ডাঃ এস এম বাদশা মিয়া
বাঙালি জাতিসত্তার ইতিহাসে বঙ্গবন্ধু শুধু স্বাধীনতার জনকই নয়। তিনি একাধারে প্রজ্ঞাবান নেতা, সমাজ সংস্কারক, স্বাধীনতা পরবর্তী মাত্র কয়েকবছরে বঙ্গবন্ধু শিক্ষাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে ঢেলে সাজিয়েছিলেন উপনিবেশিক শাসনামলে প্রবর্তিত পূর্ববাংলার বঞ্চিত শিক্ষা ব্যবস্থাকে।
বঙ্গবন্ধু ক্ষমতায় এসে উচ্চশিক্ষার দ্বার সবার জন্য উন্মুক্ত করে দিলেন এবং ধনী-গরিবের বৈষম্য দূর করলেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে স্বায়ত্ত্বশাসন প্রদান করলেন এবং গঠন করলেন বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন। প্রাথমিক শিক্ষা সরকারিকরণ, সংবিধানে শিক্ষা বাধ্যতামূলক, শিক্ষা কমিশন গঠনসহ নানা কার্যক্রম বাস্তবায়ন করেছেন।
সেই ষাটের দশক থেকেই জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান স্বাধিকারের পথ ধরে স্বাধীন রাষ্ট্রের স্বপ্ন দেখিয়েছেন এ জনপদের মানুষকে। বঙ্গবন্ধু শুধু একটি স্বাধীন ভূখণ্ডই উপহার দেননি বরং উন্নত বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে দেশের সামগ্রিক শিক্ষাপ্রক্রিয়াকে সময়োপযোগী ও প্রয়োজনীয় শিক্ষার ওপর জোর দিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধু বুঝতে পেরেছিলেন শিক্ষা ছাড়া দেশ ও জাতি গঠন করা সম্ভব নয়। দেশ গঠন করতে হলে শিক্ষার ওপর জোর দিতে হবে।
বস্তুত মানবদক্ষতা ছাড়া অগ্রগতি সম্ভব নয়। যার জন্য প্রয়োজন শিক্ষার, বিশেষ করে কারিগরি শিক্ষার। কিন্তু সক্ষমতার আরেকটি দিক হচ্ছে সুস্বাস্থ্য। স্বাস্থ্য খারাপ থাকলে উচ্চমানের দক্ষতা কাজে লাগানো যাবে না। তাই তিনি মেডিকেল শিক্ষার ওপরও জোর দিয়েছেন, মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করার কথা বলেছেন।
জাতির এই শ্রেষ্ঠ সন্তান স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের উপযোগী সমাজ গঠনমূলক একটি সার্বিক শিক্ষাব্যবস্থার রূপরেখা প্রণয়নের জন্য ১৯৭২ সালের ২৬ জুলাই ড. কুদরাত-এ-খুদার নেতৃত্বে জাতীয় শিক্ষা কমিশন গঠন করেন। বিজয়ের মাত্র সাত মাসের মতো সময়ের মধ্যে এই কমিশন গঠন করা দেশের জন্য একটি সময়োপযোগী শিক্ষাব্যবস্থা তৈরি করার প্রতি বঙ্গবন্ধুর অপার আগ্রহের পরিচয় বহন করে। ১৯৭৪-এর মে মাসে কমিশন প্রতিবেদন জমা দেয়।
প্রতিবেদনে উল্লেখযোগ্য সুপারিশগুলোর মধ্যে ছিল: শিক্ষা খাতে পর্যাপ্ত বরাদ্দ দেওয়া, বৃত্তিমূলক শিক্ষার প্রসার ঘটানো, নারী শিক্ষায় জোর দেওয়া, অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত প্রাথমিক শিক্ষা সম্প্রসারণ করা এবং শিক্ষার সর্বস্তরে মাতৃভাষার প্রচলন।
বঙ্গবন্ধুর শিক্ষা ভাবনা সম্পর্কে একটি ধারণা পাওয়া যায় ১৯৭০ এর নির্বাচনের সময় টেলিভিশনে দেওয়া এক ভাষণে। সেই ভাষণে তিনি সুস্পষ্ট কিছু প্রস্তাব রেখেছিলেন। যথা- প্রথমত, সুষ্ঠু সমাজ ব্যবস্থা গড়ে তোলার জন্য শিক্ষাখাতে পুঁজি বিনিয়োগের চেয়ে উৎকৃষ্ট বিনিয়োগ আর কিছু হতে পারে না। দ্বিতীয়ত, নিরক্ষতা অবশ্যই দূর করতে হবে। পাঁচ বছর বয়স্ক শিশুদের বাধ্যতামূলক অবৈতনিক প্রাথমিক শিক্ষাদানের জন্যে একটি ক্র্যাশ প্রোগ্রাম চালু করতে হবে।
তৃতীয়ত, দারিদ্র্য যেন উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে মেধাবীদের জন্য বাধা হয়ে না দাঁড়ায়, সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। বঙ্গবন্ধু শিক্ষা নিয়ে ১৯৭০ সালে যে ভাষণ দিয়েছিলেন তা তিনি শুধু ভাষণের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখেননি। বাস্তবে রূপদান করেছিলেন ক্ষমতায় যাওয়ার পর। তিনি দেশের সব প্রাথমিক বিদ্যালয়কে জাতীয়করণ করেছিলেন। প্রাথমিক শিক্ষা সবার জন্য বিনামূল্যে উন্মুক্ত করেন। বঙ্গবন্ধুর এ ভাষণই শিক্ষাখাতে তার আন্তরিক আগ্রহ ও প্রচেষ্টার স্পষ্ট ছবি ভেসে ওঠে।
লেখক- প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি,
বঙ্গবন্ধু স্মৃতি সংসদ ও স্মৃতি পাঠাগার