সোমবার, ৩০ ডিসেম্বর ২০২৪

একজন বেগম মুজিব ও একটি বাংলাদেশ

সোমবার, আগস্ট ৮, ২০২২
একজন বেগম মুজিব ও একটি বাংলাদেশ

ডাঃ এস এম বাদশা মিয়া: 

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে পুরুষদের পাশাপাশি নারীদের আত্মত্যাগের ইতিহাস কম নয়। একাত্তরে হাজারও নারী হারিয়েছে নিজের ইজ্জত। পাকিস্তানি হায়নারা নারীদের সম্ভ্রম নিয়ে করেছে হোলিখেলা। এ বীরঙ্গনারা স্বাধীনতার পর যখন সমাজে উপেক্ষিত হয়ে অসহায়; তখন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন , ‘ধর্ষিতা মেয়ের বাবার নামের জায়গায় আমার নাম লিখে দাও- শেখ মুজিবুর রহমান। আর ঠিকানা লেখ ধানমণ্ডি বত্রিশ…।’বাংলার নারীদের এভাবে সম্মান দিয়েছেন যে মানুষটি তাকেই
নির্মমভাবে স্বপরিবারে হত্যা করল ১৯৭৫ সালের ১৫ আগষ্ট অকৃতজ্ঞ কিছু বাঙালী । আর সেদিনেই তিনি আলাদা হলেন তার ছায়া সঙ্গী সহধর্মিণী রেনু থেকে। বঙ্গবন্ধু চিরনিদ্রায় শায়িত হলেন গোপালগঞ্জের টুঙ্গীপাড়ায় আর রেনু ঢাকায় বনানী কবরস্থানে।

বঙ্গবন্ধু তার অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে স্ত্রীর সম্পর্কে লিখেছেন, ‘সে (রেণু) তো নীরবে সকল কষ্ট সহ্য করে, কিন্তু কিছু বলে না। কিছু বলে না বা বলতে চায় না, সেই জন্য আমার আরও বেশি ব্যথা লাগে।’ প্রিয়তমার জন্য কতটা ভালোবাসা হলে হৃদয়ে এমন রক্ত ক্ষরণ হয় তা অনুমান করা অসম্ভব। জাতির পিতার  ‘রেণু’ হলেন বাংলার মহীয়সী নারী বেগম শেখ ফজিল্লাতুনেছা মুজিব । যিনি প্রজ্ঞা, ধৈর্য্য, সাহসিকতা, মায়া মমতা ও ভালোবাসা দিয়ে পালন করেছেন নারী  জীবনের সকল দায়িত্ব। পাশাপাশি রাজনীতিবিদ না হয়েও দেশের দুঃসময়ে জনগণকে আগলে রেখেছেন নিজের মেধাও বিচক্ষণতা দিয়ে । যার জন্য সকলের কাছে তিনি বঙ্গমাতা হিসাবে সমাদৃত।

এ মহীয়সী নারীর জন্ম ও মৃত্যু হয় একই মাসে । ১৯৩০ সালের ৮ আগষ্ট জন্ম এবং মৃত্যু ১৫ আগস্ট, ১৯৭৫। গোপালগঞ্জের টঙ্গিপাড়ার শেখ জহুরুল হক এবং হোসনে আরা বেগমের এক পুত্র ও দুই কন্যার মধ্যে ছোট সন্তান ছিলেন বেগম শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব। ডাকনাম রেনু । মাত্র তিন বছর বয়সে বাবা আর পাঁচ বছর বয়সে মাকে হারানোর পর রেনুর দেখভাল করতেন দাদা শেখ কাশেম ।

তখনকার সময়ে মেয়েদের অল্প বয়সে বিয়ের প্রচলন থাকলেও; দাদা একদম শিশুকালে রেনুকে শেখ মুজিবের কাছে বিয়ে দেন বিশেষ কারণে। সে কারণটা পরিষ্কার  হয় বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে , “আমার যখন বিবাহ হয় তখন আমার বয়স বার তের হতে পারে। রেণুর বাবা মারা যাবার পরে ওর দাদা আমার  আব্বাকে ডেকে বললেন, ‘তোমার বড় ছেলের সাথে আমার এক নাতনীর বিবাহ দিতে হবে। কারণ, আমি সমস্ত সম্পত্তি ওদের দুই বোনকে লিখে দিয়ে যাব।’  রেণুর দাদা আমার আব্বার চাচা। মুরব্বির হুকুম মানার জন্যই রেণুর সাথে আমার বিবাহ রেজিস্ট্রি করে ফেলা হল। আমি শুনলাম আমার বিবাহ হয়েছে। তখন 
কিছুই বুঝতাম না, রেণুর বয়স তখন বোধহয় তিন বছর হবে।” পরে ১৯৩৯ সালে শেখ মুজিবুর রহমানের ১৯ বছর বয়সে এবং বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিবের ৯ বছর বয়সে আনুষ্ঠানিকভাবে বিয়ে হয় দুজনের। রেনুর মায়ের  মৃত্যুর দু বছর পর দাদা ও মারা যায় বলে বঙ্গবন্ধুর মা সায়েরা খাতুন নিজের সন্তানদের সাথে বড় করেন রেনুকে। তৈরি করেন আর্দশ নারী হিসাবে। বেগম মুজিব বঙ্গবন্ধুর সহযোদ্ধা হয়ে ছিলেন বলে সংসার, রাজনৈতিক সকল বিষয়ে আলাপ করতেন স্ত্রী রেনুর সাথে। রেনুও তার সর্বস্ব দেশপ্রেমী স্বামীর হাতে তুলে দিয়েছিলেন  দেশের কাজের জন্য।

বঙ্গবন্ধুর জেল জীবন নিয়ে তিনি থাকতেন উদ্বিগ্ন। একবার একটানা ১৭/১৮ মাস জেলে থাকায় বঙ্গবন্ধুর স্বাস্থ্য বেশ খারাপ হয়ে যায়। যা দেখে বেগম মুজিব কষ্ট পেয়ে স্বামীকে বলেন, ‘জেলে থাকো আপত্তি নেই। তবে স্বাস্থ্যের দিকে নজর রেখো। তোমাকে দেখে আমার মন খুব খারাপ হয়ে গেছে। তোমার বোঝা উচিত আমার দুনিয়ায় কেউ নাই। ছোটবেলায় বাবা-মা মারা গেছেন… তোমার কিছু হলে বাঁচব কি করে?’

বেগম মুজিবের যেকোনো প্রতিকূল পরিস্থিতিকে সামালে নেয়ার মতো বুদ্ধিমত্তা, অসীম ধৈর্য্য ও সাহস দিয়ে মোকাবেলা করার শক্তি ছিল ছোট বেলা থেকে । আর নিজের এ গুন দিয়ে শেখ হাসিনা, শেখ কামাল, শেখ জামাল, শেখ রেহানা ও শেখ রাসেলকে মানুষ করেছেন। শিখিয়েছেন দেশের কাছে ব্যক্তি জীবনের চাওয়া  পাওয়া সব কিছু তুচ্ছ। শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব পড়ালেখা খুব বেশি করেননি।তবে স্মৃতিশক্তি ছিল অত্যন্ত প্রখর। গান ভালোবাসতেন। অবসরে বই পড়তেন।  নিজের মুক্তচিন্তা দিয়ে রাজনীতিকে অনুধাবন করতেন বলে স্বামীর প্রতিটি অর্জনের পেছনে তাঁর ভূমিকা অবিস্মরণীয়। মাসের পর মাস জেলবন্দী বঙ্গবন্ধুর অবর্তমানে  পরিবার, ছেলেমেয়েদের পড়াশোনা,শ্বশুর-শাশুড়ির দেখভাল সহ রাজনৈতিক সংকট সামলাতেন তিনি সুনিপুণভাবে।

১৯৭১যখন বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানিদের হাতে বন্দী। ফিরবে কিনা তা অনিশ্চিত। সে অবস্থায়ও নিজের দুই ছেলেকে নির্ভয়ে পাঠিয়েছেন যুদ্ধ করতে। দেশের জন্য সর্বোচ্চ  আত্মত্যাগ করতে সদা প্রস্তুত এ নারী সন্তানদের নিয়ে সহ্য করেছেন পাকিস্তানিদের নিপীড়ন। এমন মহীয়সী নারীর সারা জীবনের আত্মত্যাগের ছবি ফুটে উঠে তারই  কন্যা শেখ রেহানার লেখনিতে।‘…গ্রামে জন্ম হওয়া একজন সাধারণ নারী আমার মা, ক্লাস ফোর-ফাইভ পর্যন্ত পড়েছেন মিশনারি স্কুলে। কিন্তু কী যে প্রজ্ঞা, কী  যে তার ধৈর্য্য। আমার মায়ের কাছে আমাদের যে জিনিসটা সবার আগে শেখা উচিত, তা হলো ধৈর্য্য আর সাহস। সবাইকে এক করে রাখা। এতগুলো লোক বাড়িতে খাচ্ছে, দাচ্ছে, আমাদের গ্রামে কোন মেয়ে ম্যাট্রিক পাস করেছে, তাকে এনে ঢাকায় কলেজে ভর্তি করে দাও, কাকে বিয়ে দিতে হবে! সব সামলাচ্ছেন। এর  মধ্যে আমাদের সকালে কোরআন শরিফ পড়া শেখাতে মৌলভি সাহেব আসছেন, তারপর নাচ শিখছি, সেতার শিখছি, বেহালা শিখছি—সব কিন্তু মায়ের সিদ্ধান্ত।  কিন্তু তার নিজের বয়স কত! আমার তো মনে হয়, আমার মা কি কোনো দিন তাঁর শৈশবে কিংবা কৈশোরে একটা ফিতা বা রঙিন চুড়ি চেয়েছেন কারও কাছে! মা-ই তো সব থেকে বঞ্চিত ছিলেন। অথচ তিনি হাসিমুখে সব সামলাচ্ছেন।’ কন্যা-জায়া -জননী রূপে নারী নিজেকে সার্থক করে তুলতে পারাটা বেশ কঠিন কাজ।আর সে কাজ করার পাশাপাশি দেশের জন্য নিজের স্বামী, সন্তান, পরিবার  পরিজনকে লড়াই করতে এতটুকু পিছ’পা হয়নি অদম্য সাহসী নারী বেগম শেখ ফজিলাতুন্নেছা। রাজনৈতিক স্বামীর সহযোদ্ধা হয়ে দলের নেতা কর্মীদের আগলে  রেখেছেন সর্বক্ষণ। তার সুশিক্ষা, রাজনৈতিক বোধ, দেশপ্রেম তিনি গ্রোথিত করেছেন সন্তানদের মাঝে।আর সে কারনে বাংলাদেশ ও বাংলার জনগণ অশ্রুসিক্ত নয়নে  সশ্রদ্ধে স্মরণ করে জাতির পিতার জায়া বেগম শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিবকে প্রতিনিয়ত। কারন বাঙালী নারীদের কাছে তিনি অদম্য সাহসী এক নারীর প্রতীক ।


লেখক- প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি, বঙ্গবন্ধু স্মৃতি সংসদ ও স্মৃতি পাঠাগার।


Somoy Journal is new coming online based newspaper in Bangladesh. It's growing as a most reading and popular Bangladeshi and Bengali website in the world.

উপদেষ্টা সম্পাদক: প্রফেসর সৈয়দ আহসানুল আলম পারভেজ

যোগাযোগ:
এহসান টাওয়ার, লেন-১৬/১৭, পূর্বাচল রোড, উত্তর বাড্ডা, ঢাকা-১২১২, বাংলাদেশ
কর্পোরেট অফিস: ২২৯/ক, প্রগতি সরণি, কুড়িল, ঢাকা-১২২৯
ইমেইল: somoyjournal@gmail.com
নিউজরুম ই-মেইল : sjnewsdesk@gmail.com

কপিরাইট স্বত্ব ২০১৯-২০২৪ সময় জার্নাল