এক দম্পতি চেম্বারে আসলেন বিকেলে।
আমি একটু ঝিমাচ্ছিলাম চেয়ারে হেলান দিয়ে।
তারা হুট করেই চেম্বারে ঢুকে গেলেন।
একটু বিরক্ত অনুভব করলেও তাদের তা বুঝতে না দিয়ে আমার এসিস্ট্যান্টকে ডাকলাম।
দুইজনের মুখে মাস্ক দেখে খুশি হলাম।
যদিও অনেক রোগী মাস্ক পরেনা আমি জানি।
অনেকে শুধু আমার চেম্বারে ঢুকার জন্য সামনের মেডিকেয়ার ফার্মেসী থেকে একটা মাস্ক কিনে পরে ডুকে।
চেম্বার থেকে বের হয়ে সেই মাস্ক তাদের মুখ থেকে পকেটে ঢুকে যায়।
আমি বেকুবের মত সিসি ক্যামেরায় তাকিয়ে তাদের কান্ডকারখানা দেখি।
মাঝে মাঝে হাসি পায়।
নিজেকে পাগল পাগল লাগে।
দম্পতিটির দিকে নজর দিলাম।
পুরুষ লোকটি রোগী।
বয়স ২৮ বছর।
কি সমস্যা জানতে চাইলাম।
ছেলেটি বললো,সে ডিপ্রেশনে ভুগছে।
আমি বললাম কিভাবে বুঝলেন আপনি ডিপ্রেশনে ভুগছেন?
ছেলেটি তার গল্প বললো।
তবে গল্প বলার আগেই একচোট ঝগড়া দুইজনে আমার সামনে করে নিলেন।
আমি ব্যাপক আনন্দ নিয়ে তা উপভোগ করছি।
একবার ছেলেটিকে দেখি, একবার মেয়েটিকে।
মেয়েটি চোপায় খুব এক্সপার্ট।
বারবার ছেলেটিকে কাবু করে দিচ্ছে।
ছেলেটি গাইগুই করে যাচ্ছে।
তাদের বাকবিতন্ডায় আমার স্টাফরা ও অন্য রোগীরা উঁকি দিলে আমি তাদের সরে যেতে বললাম।
তাদের বিয়ে হয়েছে দুইবছর হলো। বিয়ের আগে মেয়েটি নাকি বিড়াল ছিলো।
কোনদিন বড়গলায় কথা বলেনি।
ছেলেটিকে সন্দেহ করেনি।
যথেষ্ট সমীহ ও সম্মান করতো ছেলেটিকে।
বন্ধুবান্ধবদের সাথে আড্ডা নিয়ে ঝামেলা করতো না।
খুবই লক্ষী প্রেমিকা ছিলো।
ছেলেটি যা বুঝাতো মেয়েটি তা বুঝতো।
ছেলেটি মোবাইলে ব্যস্ত থাকলে কোনদিন জিজ্ঞেস করতো না কার সাথে কথা বলছে।
উলটো ছেলেটি মেয়েটিকে মোবাইলে ব্যস্ত পেলে মেয়েটি স্ক্রিনশট দিতো কার সাথে কথা বলছে।
আমি বললাম, এখন কি প্রব্লেম?
ছেলেটির ভাষায় মেয়েটি আগে তাকে কিছুটা ভয়ও পেতো।
মুখে মুখে তর্ক করতো না।
সংসার শুরুর পর তাদের মধ্যে যথেষ্ট গনতন্ত্র ছিলো।
কোন কিছু কেনাকাটায় দুইজনের মতামতকে দুইজন গুরুত্ব দিতো।
ইদানীং মেয়েটি স্বৈরাচারী আচরণ শুরু করছে।
মেয়েটি উত্তেজিত হয়ে বললো, এভাবেই চলবো আমি ভালো লাগলে সংসার করো,নইলে অন্য কাউকে খুঁজে দেখো।
ছেলেটিকে বললাম, আপনি বলুন শুনি।
আমি কেন জানি ব্যাপক মজা পাচ্ছিলাম।
ছেলেটির অভিযোগ হলো, তার অফিস শেষ হলে বাসায় আসতে ৩০ মিনিট লাগে।
যদি ৪৫ মিনিট হয়,তবে মেয়েটি চিল্লাফাল্লা শুরু করে।
গালি দেয়।
বলে কোন মহিলার লগে ডেটিং করে আসছো।
অসহায় ভাবে ছেলেটি বললো,স্যার ১৫ মিনিটে কি ডেটিং করা যায়।
অথচ মেয়েটি যদি বাজার করতে গিয়ে ৩০ মিনিটের জায়গায় দুই ঘন্টা পরে আসে তারপরও তাকে কিছু বলা যাবেনা।
উদাহরণ স্বরুপ মেয়েটি একদিন বাজার করতে গিয়ে তিন ঘন্টা পরে বাসায় আসছে।
বাজারে গিয়ে তার এক বান্ধবীর সাথে নাকি দেখা।
সে সেই বান্ধবীর সাথে তার বাসায় গিয়ে আড্ডা মেরে কেনা মাছ পঁচিয়ে তারপর বাসায় আসছে।
কিন্ত তাকে কিছু বলা যাবেনা।
অথচ ছেলেটি অফিস শেষে নীচে দাঁড়িয়ে কলিগদের সাথে একটা সিগারেট টেনে একটু আড্ডা মেরে বাসায় ফিরলে সে গালাগালি শুরু করে।
কিন্ত সে যে তিনঘন্টা বাইরে কাটালো এটা নিয়ে কিছু বলার আগেই মেয়েটি বললো, এভাবেই চলবে।
পছন্দ না হলেও কিছু করার নেই।
ছেলেটি অফিস থেকে মেয়েটিকে একদিন ফোন দিলো, নাম্বার দেড় ঘন্টা ধরে ব্যস্ত।
ছেলেটি বারবার কল দিচ্ছে কিন্ত মেয়েটি ধরছে না।
কল বেকও করছেনা।
অথচ একদিন ছেলেটির চাচা ফোন দিয়ে গ্রামের জমিজমা সংক্রান্ত আলাপে ব্যস্ত ছিলো।
মেয়েটি ছেলেটির ফোন ব্যস্ত পাওয়ায় বাসায় ফিরলে চেচামেচি করতে লাগলো।
মেয়েটির কথা তার কল দেখার সাথে সাথেই অন্য কল কেটে তারটা ধরলো না কেন?
কথার এক পর্যায়ে উত্তেজিত হয়ে মেয়েটি ছেলেটির ৩০ হাজার টাকা দামের মোবাইল ভেঙ্গে ফেললো।
ছেলেটি একবার মেয়েটির জন্য একটা শাড়ি কিনেছে নিজের পছন্দে তার জন্মদিনে।
মেয়েটির শাড়ি নাকি পছন্দ হয়নি এবং দামও নাকি বেশি নিছে।
মেয়েটি পুরো বাসা মাথায় তুলে ফেলছে।
এক পর্যায়ে ছেলেটি বললো,ঠিক আছে আমি এটা ফেরত দিয়ে অন্য একটা আনবো।
মেয়েটি কাচি দিয়ে শাড়িটা সারারাত ধরে কেটেকুটে শেষ।
মেয়েটির এক কথা বিয়ের পর তার রুচি এমন হলো কিভাবে।
ছেলেটি উচিত শিক্ষা প্রাপ্য।
কিন্ত এক মাস আগে মেয়েটি ছেলেটির জন্য একটা ফতুয়া কিনে।
ছেলেটি এই কালারের ফতুয়া পরেনা।
তার পছন্দ হয়নি।
এটা বললো কেন ব্যস, ফতুয়া রেখে মেয়েটি ছেলেটির নতুন একটা পাঞ্জাবি কেটে টুকরো টুকরো করে ফেলে।
মেয়েটির এক কথা।
সে কিনছে। পছন্দ অপছন্দ আবার কি।
এটা তাকে পরতেই হবে।
ছেলেটি বললো, এমন শত শত উদাহরণ সে দিতে পারবে।
ঘরে তার কোন কথার মূল্য নেই।
প্রেম করে বিয়ে করছে। কাউকে কিছু বললে সেই কথা শুনায়।
আমি মেয়েটির দিকে তাকাতেই সে মেয়েটি ফোঁস করে উঠলো।
মেয়েটির এক কথা।
আমি যা বলবো,যা করবো সব মানতে হবে বিনাবাক্যে।
টুঁ শব্দটিও করা যাবেনা।
এত যুক্তিমুক্তির ধার আমি ধারিনা।
ছেলেটি অসহায়ের মত আমার দিকে তাকিয়ে বললো, সে যখন ইচ্ছা তখন মায়ের বাসায় চলে যাবে।
দুইদিন তিনদিন আসবেনা।
কিন্ত আমি জরুরী কোন কাজেও গ্রামে আসতে পারিনা।
সে নাকি একা থাকতে পারেনা।
আমি মাথা নাড়ছি দেখে ছেলেটি বললো ,আমি একটা অদ্ভুত সংসার করছি স্যার।
এখানে তার কথাই সব।
স্বৈরাচারী আচরণ করেই যাচ্ছে।
আমি যদি কিছু বলি তখন সে উত্তেজিত হয়ে বলে ভালো লাগলে থাকো, না হলে আরেকটা বিয়ে করো।
ছেলেটির গলা ধরে আসলো।
বললো ,স্যার আমি তাকে ভালবেসে বিয়ে করেছি।
সে ইদানীং পাগলামির মাত্রা এত বাড়াইছে- আমি জাস্ট হাঁপিয়ে উঠছি।
মেয়েটি আমার সামনেই চোখ বড় বড় করে কটমট করে ছেলেটির দিকে তাকিয়ে বললো, আমি পাগল তাইনা?
চেম্বার থেকে বের হয়ে নাও।
ছেলেটির কিছু ভালো লাগেনা।
সবকিছু অসহ্য লাগে।
খাওয়ার রুচি কমে গেছে। রাতে ঘুম কম হয়।
মেয়েটি মুখের উপর বলে ফেললো,কই আমার ঘুম তো ঠিক আছে। খাবারের রুচিও ঠিক আছে।
তোমার এত সমস্যা কিসের?
আমার দিকে তাকিয়ে বললো, স্যার আপনার এলাকার ছেলে। ওকে ভালো করে চিকিৎসা করে দিন।
আর বলে দিন, আমি কিন্ত পাল্টাবো না।
যেমন আছি তেমনই থাকবো।
আপনি আবার আমার চিকিৎসা করতে চাইবেন না।
ভিজিট পাবেন না।
আমি যা বুঝলাম ছেলেটি Autocratic Democrazy তে আটকে গেছে।
আপনি ভোট দিতে পারেন না।
আপনার ভোট অন্য কেউ দিয়ে দেয়।
আপনার ভোট আপনি না দিলেও দেওয়া হয়ে যায়।
দিনের ভোট আগের রাতে হয়ে যায়।
আবার বলা হয় আপনি গনতন্ত্রে আছেন।
সহ্যও করতে পারবেন না।
আবার বলতেও পারবেন না।
অথচ সংসারে ও দেশে True Democracy দরকার।
দুইজন দুইজনের পছন্দ অপছন্দ, চাওয়া, ইচ্ছার পূর্ণ সম্মান করবে।
লজিক্যাল ডিবেট করবে।
দুইজনই সংসার সুখের জন্য ছাড় দিবে।
মেয়েটিকে অনুরোধ করলাম চেম্বারের বাইরে যেতে।
ছেলেটিকে মেডিসিন না দিয়ে কাউন্সেলিং করলাম।
কিছু টিপস শেখালাম কিভাবে সাংসারিক স্বৈরতন্ত্রের নিপাত ঘটাতে পারে।
এক মাস পর বাড়ি আসলে আবার চেম্বারে আসতে বলে বিদায় দিলাম।
হাসতে হাসতে ছেলেটিকে বললাম, আপনি তো স্ত্রীর স্বৈরাচারী আচরণে Autocratic depression এ পড়ে আছেন।
অনেকটা স্বৈরতন্ত্রে গনতন্ত্রকামী মানুষের যেমন হতাশা জন্মে।
টিপসগুলো কাজে লাগান।
একদিন সংসারে Democracy আসবে।