেট ও সুনামগঞ্জের দুর্গত উপজেলাগুলোর মানুষ এ নাম্বারগুলোতে যোগাযোগ করতে পারবেন।

উদ্ধার কাজের দায়িত্বপ্রাপ্তরা হলেন-মেজর আশিক, দিরাই-জামালগঞ্জ, সুনামগঞ্জ। মোবাইল : ০১৭৬৯-০০৮৭৩৬। মেজর আশাবুর, ছাতক-দোয়ারাবাজার, সুনামগঞ্জ। মোবাইল : ০১৭৬৯-১৭২৪৫৪। মেজর মোক্তাদির, কুমারগাঁও পাওয়ার স্টেশন, সিলেট।

মোবাইল : ০১৭৬৯-১১২৫৫৬। ক্যাপ্টেন মারুফ, কোম্পানীগঞ্জ, সিলেট। মোবাইল : ০১৭৬৯-০০৯৩৮২। ক্যাপ্টেন আশরাফ, গোয়াইনঘাট, সিলেট। মোবাইল : ০১৭৬৯-১৭২৫৬৪। ক্যাপ্টেন ফয়সাল, সিলেট সদর উপজেলা। মোবাইল : ০১৬২৬-২৯১৫৭৭। 

সব ফায়ার স্টেশনের কর্মকর্তা-কর্মচারীর ছুটি বাতিল : সিলেটের ভয়াবহ বন্যায় উদ্ধার তৎপরতা ও মানবিক সহায়তায় কাজ করছে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সও। কেন্দ্রীয়ভাবে ঢাকায় খোলা হয়েছে মনিটরিং সেল।

জরুরি পরিস্থিতি মোকাবিলায় সিলেটের সব ফায়ার স্টেশনের কর্মকর্তা-কর্মচারীর ছুটি বাতিল করে সবাইকে স্ট্যান্ডবাই রাখা হয়েছে। ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্সের মিডিয়া শাখার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা শাহজাহান সিকদার বলেন, সিলেট সদরের খাদ্য গুদামে ঢুকে পড়া পানি নিয়মিতভাবে পাম্পের মাধ্যমে সেচের কাজ করছে ফায়ার সার্ভিসের দুটি ইউনিট।

এছাড়া বিপর্যয়ের মুখে থাকা কুমারগাঁও বিদ্যুৎ উপকেন্দ্রেও নিয়োজিত করা হয়েছে ফায়ার সার্ভিসের দুটি ইউনিট। সেখানেও তারা পানি সেচের কাজ করছে। তিনি জানান, সিলেটে জেমিনি বোট পাঠানো হয়েছে। জেমিনি বোটের সাহায্যে বিভিন্ন স্থানে আটকে পড়া লোকদের উদ্ধার করে আশ্রয়কেন্দ্রে নেওয়ার কাজ শুরু করেছে ফায়ার সার্ভিস।

এসএম


Somoy Journal is new coming online based newspaper in Bangladesh. It's growing as a most reading and popular Bangladeshi and Bengali website in the world.

উপদেষ্টা সম্পাদক: প্রফেসর সৈয়দ আহসানুল আলম পারভেজ

যোগাযোগ:
এহসান টাওয়ার, লেন-১৬/১৭, পূর্বাচল রোড, উত্তর বাড্ডা, ঢাকা-১২১২, বাংলাদেশ
কর্পোরেট অফিস: ২২৯/ক, প্রগতি সরণি, কুড়িল, ঢাকা-১২২৯
ইমেইল: somoyjournal@gmail.com
নিউজরুম ই-মেইল : sjnewsdesk@gmail.com

কপিরাইট স্বত্ব ২০১৯-২০২৪ সময় জার্নাল