ইসাহাক আলী, নাটোর:
নাটোরের লালপুর ও বাগাতিপাড়ায় উপজেলা আওয়ামীলীগের ত্রি-বার্ষিক কাউন্সিল সম্পন্ন হলেও চলছে নানা আলোচনা সমালোচনা। বুধবার লালপুর উপজেলা আওয়ামীলীগের সম্মেলন স্থলে সাধারণ সম্পাদক হিসাবে রোকোনুল ইসলাম লুলুর নাম ঘোষনার পর রাতে তা পরিবর্তন করে শামীম আহমেদ সাগরকে সাধারণ সসম্পাদক করে জেলা আওয়ামীলীগের সাধারণ সম্পাদক স্বাক্ষরিত আরেকটি কমিটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। তবে এটাকে গণতন্ত্র বিরোধী সিদ্ধান্ত হিসাবে
আ্যখা দেন লুলু।
এছাড়া মঙ্গলবার একাংশের বর্জনের মধ্যদিয়ে অনুষ্ঠিত কাউন্সিলে নির্বাচিত সভাপতি নুরুল ইসলাম ঠান্ডুর বিরুদ্ধে গত বছরের নভেম্বর মাসে অনুষ্ঠিত স্থানীয় সরকার নির্বাচনে নৌকার প্রার্থীর বিরোধীতা করার অভিযোগ উঠেছে। যদিও তা অস্বীকার করেন তিনি।
জানা যায়, প্রায় ৮ বছর পর বুধবার লালপুর ডিগ্রি কলেজ মাঠে লালপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের ত্রিবার্ষিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সম্মেলনে সভাপতি পদে ১২ জন ও সাধারণ সম্পাদক পদে ১৪ জন প্রার্থী হন। সম্মেলনের সকালে প্রথম অধিবেশনের পর বিকালে দ্বিতীয় অধিবেশনে আগের কমিটি বিলুপ্ত ঘোষণা করা হয়। এরপর নতুন কমিটি গঠনের জন্য দফায় দফায় প্রার্থীদের সঙ্গে জেলা ও কেন্দ্রীয় নেতারা আলোচনা করেন। পরে এক পর্যায়ে বিকেল চারটার দিকে সম্মেলনের প্রধান অতিথি আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও রাজশাহী সিটি করপোরেশনের মেয়র এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন সভাপতি হিসেবে আফতাব হোসেন ঝুলফু, সাধারণ সম্পাদক হিসেবে রোকোনুল ইসলাম লুলু ও যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক পদে শামীম আহমেদের নাম ঘোষণা করেন। প্রধান অতিথির জনসংযোগ কর্মকর্তা মুস্তাফিজ মিশুর সরবরাহ করা সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতেও সাধারণ সম্পাদক হিসেবে রোকোনুল ইসলামের নাম উল্লেখ করা হয়।
পরে বুধবার রাত ১১টার পর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শরিফুল ইসলাম রমজান স্বাক্ষরিত ঘোষণাপত্রে শামিম আহমেদ সাগরকে সাধারণ সম্পাদক ও যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক পদে আমিনুল ইসলামকে নতুন দায়িত্ব দেওয়া হয়। রাতেই এই পরিবর্তনের খবর জেলা ও উপজেলা আওয়ামী লীগের ফেসবুক পেজ ও বিভিন্ন নেতাকর্মীদের প্রোফাইলে প্রচার করা হয়। এনিয়ে নানা ধরনের আলোচনা সমালোচনা চলে ফেসবুক জুড়ে। এমন সিদ্ধান্তের পক্ষে বিপক্ষে মতামত দেন অনেকেই। অনেক গণমাধ্যমেও এ বিষয়ে জানতে চাইলে শরিফুল ইসলাম রমজান বলেন, সম্মেলনস্থলে কমিটি ঘোষণার পর তাঁদের কাছে অভিযোগ আসে— সরকারি কর্মচারীকে মারধরের এক মামলায় লুলুর বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র দিয়েছে পুলিশ। পরে তাঁরা পুলিশের সঙ্গে কথা বলে বিষয়টির সত্যতা পান। এরপর সংগঠনের পরিচ্ছন্ন ভাবমূর্তি বজায় রাখতে রোকোনুলের পরিবর্তে যোগ্য ব্যক্তিকে সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব দিয়ে কমিটি ঘোষণা করা হয়।
এ ব্যাপারে রোকোনুল ইসলাম লুলু বলেন, সম্মেলনে সবার সম্মতিক্রমে মঞ্চে প্রধান অতিথি তাঁকে সাধারণ সম্পাদক হিসাবে ঘোষণা দিয়েছেন। প্রধান অতিথির পক্ষ থেকেও সংবাদ বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়েছে। অথচ সম্মেলন শেষে জেলার কয়েকজন নেতা নাটোরে ফিরে নিজেদের ইচ্ছেমতো রদবদল করেছেন। এটা মেনে নেওয়া যায় না। এটা গণতন্ত্রের পরিপন্থী।
এদিকে নতুন দায়িত্ব পাওয়া শামীম আহমেদ সাগর বলেন, ‘আমার বাবা সাবেক সংসদ সদস্য মরহুম মমতাজ উদ্দিন কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের সদস্য ছিলেন। আমার মা শেফালী মমতাজ সংরক্ষিত সংসদ সদস্য ছিলেন। রাজনৈতিক পরিবারে আমার জন্ম। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সঙ্গে আমার অস্তিত্ব মিশে রয়েছে। আমাকে সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব দিয়ে দল সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছেন বলে মনে করি। এ জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি।’ তবে রোকোনুল ইসলামকে বাদ দেওয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘এটা নেতৃবৃন্দের সিদ্ধান্ত। এ ব্যাপারে আমি মন্তব্য করব না। তবে আমি যতটুকু জানি, আওয়ামী লীগে তাঁর কোনো রাজনৈতিক অতীত নেই।’
নবগঠিত কমিটির সভাপতি আফতাব হোসেন ঝুলফু বলেন, সাধারণ সম্পাদক পদে রদবদল সঠিক হয়েছে। যাঁকে নতুন সাধারণ সম্পাদক করা হয়েছে, তিনি একজন পরীক্ষিত আওয়ামী লীগ কর্মী। তাঁর পরিবারের তিনজন সংসদ সদস্য ছিলেন। তাঁরা সবাই আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব দিয়েছেন। তিনি লালপুর উপজেলা আওয়ামী লীগকে আরও শক্তিশালী করতে পারবেন।
এদিকে নাটোরের বাগাতিপাড়া উপজেলা আওয়ামীলীগের নবগঠিত কমিটির সভাপতি নুরুল ইসলাম ঠান্ডুর বিরুদ্ধে গত বছরের নভেম্বর মাসে অনুষ্ঠিত স্থানীয় সরকার নির্বাচনে নৌকার প্রার্থীর বিরোধীতা করার অভিযোগ উঠেছে। মঙ্গলবার একাংশের বর্জনের মধ্যদিয়ে বাগাতিপাড়া উপজেলা আওয়ামীলীগের দ্বিবার্ষিক কাউন্সিলে নুরুল ইসলাম ঠান্ডুকে নবগঠিত কমিটির সভাপতি ও বাগাতিপাড়া ইউপি চেয়ারম্যান মজিবর রহমানকে নবগঠিত এই কমিটির সাধারন সম্পাদক হিসেবে ঘোষনা করা হয়। ওই কাউন্সিলে সদ্য বিলুপ্ত কমিটির সভাপতি আবুল হোসেন ও সাধারণ সম্পাদক সেকেন্দার আলীসহ তাদের সমর্থিত নেতাকর্মিরা কাউন্সিল বর্জন করেন। এরপরই অভিযোগ উঠেছে নবগঠিত কমিটির সভাপতি নুরুল ইসলাম ঠান্ডু গত বছর অনুষ্ঠিত পৌর ও স্থানীয় সরকার নির্বাচনের সময় নৌকা প্রতিকের চেয়ারম্যান প্রার্থীর বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থীর পক্ষে কাজ করেছেন্। যার দরুণ সদ্য বিলুপ্ত উপজেলা আওয়ামীলীগ সংগঠনের সহসভাপতি নুরুল ইসলাম ঠান্ডুকে দলীয় শৃংখলা ভঙ্গের অভিযোগ এনে দলীয় পদ পদবী সহ সদস্য পদ থেকে সাময়িকভাবে অব্যাহতি দেয় উপজেলা আওয়ামীলীগ। বিলুপ্ত কমিটির সভাপতি আবুল হোসেন ও সাধারন সম্পাদক সেকেন্দার রহমান ২০২১ সালের ২৭ নভেম্বর স্বাক্ষরিত প্রেরিত পত্র মারফত নুরুল ইসলাম ঠান্ডুকে অব্যাহতির বিষয়টি অবহিত করা হয়।
এ ব্যাপারে বিলুপ্ত কমিটির সাধারন সম্পাদক সেকেন্দার রহমান জানান, নুরুল ইসলাম ঠান্ডু বিগত স্থানীয় সরকার নির্বাচনের সময় নৌকা প্রার্থীর বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে অবস্থান নিয়ে সংগঠন বিরোধী ও গঠনতন্ত্রের বিভিন্ন ধারা ভঙ্গ করেন। তার অবস্থান স্পষ্ট হওয়ায় আওয়ামীলীগের গঠনতন্ত্রের ৪৭(ক) ও (ঠ) ধারার বিধান ও আওয়ামীলীগের কেন্দ্রিয় সম্মানিত সাধারন সম্পাদক ওবায়দুল কাদের মহোদয়ের ১২/১১/২০২১ ইং তারিখে স্বাক্ষরিত ইস্যুকৃত পত্রের নির্দেশ অনুযায়ী নুরুল ইসলাম ঠান্ডুকে উপজেলা আওয়ামীলীগের পদ-পদবী থেকে অব্যাহতি প্রদান করে তা অনুমতির জন্য কেন্দ্র কমিটিতে প্রেরণ করা হয়। নৌকা প্রার্থীর বিরোধীতা করার স্পষ্ট অবস্থানের ভিডিও ফুটেজ সহ যাবতীয় প্রমান তাদের হাতে রয়েছে বলেও তিনি জানান।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক দলে নেতা-কর্মীরা জানান, কাউন্সিলে উপস্থিত আওয়ামী লীগের কেন্দ্রিয় সাংগঠনিক সম্পাদক এসএম কামাল মঞ্চে বার বার ঘোষনা দেন যারা বিগত নির্বাচনে নৌকা প্রার্থীর বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছেন তারা দলীয় নেতৃত্বে আসতে পারবেননা। কিন্তু ঠান্ডুকে সভাপতি করায় কেন্দ্রিয় নেতৃবৃন্দের দেওয়া ঘোষনা স্ব-বিরোধী বলে দলের অনেকেই মনে করছেন।
এদিকে নুরুল ইসলাম ঠান্ডু জানান, তিনি নৌকা প্রার্থীর বিরোধীতা করেননি। এছাড়া তাকে সাময়িক অব্যাহতি বা বহিস্কার করা হয়েছে এমন কোন পত্র বা ঠিঠিও তিনি পাননি। এ ব্যাপারে তিনি কিছুই জানেননা। এ ধরনের মিথ্যা অভিযোগ তুলে যারা তার সুনাম ক্ষুন্নের চেষ্টা করছেন তারা নিজেরাই দলকে কুক্ষিগত করে রেখেছিলেন। দলের কর্মীদের রোষানলে পড়ার শংকায় তারা কাউন্সিল অধিবেশনেও হাজির হননি। কেন্দ্রিয় নেতৃবৃন্দেন আহ্বানও তারা প্রত্যাখান করে ধৃষ্টতা দেখিয়েছেন।
এ বিষয়ে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রিয় সাংগঠনিক সম্পাদক এসএম কামাল বলেন, কমিটিতে যাদের পদ দেওয়া হয়েছে তাদের বিরুদ্ধে কোন ধরনের অভিযোগ থাকলে তা প্রমান সাপেক্ষে মঞ্চে হাজির হয়ে উপস্থাপন করার জন্য বারবার মাইকে আহ্বান জানানো হয়। নুরুল ইসলাম ঠান্ডুর বিরুদ্ধে সাময়িক বহিস্কার বা অব্যাহতি বৈধ নয়। উপজেলা কমিটি কাউকে বহিস্কার করতে পারেনা। তার বিরুদ্ধে কোন অভিযোগ থাকলে প্রমান সাপেক্ষে উপস্থাপনের জন্য প্রকাশ্যে আহ্বান জানানো হয়। নবগঠিত কমিটির কারো বিরুদ্ধে কেউ অভিযোগ উপস্থাপন করেননি। যারা প্রতিদ্বন্দ্বি ছিলেন তারাও করেননি। এছাড়া স্থানীয় এমপি শহিদুল ইসলাম বকুল, সাবেক এমপি আবুল কালাম আজাদ, সংরক্ষিত এমপি রত্না অঅহমেদ, আইসিটি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক, জেলা আওয়ামীলীগ সভাপতি আব্দুল কুদ্দুস এমপি, সাধারন সম্পাদক শরিফুল ইসলাম রমজান সেখানে উপস্থিত ছিলেন।
তারাও ঠান্ডুর বিরুদ্ধে অভিযোগ থাকলে বলতে পারতেন। কিন্তু কেউ এবিষয়ে বলেননি। তবুও নুরুল ইসলাম ঠান্ডুর বিরুদ্ধে নৌকা বিরোধী স্পষ্ট অবস্থানের প্রমান দেখাতে বা উপস্থান করা হলে তা খতিয়ে দেখে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। প্রমান হলে তাকে পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হবে। এই কাউন্সিল অধিবেশনে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থেকে বাগাতিপাড়া উপজেলার নবগঠিত কমিটির নাম ঘোষনা করেন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সভাপতিমন্ডলীর সদস্য ও রাজশাহী সিটি কর্পোরেশনের মেয়র এএইচএম খায়রুজ্জামান লিটন। অন্যান্যের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন আওয়ামী লীগের স্বাস্থ্য ও জনসংখ্যা বিষয়ক সম্পাদক ডাঃ রোকেয়া সুলতানা, সদস্য বেগম আখতার জাহান, সৈয়দ আব্দুল আউয়াল শামীম, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক এমপিসহ স্থানীয় নেতৃবৃন্দ।
এমন নানা জল্পনা কল্পনার পর পুরো কমিটি গঠন জটিলতার দিকে এগুতে পারে বলে মনে করছেন নেতাকর্মীরা।
এমআই