সোমবার, ০২ ডিসেম্বর ২০২৪

প্রতিযোগিতাপূর্ণ নির্বাচন পশ্চিমবঙ্গে, কেমন অবস্থানে দলগুলো?

শনিবার, এপ্রিল ১০, ২০২১
প্রতিযোগিতাপূর্ণ নির্বাচন পশ্চিমবঙ্গে, কেমন অবস্থানে দলগুলো?

মাসুদ মিয়াজী : পড়শীদের নির্বাচন নিয়ে এদেশেও আলাপ-আলোচনা কম নয়, বস্তুত আকাশ সংস্কৃতির এই কালে কোন কিছুই এখন আর দূরে নয়। কিছুদিন আগে মার্কিন নির্বাচন নিয়ে বাংলাদেশের মানুষ যেভাবে আগ্রহ দেখিয়েছে তার তুলনায় সীমান্ত ঘেঁষা রাজ্যের নির্বাচন নিয়ে আরও বেশী আলোচনা জারি থাকার কথা বোধহয়!

বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গ, আসামের মত অতি নিকটবর্তী অঞ্চলে যখন নির্বাচন চলে তাতে আপনার-আমার নজর না থাকলেও সেখানকার রাজনীতিবিদরা নানাভাবে বাংলাদেশকে আলোচনায় এনে ভোট যুদ্ধে স্বার্থ হাসিল করছেন। তার উপরে বৃহত্তম গণতান্ত্রিক ভারতবর্ষে যেকোন ইস্যূতে এখন ধর্ম, জাতপাতের বিভাজন রেখা দ্রুতই টানা হয়। ফলে ভোটের নির্বাচনেও মূখ্য হাতিয়ার হয়ে উঠে এসব বিভাজনের রাজনীতি।

আসাম বাংলাদেশীদের দ্বারা ভরে যাচ্ছে বা সীমান্তে আর একটা উইপোকাও প্রবেশ করতে পারবেনা এমন মন্তব্য ভারতীয় রাজনীতিবিদদের পুরনো সংলাপ। এখন ধর্মের ভিত্তিতে ভোট ভাগ করার বা ভোটের জন্য নানান ধর্মের মানুষের মধ্যে বিভাজন করার প্রতিযোগিতা চলছে সেখানে। সর্বশেষ হুগলির এক জনসভায় মমতা বন্ধ্যোপাধ্যায় সরাসরি মুসলিমদের ভোট প্রত্যাশা করে বলেছেন, বিজেপি আসলে কিন্তু ক্ষতি আপনাদেরই বেশী। এ মন্তব্যের পর দ্রুতই বিজেপি তার প্রতিবাদ জানিয়ে নির্বাচন কমিশনে অভিযোগ ঠুকেছে যে মমতা ধর্মের ভিত্তিতে ভোট চেয়েছে যা আচরণ বিধির লঙ্ঘন। কার্যত বিজেপি'র কালে ধর্মীয় বিভাজন কতটা রূপ নিয়েছে তা মোটামুটি সচেতনজনও অবগত, অন্যদিকে বরাবরের মতো এবারও তৃণমূলে এ ধারণা বদ্ধমূল যে মুসলিম ভোটের মালিকানা তো আমাদেরই।

ভাষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি, শিল্প, বিনোদন সহ নানানভাবে পশ্চিমবঙ্গ বাংলাদেশের সাথে সম্পর্কযুক্ত। পাশ্ববর্তী বলে দু'অঞ্চলের কার্যক্রম একে অপরকে প্রভাবিত করে স্বাভাবিকভাবেই। ফলে পশ্চিমবঙ্গ, আসাম বা ত্রিপুরায় কে শাসক হচ্ছেন, কি মতাদর্শে চালিত হবে এসব অঞ্চল তা সঙ্গত কারণেই বিবেচনার বিষয়। এছাড়া একটা গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার নির্বাচনকে বুঝতে, গণমানুষের রায় বুঝতেও নির্বাচন প্রক্রিয়ার সামগ্রিক দিক সহায়ক হিসেবে কাজ করে।

১০ কোটি মানুষের রাজ্য পশ্চিমবঙ্গ, তন্মধ্যে প্রায় ৩ কোটি মুসলিম। সেখানে ২৯৪টি আসনে আঞ্চলিক সরকার গঠনের নিমিত্তে বিধানসভা নির্বাচন চলছে। ৮ ধাপের নির্বাচনের ৩ ধাপ ইতোমধ্যেই সম্পন্ন হয়েছে, সব আসনের পূর্ণ ফলাফল পাওয়া যাবে ২রা মে। পশ্চিমবঙ্গের এবারের নির্বাচন গত কয়েকবারের তুলনায় জমজমাট বলা যায়। নানান দলের অংশগ্রহণে তীব্র প্রতিযোগিতাময় হয়ে উঠেছে নির্বাচন। কেন্দ্রীয় শাসক দলের কান্ডারী প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এবং রাজ্য শাসক দলের প্রধান মূখ্যমন্ত্রী মমতার বাকযুদ্ধ এখন প্রতিদিনের খবরের প্রধান আকর্ষণ। দেশের প্রধান প্রধান রাজনীতিবিধদের সাথে সিনেমা শিল্পী, ক্রিকেটারদের পদচারণায় পশ্চিমবঙ্গই এখন ভারতবর্ষে সবচেয়ে বেশী আলোচনায়। বেশ কয়েকটি দলের অংশগ্রহণ থাকলেও কার্যত তিনটি পক্ষই প্রধান। তৃণমূল কংগ্রেস, বিজেপি এবং বাম নেতৃত্বাধীন সংযুক্ত মোর্চা। এই তিনটি শক্তির স্বল্প পর্যালোচনা দিয়েই শেষ হবে এ আলোচনা।

পশ্চিমবঙ্গে সরকার গঠনে বেশী এগিয়ে থাকা দল তৃণমূল কংগ্রেস। তৃণমূল মানেই মমতা বন্ধ্যোপাধ্যায়। ২বারের বিজয়ী এ দলটি এবারও কয়েকটি জরিপে এগিয়ে রয়েছে, তবে মমতা এবারই সবচেয়ে বেশী হুমকির মুখে থেকে নির্বাচন করছেন। আশঙ্কা, বিজেপির উত্থান মমতার দূর্গ টালমাটাল করে দিতে পারে, যার কিছুটা গত লোকসভা নির্বাচনে বিজেপি এই বঙ্গে দেখিয়েছে। মমতার দুশ্চিন্তা বাড়িয়েছে নিজ দলের বেহাল অবস্থা। দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকায় তার দলের বিরুদ্ধে অভিযোগও জমেছে বেশী, দলে মমতা ছাড়া নেতৃত্ব তৈরী হয়নি। টানা ক্ষমতায় থাকায় কোন আমলেই নেননি কংগ্রেস, বামদের। বাম নিধনে তৈরী হয়নি শক্ত বিরোধী দল। দলীয় কোন্দলে দলছুট অনেকে। যার সুযোগ নিয়েছে বিজেপি, তৃণমূলের অনেক নেতারই এখন নতুন ঘর ভারতীয় জনতা দল।

তৃণমূল পরিকল্পিত নির্বাচনী ফোকাসও নির্ধারণ করতে পারেনি যে আবার ক্ষমতায় আসলে বিশেষ কি করবে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে গত এক দশক ধরে পশ্চিমবঙ্গ জয়ের নিরিখে কাজ করে যাওয়া বিজেপি মোকাবেলায় তেমন কোন ভালো প্রস্তুতি ছিল না তৃণমূলের। মাঠে নেমে এখন বিজেপি ঠেকানোই লক্ষ্য সব জায়গায়।

পশ্চিমবঙ্গে ৩০ শতাংশ ভোট মুসলিমদের, এ সংখ্যা নিয়ে ভোটের রাজনীতি নতুন কিছু নয়। তবে এবার মমতা সব মুসলিম ভোটও আয়ত্তে রাখতে পারছেন না, গড়ে উঠেছে নতুন মুসলিম ঘরনার শক্তি। এখন তৃণমূলের জন্য মুসলিম ভোট টানা যেমন মুশকিল, তেমনি বিজেপি'র মত কট্টর হিন্দুত্ববাদী না হওয়ায় সব হিন্দু ভোট আসবে কিনা তাও অনিশ্চিত। তবে, অপেক্ষাকৃত মডারেট দৃষ্টিভঙ্গির দল হিসেবে তৃণমূল জনমত পাবে তা অনেকক্ষেত্রেই দেখা যায়।

এখন ভারতীয় রাজনীতিতে বিজেপি মানেই ভিন্ন কিছু। যেখানে যাচ্ছে সেখানটাই যেন ঝড় উঠছে। বিজেপির আদর্শিক নেতা শ্যামাপ্রাসাদের ভূমি পশ্চিমবঙ্গ জয়ের নেশায় বুদ হয়ে আছে মোদি-শাহ'রা। তৃণমূল থেকে হেভিওয়েটদের নিয়ে আসা কিংবা রূপালী পর্দার তারকাদের দিয়ে জমানো প্রচারণা কি নেই তাদের চেষ্টায়! বিজেপির মূল আরএসএস তাদের শাখা বিস্তৃত করেছে পশ্চিমবঙ্গের প্রতিটি পঞ্চায়েতে। মাস্টারপ্ল্যান সাজানো অনেক বছর আগে থেকে। আরএসএস কাজ করছে পাড়ায় পাড়ায়; সমিতি, শিক্ষা কর্মসূচি, মানবকল্যাণের নানান নামে। বঙ্গে বিজেপির ডায়ালগঃ সোনার বাংলায়, আর নয় অন্যায়। ফোকাসে হিন্দুত্ববাদ তৈরী। মুসলিম ভোট টানার তেমন খেয়াল নেই, ৭০ শতাংশ মেজরিটি ভোটই লক্ষ্য। তৃণমূল কে ভাঙার এবং তাদের ভোট কাটার হিসাব কষে বেশ গুছানো প্রস্তুতি বিজেপির, লক্ষ্য একুশে বঙ্গ জয়।

তবে, পশ্চিমবঙ্গের সাধারণ বাঙালীরা এখনো বিজেপিকে নিজেদের মনে করতে পারছেন না সম্ভবত। যদিও বিজেপির আগ্রাসী নির্বাচন কেন্দ্রীক কৌশলগুলোয় বেশ এগিয়ে যাচ্ছে তারা। এখানে বিজেপির মিড়িয়া সাপোর্ট গুরুত্বপূর্ণ নিয়ামক।

ডান দের নয়, ৩৪ বছর ধরে পশ্চিমবঙ্গ ছিল বাম দেরই। মমতার উত্থান পরবর্তী সময়ে সিপিআইএম'ই বেশী ক্ষতিগ্রস্ত দল। অস্তমিত বাম সূর্য যেন আবার আলো ছড়ানোর প্রয়াস। বলা হচ্ছে; ঘুরাও পাল, আবার লাল। তবে বাম শক্তি এবার একা নয়, জোট গড়েছে কংগ্রেস ও নয়া শক্তি আইএসএফের সঙ্গে। তবু কথা থাকে বাম-কংগ্রেসের ১০-১২ শতাংশ ভোট কি লালের পাল ঘুরাতে পারবে? ভরসা সঙ্গী আইএসএফ মানে ইন্ডিয়ান সেক্যুলার ফ্রন্ট। তরুন তুর্কি আব্বাস সিদ্দিকী'র দল আইএসএফ, যিনি ফুরফরা শরীফের পীরজাদা। তুমুল জনপ্রিয় আব্বাস সিদ্দিকী যেখানেই যাচ্ছেন জোয়ার উঠছে মানুষের। তার কথা শোনার জন্য অপেক্ষার প্রহর গুনে উৎসুক হাজার হাজার জনতা। জনপ্রিয়তা পাওয়া আব্বাস সংযুক্ত মোর্চা'র জন্য মুসলিম ভোট কাভার করলেও সব আসনেরই মুসলিম ভোট পাওয়া যাবে এমন নয়। অন্যদিকে ভারতীয় রাজনীতিতে আলোচিত মুসলিম নেতৃত্ব আসাদউদ্দিন ওয়াইসি শুরুতে আলোচনায় থাকলেও শেষ পর্যন্ত খুব বেশী সুবিধা করতে পারেনি। কোন জোটে যায়নি তার দল মিম, প্রথম ও দ্বিতীয় দফা ভোটে প্রার্থী দেয়নি দলটি।

তবে অনিয়মের খুব কোন অভিযোগ নেই বামদের নিয়ে। বরং জনগণের কাছাকাছি থেকে বিত্ত-প্রভাব হীন জীবনযাপনের জন্য অনেক বাম প্রার্থী পছন্দসই অবস্থানে। প্রার্থী দেয়ার ক্ষেত্রে তরুণদের প্রাধান্য দিয়েছে সিপিআইএম। ভারতে ছাত্র রাজনীতির জনপ্রিয় নাম কানাহাইয়া কুমারকেও বক্তব্য রাখতে দেখা গেছে নির্বাচনী জনসভাগুলোতে। সিপিআইএম'র নির্বাচনী ইশতেহারে রাখা হয়েছে সিএএ বা এনআরসি প্রতিরোধ করার প্রতিশ্রুতি। এত আয়োজনের পরও বিজেপি ও তৃণমূলের তুলনায় পিছিয়েই সিপিআইএম।

অবস্থা বিশ্লেষণে তৃণমূল এগিয়ে থাকা দল হলেও বিজেপি এবং মমতার দলের মধ্যে পার্থক্য খুব বেশী থাকবে না বলেই জরিপ গুলো জানাচ্ছে। কোন দল যদি একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা না পায় সেক্ষেত্রে ফলাফলের পর সংযুক্ত মোর্চা'র কদর বাড়তেও পারে। পশ্চিমবঙ্গ নির্বাচন আদতে মোদি'র জন্য টেস্ট কেস। ধর্ম বিভাজন, বেকারত্ব বাড়ার পরও এখনোও বিজেপি সরকারকে কিভাবে জনগণ দেখছে তা বুঝা যাবে ফলাফলে। তৃণমূল বিজয়ী হলেও তা মূলত বিজেপি কে গ্রহণ না করার সিগনালটা ই পরিলক্ষিত হবে।

লেখক : আন্তর্জাতিক বিশ্লেষক 
masud.meazi44@yahoo.com


Somoy Journal is new coming online based newspaper in Bangladesh. It's growing as a most reading and popular Bangladeshi and Bengali website in the world.

উপদেষ্টা সম্পাদক: প্রফেসর সৈয়দ আহসানুল আলম পারভেজ

যোগাযোগ:
এহসান টাওয়ার, লেন-১৬/১৭, পূর্বাচল রোড, উত্তর বাড্ডা, ঢাকা-১২১২, বাংলাদেশ
কর্পোরেট অফিস: ২২৯/ক, প্রগতি সরণি, কুড়িল, ঢাকা-১২২৯
ইমেইল: somoyjournal@gmail.com
নিউজরুম ই-মেইল : sjnewsdesk@gmail.com

কপিরাইট স্বত্ব ২০১৯-২০২৪ সময় জার্নাল