আবু আলী ইবনে সিনা:
গত কয়েক বছর ধরে বাংলাদেশে অনেকেই বিশ্ববিদ্যালয় রেঙ্কিং নিয়ে সচেতন এবং প্রতি বছরই বিভিন্ন রেঙ্কিং প্রকাশিত হলে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অবস্থান দেখে সবার মাঝে ক্ষোভ ও হতাশা ঝরে পরে| আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর এই হতাশাজনক অবস্থানের প্রধান কারণ হলো আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় গুলো চলছে সম্পূর্ণ ভুল মডেল নিয়ে| এই ভুল মডেল নিয়ে চললে সারাজীবন চেষ্টা করলেও দেশে সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট হবেনা| আর সরকার থেকে কোটি কোটি টাকা ঢাললেও বিশ্ববিদ্যালয়ের রেঙ্কিং এ উন্নতি হবেনা| এই মডেল অনেকটাই স্কুল ও কলেজ এর মডেল যেখানে শিক্ষার্থীরা আসে শুধু জ্ঞান অর্জন করতে এবং শিক্ষকরা শুধু পূর্ব আবিষ্কৃত জ্ঞান বিতরণ করেন| অথচ বিশ্ববিদ্যালয় শুধুমাত্র জ্ঞান অর্জনের জায়গা না, এটা জ্ঞান তৈরির জায়গাও| কিন্তু আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো তো জ্ঞান তৈরী করতে পারছেনা| তাহলে আমাদের ভুলগুলো কোথায়? কেন আমরা শুধুমাত্র জ্ঞান বিতরণের স্কুল তৈরী করে যাচ্ছি কিন্তু জ্ঞান তৈরীর বিশ্ববিদ্যালয় তৈরী করতে পারছিনা? পৃথিবীর নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলো কি মডেল ফলো করে, আমাদের সাথে তাদের কোথায় পার্থ্যক্য এবং আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় মডেল এর ত্রুটিগুলো নিয়ে কথা বলবো আজ|
১.গবেষণা ও শিক্ষকতা দুইটি আলাদা পেশা
আধুনিক বিশ্ববিদ্যালয় গুলোতে দুই ধরণের একাডেমিক বা শিক্ষক থাকে: রিসার্চ একাডেমিক এবং টিচিং একাডেমিক| কিন্তু আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় মডেল এ এই ধরণের কোন ব্যাপার নেই| ভূমিকায় যেমন বলেছি আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় গুলো আসলে টিচিং বিশ্ববিদ্যালয়| আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে গবেষণার জন্য ভালো ল্যাব নেই, আধুনিক মেশিন নেই, ফান্ড নেই, পিএইচডি বা এমফিল এর স্টুডেন্ট নেই তাহলে গবেষণা হবে কি করে? তাই আমাদের শিক্ষকরা আসলে টিচিং একাডেমিক| কিন্তু আমরা শিক্ষকদের প্রোমোশনের জন্য এক উদ্ভট নিয়ম করে রেখেছি সেটা হলো জার্নালে গবেষণা পত্র পাবলিকেশন| যেখানে শিক্ষকরা করেনই মূলত টিচিং, সেখানে তাদের টিচিং এর কোয়ালিটি মূল্যায়ন না করে গবেষণা পত্রের সংখ্যা দিয়ে প্রমোশন দেয়া হয়| এমন আজগুবি নিয়ম পৃথিবীর কোন ভালো বিশ্ববিদ্যালয়ে নেই| যারা শুধু টিচিং একাডেমিক তাদের মূল্যায়ন করতে হবে তাদের টিচিং কোয়ালিটি নিয়ে| বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক বলেই তাকে জোর করে গবেষক বানাতে হবে এমন কোন বাধ্যবাধকতা নেই| টিচিং একাডেমিকদের মূল্যায়নের জন্য তাদের ক্লাসরুম এর পারফরমেন্স, শিক্ষার্থীদের দ্বারা তাদের শিক্ষকতার মূল্যায়ন, পরীক্ষার খাতা দেখা ও রেজাল্ট তৈরিতে সময়ানুবর্তীতা, ডিপার্টমেন্টের প্রশাসনিক কাজে দক্ষতা, শিক্ষকতা বিষয়ে প্রফেশনাল ট্রেনিং বা অতিরিক্ত ডিগ্রি এবং শিক্ষকতা বিষয়ে ইনোভেশন ইত্যাদি বিষয়ের উপর গুরুত্ব দিতে হবে এবং এগুলোর উপর ভিত্তি করেই তাদের প্রোমোশনের ব্যবস্থা করতে হবে|
তাহলে বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণা বা রিচার্স একাডেমিক কিভাবে তৈরী করতে হবে? তাদের কি কাজ হবে? সেটাই বলছি পরবর্তী অংশে|
২.গবেষনা বা রিচার্স একাডেমিক এবং রিসার্চ ইনস্টিটিউট
পৃথিবীর অনেক বিখ্যাত ইনস্টিটিউট আছে যারা বিশ্ববিদ্যালয় এর নাম এর চেয়ে নিজ নাম এ বেশি পরিচিত| নিজের গবেষণার কারণে এরকম কিছু বিখ্যাত ইন্সটিউটে কাজ করার সুযোগ হয়েছে| যেমন অস্ট্রেলিয়ান ইনস্টিটিউট ফর বায়োইঞ্জিনিয়ারিং এন্ড ন্যানোটেকনোলজি বা এআইবিএন, ডানা ফারবার ক্যান্সার ক্যান্সার ইনস্টিটিউট এবং হারবার্ট আরভিং কম্প্রিহেন্সিভ ক্যান্সার সেন্টার| এআইবিএন কুইন্সল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি ইনস্টিটিউট হলেও অস্ট্রেলিয়াতে এটাকে সবাই এক নাম এ চিনে এই ইনস্টিটিউট এর উচ্চমানের গবেষণার জন্য| তেমনি ডানা ফারবার, হার্বার্ট আরভিং ক্যান্সার সেন্টার, এম ডি এন্ডারসন ক্যান্সার সেন্টার, ব্রড ইনস্টিটিউট, এবং বেথ ইজরাইল ডিকনেস সেন্টার ইত্যাদি ইনস্টিটিউট গুলো নিজ নামে সারা পৃথিবীতে গবেষকদের কাছে পরিচিত| এই ইনস্টিটিউট গুলো কোনো না কোন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন ইনস্টিটিউট যেখানে শুধু রিসার্চ একাডেমিকরা কাজ করে| এই ইন্সটিউট গুলোতে মূলত গবেষণা হয় এবং এখানে রিসার্চ একাডেমিকদের সুপারভিশনে কাজ করে মাস্টার্স বা পিএইচডি স্টুডেন্টরা তাদের ডিগ্রি অর্জন করে থাকে সংশ্লিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয় থেকে| আর রিসার্চ একাডেমিক দের মূল্যায়ন হয় তাদের গবেষণা পত্র পাবলিকেশনের সংখ্যা ও সেগুলোর মান, নিজস্ব গবেষণা ফান্ডিং আনার পরিমান, স্টুডেন্ট সুপারভিশন, গবেষণার উপর প্যাটেন্ট এবং কোন কোম্পানি কর্তৃক সেটার লাইসেন্স, স্পিন অফ কোম্পানি প্রতিষ্ঠা, ইনস্টিটিউট এর প্রশাসনিক কাজ ইত্যাদি| আবার এই রিসার্চ একাডেমিক রা যেমন টিচিং করতে পারেন তেমনি টিচিং একাডেমিক রাও গবেষণা করতে পারেন| সেই কারণে টিচিং এন্ড রিচার্স একাডেমিক নামেও একটা ভাগ আছে যারা তাদের টিচিং ও রিসার্চ এর কাজটা ভাগ করে করেন| সেই ক্ষেত্রে তাদের মূল্যায়ন হয় দুই বিষয়েই তাদের কাজ এর মান এর উপর| এই টিচিং এন্ড রিসার্চ একাডেমিক রা মূলত ইনস্টিটিউট আর ডিপার্টমেন্টের মধ্যে একটা ব্রিজ হিসেবে কাজ করেন এবং স্নাতক পর্যায়ের শিক্ষার্থীরা এর মাধ্যমে গবেষণার সাথে পরিচিত হন | এতে করে বিশ্ববিদ্যালয়ে টিচিং ও রিসার্চ এর একটি সুন্দর মিলন হয়| কোন শিক্ষক যদি টিচিং করে একঘেঁয়েমি চলে আসলে রিচার্স এ চলে আসতে পারেন আবার কারো গবেষণায় একঘেঁয়েমি চলে আসলে টিচিং এ যুক্ত হতে পারেন| সেই সাথে তরুণ ও স্নাতক শিক্ষার্থীরা তাদের সিনিয়র মাস্টার্স বা পিএচডি শিক্ষার্থীদের গবেষণা দেখে গবেষণার প্রতি অনুপ্রাণিত হয় এবং পরবর্তী সময়ে গবেষণায় আগ্রহী হলে তারা তাদের পছন্দের বিষয় নিয়ে গবেষণা করে এম ফিল বা পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করতে পারেন| এই ভাবে বিশ্ববিদ্যালয়টি তখন গবেষণার মাধ্যমে জ্ঞান তৈরির কেন্দ্র হয়ে উঠে| আর টিচিং ও রিসার্চ এর সুন্দর মিলন এর মাধ্যমে জ্ঞান বিতরণ ও জ্ঞান তৈরী করে বিশ্ববিদ্যালয়টি একটি পরিপূর্ণ বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিণত হয়|
অতএব আমাদের কি করতে হবে? বিশ্ববিদ্যালয়কে জ্ঞান তৈরির কেন্দ্র করতে হলে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিতরে এই ধরণের অনেক রিসার্চ ইনস্টিটিউট তৈরী করতে হবে এবং এইসব রিসার্চ ইনস্টিটিউট গুলোতে বিশ্বমানের রিসার্চ একাডেমিক নিয়োগ দিতে হবে| এই ক্ষেত্রে চায়না র মডেল ফলো করা যেতে পারে| চায়না এখন পৃথিবীর নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়ে তাদের যেসব টিচিং ও রিসার্চ একাডেমিক আছে তাদেরকে বিশেষ প্রণোদনা দিয়ে এই সব রিসার্চ ইনস্টিটিউটে নিয়ে আসতেছে তাদের দেশে বিশ্বমানের ইনস্টিটিউট গড়ে তোলার জন্য| পৃথিবীর নামকরা বিশ্ববিদ্যালয় গুলোতে আমাদেরও অনেক বিশ্বমানের টিচিং ও রিসার্চ একাডেমিক আছেন যারা দেশের শিক্ষা ও গবেষণায় অবদান রাখতে চান কিন্তু এই ধরণের কোন প্লাটফর্ম পাচ্ছেননা যার মাধ্যমে তারা সেই কাজটি করতে পারেন| চায়না মডেল এর মতো এই ধরণের রিসার্চ ইনস্টিটিউটগুলোতে বিদেশে নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়ে অবস্থিত আমাদের টিচিং ও রিসার্চ একাডেমিকদেরও আমরা ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ নিতে পারি| এই ইনস্টিটিউটগুলো তাদের দেশের কাজে অবদান রাখার সুযোগ করে দিবে| এতে করে যে ব্রেইন ড্রেইন হয়েছিলো এতদিন, সেটা কয়েকগুন ব্রেইন গেইন নিয়ে ফিরে আসবে| সেই সাথে দেশে গবেষণার সংস্কৃতি গড়ে উঠবে এবং এই ইনস্টিটিউট গুলোর মাধ্যমে দেশের বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই বিশ্বমানের এমফিলও পিএইচডি গ্রেজুয়েট তৈরী হবে|
এই গবেষনা কেন্দ্র গুলোতে কি ধরণের গবেষণা হবে, ফান্ডিং কোথা থেকে আসবে, বিশ্ববিদ্যালয় কিভাবে স্বয়ংসম্পূর্ণ হবে এবং আধুনিকীকরণের জন্য কি উদ্যোগ নিতে হবে এই বিষয়গুলো থাকবে পরবর্তী পর্বে| সেই পর্যন্ত সাথেই থাকুন|