বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪

এ বিকৃত বিতর্ক বন্ধ হোক

সোমবার, এপ্রিল ১৯, ২০২১
এ বিকৃত বিতর্ক বন্ধ হোক

 ডা. আফতাব হোসেন :

এতদিন জানতাম, চেনা বামুনের পৈতা লাগে না। এখন দেখছি, আধা ডজন পৈতা ঝুলিয়েও বামুন হওয়া যায় না। সাথে জন্ম কুষ্ঠিও থাকতে হয় ! নইলে মন্দিরে যাওয়া যায় না ! 

মূল বিষয়ে আসার আগে একটু ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা শেয়ার করে নিই। বছর তিনেক আগের কথা। বউ ছেলে নিয়ে যাচ্ছিলাম কুয়াকাটায়। তখন দেশে আসলেই এক বন্ধু তার ব্যক্তিগত গাড়িটি আমাকে ধার দিত সার্বক্ষণিক ব্যবহারের জন্য। বাকের গঞ্জ পার হওয়ার কিছু পরেই রাস্তার বাম পাশে দাঁড়ানো একদল হাইওয়ে পুলিশ গাড়ির গতি রোধ করল। কাগজপত্র চেক করল। গাড়ির বনেট খুলে চেক করল। কোথায় যাচ্ছি, জানতে চাইল। তারপর শুভ কামনা জানিয়ে বিদায় দিল। নিরাপত্তার খাতিরে পুলিশের এই রুটিন চেক আপ ও তাদের পেশাদারী মনোভাব দেখে আমি বিরক্ত না হয়ে বরং নিরাপদ বোধ করলাম। আমিও তাদের ধন্যবাদ জানিয়ে রওনা দিলাম। 

মাইল পাঁচেক পরেই  দেখি রাস্তার ডান পাশে আর এক দল হাইওয়ে পুলিশ। তারাও হাত উঁচু করে গাড়ি থামাল। আবারও চেক? 

যদিও আমার ধারণা এই পুলিশ দলের রাস্তার উল্টো দিক থেকে আসা গাড়ি চেক করার কথা। রাস্তায় গাড়ি খুবই কম। নাই কাজ তো খই ভাঁজ। তাই বোধহয় আমাদের দাঁড় করানো। আমি ড্রাইভারকে কাগজপত্র নিয়ে যেতে বললাম।  

বেশ কিছু সময় কেটে গেল। ড্রাইভার আর আসে না। আমি ঘাড় উল্টে চেয়ে দেখি বেশ কথা বার্তা হচ্ছে ড্রাইভার ও পুলিশের সাথে। ওদিকে সাগর কন্যা ডাকছে আমায়। কখন সূর্যাস্তের আবীর মাখব গায়। অকারণ কালক্ষেপণে এবার রীতিমত বিরক্ত আমি। দেখি ড্রাইভার ঘাড় নিচু করে খালি হাতে ফিরে আসছে। এসে বলল, 

- ছার, হালার পুতে কাগজপত্র রাইখা দিছে। কী সব উল্টা পালটা কথা কয়। মনে হয় ট্যাহা খাওনের ধান্দা। আপনে একটু যান। 

- মুখ খারাপ করো না হালিম। তোমার কাগজপত্র সব ঠিক আছে ?

- হ’ ছার। সব ঠিক। একটু আগেই তো চেক করল।

- আচ্ছা, আমি দেখছি।

আমি রাস্তা পার হয়ে ওপারে গেলাম। অফিসার গোছের একজন পুলিশ মটর সাইকেলের উপর এক হাঁটু তুলে দিয়ে দাঁড়ানো। সাথে দুজন সেপাই। আমি শান্ত ভাবে জানতে চাইলাম,

- এনি প্রব্লেম অফিসার ?

- আপনের নাম ?

- ডাঃ আফতাব হোসেন।

- কই যান ?

- কুয়াকাটা।

- কই থেইক্যা আসতেছেন।

- খুলনা।

- কিন্তু গাড়ি তো ঢাকার রেজিস্ট্রেশন।

- তাতে অসুবিধা কী ? 

- অসুবিধা তো আছেই। গাড়ি কি আপনের ?

- না। আমার এক বন্ধুর।

- রেন্টে নিছেন ?

- না। এমনিই ব্যবহার করতে দিয়েছে।

- এইডা আমারে বিশ্বাস করতে বলেন ? 

- বিশ্বাস না হলে গাড়ির মালিকরে ফোন করে দেখতে পারেন।

- ফোন করলে সে যে সত্য কথা কইব, তার গ্যারান্টি কী ? আপনে জানেন না, অমুক ধারা অনুযায়ী ব্যক্তিগত নামে রেজিস্ট্রেশন করা গাড়ি রেন্টে দেয়া যায় না।

 একটু আগে বাংলাদেশ পুলিশের পেশাদারিত্ব নিয়ে যে ধারণা জন্মেছিল, তা কর্পূরের মতো উবে গেল। বুঝলাম, ব্যাটা আমাকে হাইকোর্ট দেখাতে চাইছে। আইনের এই ধারা সম্পর্কে আসলেই আমার কোনো ধারণা নাই। বিরক্তি চেপে রেখে হাসি মুখে বললাম,

- বললাম তো ভাই, রেন্টে নিই নাই। তা এখন আমাকে কী করতে হবে ?

- থানায় যেতে হবে। 

আমি বেশ বুঝতে পারছিলাম, থানার কথা বলে আমাকে হয়রানি করার চেষ্টা করছে। যদিও থানায় নিয়ে কোনো সুবিধা করতে পারবে না। কিন্তু বউ বাচ্চা নিয়ে বেড়াতে এসে এই ঝামেলা কার ভালো লাগে ? আমি এও বুঝতে পারছিলাম, শ’দুই টাকা হাতে গুঁজে দিলে হয়ত ঝামেলা সেখানেই মিটে যেত। কিন্তু আমি কি চোর না স্মাগলার যে ঘুষ দেব ? ঘুষ আমি কিছুতেই দেব না। অথচ কী করব, তাও বুঝতে পারছিলাম না। আমার না আছে অহংকার করার মতো পিতৃ পরিচয়। না আছে রাজনৈতিক কিংবা এলাকা ভিত্তিক কোনো  পরিচয়। না আছে মামা খালুর জোর বা গলার জোর। নিজেকে খুব অসহায় লাগছিল। বিরক্তি ছাপিয়ে রাগ সপ্তমে উঠে যাচ্ছিল। হঠাৎ মনে পড়ল, বিশেষ কারণে বাংলাদেশ সরকার আমাকে ছোট্ট একটা কার্ড দিয়েছে। এয়ারপোর্টের ভি আই পি টার্মিনাল ছাড়া আর কোথাও তেমন কাজে লাগে না। মানি ব্যাগেই পড়ে থাকে। সেটা বের করে পুলিশ অফিসারটিকে দিয়ে বললাম,

- এটা ভালো করে দেখেন। তারপরও যদি আপনার মনে হয়, আমাকে থানায় নেবেন, তাহলে নিতে পারেন।

 লোকটা চোখ কুঁচকে পাকা জহুরির মতো কার্ডটা উল্টেপাল্টে দেখল। তারপর গাড়ির কাগজপত্র সহ কার্ডটি ফেরত দিতে দিতে বিরক্তির সাথে বলল,

- আগে দেখাইবেন তো ! হুদাহুদি সময় নষ্ট ! যান।

আমি কিছুক্ষণ ফ্যালফ্যাল করে পুলিশ অফিসারটির দিকে তাকিয়ে থাকলাম। মনে মনে বললাম, “এ কেমন কথা ? বিশেষ কার্ড থাকলে এক ব্যবহার, না থাকলে অন্য ব্যবহার ?” তবে মুখে কিছু না বলে চলে এলাম। কী লাভ কথা বাড়িয়ে ? সব পুলিশ তো এক না। নইলে মাত্র পাঁচ মাইলের ব্যবধানে একই দেশের একই এলাকার দুই দল পুলিশের এমন সম্পূর্ণ বিপরীত আচরণ হবে কেন ? তবে সেই থেকে ম্যাজিক কার্ডটা পকেটেই রাখি। বলা তো যায় না, কখন দরকার হয়ে পড়ে !

এবার মূল কথায় আসি। কে যেন বলেছিল, “বাঙ্গালির স্বভাব মানুষের পশ্চাৎ দেশের মতো। সব সময়, সব ব্যাপারে, দ্বিধা বিভক্ত !” তা সে রাজনীতি হোক, মানবিক কাণ্ড হোক, করোনা ভ্যাকসিন হোক কিংবা কোনো অনাকাঙ্ক্ষিত অপ্রীতিকর ঘোটনাই হোক। হুজুগে মাতাল বাঙালি আমরা। এত দিন মেতে ছিলাম মামুনুলের গোপন মানবিক কাণ্ড নিয়ে। এখন মেতে আছি পুলিশ/ম্যাজিস্ট্রেট বনাম ডাক্তারদের নিয়ে। এ নিয়ে পক্ষে বিপক্ষে ঝড় বয়ে যাচ্ছে ইথারে। এক পক্ষ আর এক পক্ষকে দুষছে। অথচ কেউ নিজেদের দোষ স্বীকার করছে না। 

গাড়ির উইন্ড শিল্ডে লাগানো ১০/৪/২১ তারিখে ইস্যু করা নাম ও ছবি সহ “সম্মুখ সারির স্বাস্থ্য-কর্মীর চলাচল সার্টিফিকেট, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই দুইটা বড় স্টিকার, ভদ্র মহিলার পরনে এপ্রোন, সেই এপ্রোনেও বিএসএমএমইউ ও তার নাম অঙ্কিত করা, বামুনের এতগুলো পৈতার কিছুই আমলে নিলো না মন্দিরের রক্ষক (?), পুলিশ ও ম্যাজিস্ট্রেট ! তারা বারবার জন্ম-কুষ্ঠি দেখতে চাওয়ার মতো ডাক্তারের আইডি কার্ড দেখতে চাইলেন। দায়িত্ব পালন করতে যেয়ে তারা যে কারো আইডি কার্ড দেখতে চাইতেই পারেন, কিন্তু উপরোল্লিখিত সব নিদর্শন বাদ দিয়ে শুধু একটা নিদর্শন নিয়ে টানা হেঁচড়া করা আমার কাছে তাদের অপেশাদারি মনোভাব ও ক্ষমতার অপব্যবহার বলে মনে হয়েছে। যেমন দেখেছিলাম গত বছর লক ডাউনের সময় মাস্ক না পরার জন্য এক ম্যাজিস্ট্রেট কর্তৃক এক বৃদ্ধকে কান ধরে উঠবস করাতে। 

এক পক্ষ যখন ক্ষমতার অপব্যবহার করে, অন্য পক্ষও তখন ক্ষমতার দম্ভ দেখাতে বাধ্য হয়। ফলশ্রুতিতে ডাক্তার সাহেবানও তাঁর পদমর্যাদা (যুগ্ম সচিব) এবং পিতৃ পরিচয় বলতে বাধ্য হলেন। সচিব ও মন্ত্রীকে ফোন করে পুলিশ ও ম্যাজিস্ট্রেটকে কথা বলতে বললেন। ক্ষমতায় ক্ষমতায় কাটাকাটি হয়ে একটা রফাদফা হয়ে গেল। ঘটনাটা এই পর্যন্ত হলে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে খুব একটা অস্বাভাবিক মনে হত না। যেটা অস্বাভাবিক মনে হয়েছে, সেটা হল, ডাক্তার সাহেবানের উচ্চস্বরে অশালীন ভাষার প্রয়োগ। মানুষ মাত্রেই রাগ হতে পারে। কিন্তু সে রাগকে নিয়ন্ত্রণ করার মাঝেই তো মনুষ্যত্বের প্রমাণ ! আমাদের মনে রাখতে হবে, মানুষের পরিচয় যতটা না তাঁর পেশায়, পদমর্যাদায়, পদবী কিংবা পিতৃ পরিচয়ে, তাঁর চেয়ে অনেক বেশি তাঁর কথায়, তাঁর ব্যবহারে, তাঁর আচরণে, তাঁর বিনয়ে। 

অদৃশ্য শত্রু করোনার সাথে যুযছে পৃথিবী, যুযছে স্বদেশ। দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে মৃত্যুর মিছিল। এই অসম যুদ্ধে প্রাণ বাজি রেখে যুদ্ধ করছেন যারা, তাদের মধ্যে অবশ্যই ডাক্তার ও পুলিশ অন্যতম। রাত দিন তারা যথাক্রমে হাসপাতালে ও রাস্তায় মানুষের সেবা করে যাচ্ছেন। ইতোমধ্যেই এই দুই পেশার অনেক মানুষ প্রাণ দিয়েছেন। জাতি তাদের এই আত্মত্যাগ কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণ করবে। দু একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা এই দুই মহান পেশার মানুষের সেবা ও ত্যাগকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে পারে না। যারা এই ঘটনা নিয়ে ডাক্তার কিংবা পুলিশকে ট্রল করছেন, পক্ষে বিপক্ষে অহেতুক বিতর্কে জড়াচ্ছেন, তারাই বরং নিন্দার কাজ করছেন। 

এ বিকৃত বিতর্ক বন্ধ হোক। আসুন, দেশ ও জাতির এই দুঃসময়ে আমরা এই দুই মহান পেশার মানুষের পাশে দাড়াই, তাদের কাজের সম্মান করি। আসুন আমরা সবাই লক ডাউন ও স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলি।


Somoy Journal is new coming online based newspaper in Bangladesh. It's growing as a most reading and popular Bangladeshi and Bengali website in the world.

উপদেষ্টা সম্পাদক: প্রফেসর সৈয়দ আহসানুল আলম পারভেজ

যোগাযোগ:
এহসান টাওয়ার, লেন-১৬/১৭, পূর্বাচল রোড, উত্তর বাড্ডা, ঢাকা-১২১২, বাংলাদেশ
কর্পোরেট অফিস: ২২৯/ক, প্রগতি সরণি, কুড়িল, ঢাকা-১২২৯
ইমেইল: somoyjournal@gmail.com
নিউজরুম ই-মেইল : sjnewsdesk@gmail.com

কপিরাইট স্বত্ব ২০১৯-২০২৪ সময় জার্নাল