শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪

করোনা ছড়ানো নিয়ে নতুন ধোঁয়াশা…

শুক্রবার, এপ্রিল ২৩, ২০২১
করোনা ছড়ানো নিয়ে নতুন ধোঁয়াশা…

ডা. আফতাব হোসেন :

- বুড়ার আমার কী হইছে ? এই রাইত দুপুরে না ঘুমাইয়া ঝিম মাইরা বইসা রইছো যে।

ক’দিন ধরেই মনটা ভালো নেই আমার। কাছের ও দূরের প্রিয় মুখগুলো হারিয়ে যাচ্ছে একে একে। গত এক সপ্তাহ ধরে প্রতিদিন একশোর কাছাকাছি করোনায় মৃত্যু দেখছে বাংলাদেশ। মন খারাপের এই দিনগুলোতে নিজেকে যখন খুব অসহায় লাগে, কেমন করে জানি তা জোনাক কন্যা টের পেয়ে যায়। ছোট্ট পাখায় ভর করে উড়ে আসে জোনাক রাজ্য থেকে। নীল পিদিম জ্বালিয়ে দেয় আমার মাথার ভেতর। ওর কিশোরী কৌতূহল, ওর অহেতুক সন্দেহ, ওর অবুঝ অভিমান, ওর রমণীয় খুনসুটি, আমার মন ভালো করে দেয়। আজ ওর কথায় আমার তেমন কোনো ভাবান্তর হয় না। আনমনে বলি,

- ঘুম আসছে না জোনাকি।

- কেন ?

- এত মৃত্যু আমি আর নিতে পারছি না কাজল রাণী। তার উপর লকড ডাউন হয়ে ঘরে বসে আছি। একটু যে খোলা হাওয়ায় নিশ্বাস নেব, তারও উপায় নাই। কখন আবার আইডি কার্ড নাই বলে পুলিশ মামলা ঠুকে দেয়।

- তোমার তো দুই ডোজই ভ্যাকসিন নেয়া হয়ে গেছে। এতদিনে নিশ্চয়ই ইমিউনিটিও তৈরি হয়ে গেছে। সরকারও কয়েকদিনের মধ্যে লক ডাউন তুলে নেবে। কাল থেকে শপিং মল, দোকান পাটও খুলে যাচ্ছে। তোমার আর চিন্তা কী ? বন্ধুদের নিয়ে নিজের গাড়িতে ঘুরে বেড়াতে পারবে।

- শুধু নিজেকে নিয়ে ভাবলে তো ইংল্যান্ডের নিরাপদ আশ্রয়েই থেকে যেতাম। ভাবছি এই পোড়া দেশটাকে নিয়ে। ভাবছি এই দেশের অসচেতন মানুষগুলোকে নিয়ে। ভাবছি উভয় সংকটে পড়া এই দেশের সরকারকে নিয়ে। 

- কী রকম ?

- দেখো, দীর্ঘ সময় ধরে কঠোর লক ডাউন দিলে অর্থনীতির চাকা থেমে যায়। খেঁটে খাওয়া মানুষগুলোর করোনায় না হলেও ক্ষুধায় মারা যাবার উপক্রম হয়। এমনিতেই এ দেশের মানুষ স্বাস্থ্য সচেতন নয়। তার উপর আবার লক ডাউন তুলে নিলে মানুষ হুমড়ি খেয়ে পড়বে কেনাকাটায়। ঈদের ছুটিতে ছুটবে শহর ছেড়ে গ্রামের বাড়িতে। এখন তাও করোনা মূলত বড় বড় শহরে সীমাবদ্ধ। আবার তা ছড়িয়ে পড়বে সারা বাংলাদেশে। গতবার ঈদে মানুষকে যার যার অবস্থানে আঁটকে রাখতে পারেনি সরকার। এবারও যদি সেই ভুল করে বসে !   

- হুম। আসলেই উভয় সংকটে আছে তোমাদের সরকার।

- শুধু তাই নয় কাজল রাণী। করোনা ছড়ানো নিয়ে তৈরি হয়েছে নতুন ধোঁয়াশা। 

- সেটা আবার কী রকম ?

- ব্যাপারটা জটিল। তবে যতদূর পারি, সহজ করে বলছি। তোমার মনে আছে ? বছর খানেক আগে বলেছিলাম, করোনা বাতাসের মাধ্যমেও ছড়াতে পারে। গত সপ্তায় ল্যান্সেট নামক মেডিকেল জার্নালে একটা আর্টিকেল বেড়িয়েছে। সেখানে বিজ্ঞানীরা কমপক্ষে দশটা কারণ দেখিয়েছেন, যার দ্বারা ধারণা করা যায়, করোনা শুধু ক্লোজ কন্টাক্ট বা ড্রপলেট এর মাধ্যমেই নয়, এরোসল বা বাতাস বাহিত হয়েও ছড়াতে পারে। 

-  একটু ভেঙ্গে বলো।

- দেখো, ড্রপলেট হল অতি ক্ষুদ্র পানি বা লালার বেলুন (bubble) যা আমরা হাঁচি কাশি দিলে বের হয়। করোনা আক্রান্ত রুগী হাঁচি কাশি দিলে করোনা ভাইরাস সেই বেলুন ভরে বের হয়। যেহেতু ড্রপলেট অপেক্ষাকৃত বড় ( পাঁচ মাইক্রোমিটারে উপরে) ও ভারি, বেশি দূরে যায়ও না, আবার বেশীক্ষণ বাতাসে ভেসেও থাকতে পারে না। নীচে পড়ে যায়। তাই করোনা প্রতিরোধের জন্য ছয় ফুট দূরত্ব (সামাজিক দূরত্ব) বজায় রাখা, বারবার হাত ধোয়া, আসবাব পত্র, দরজার হ্যান্ডল ইত্যাদি জীবাণুনাশক দিয়ে পরিষ্কার করা, মাস্ক পড়া ইত্যাদি স্বাস্থ্যবিধির কথা বলা হত। 

- আর এরোসল ?

- এরোসল হল পাঁচ মাইক্রোমিটারের চাইতে ছোট জলীয় বেলুন, যা কথা বলা, হাসি বা গান গাওয়ার মাধ্যমেও বের হয়। এই এরোসল অনেকক্ষণ (তিন ঘণ্টা পর্যন্ত) বাতাসে ভেসে থাকতে পারে। তাই সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখলেও তুমি অজান্তেই অনেক আগে থেকে বাতাসে ভেসে থাকা সেই এরোসল নিশ্বাসের সাথে বুকে নিতে পারো। যে মাস্ক আমরা ব্যাবহার করছি, তা এরোসল প্রতিরোধ করার জন্য যথেষ্ট কার্যকরী নয়। 

- বলো কী ? তা বিজ্ঞানীরা কী ভাবে বুঝল যে করোনা এরোসলের মাধ্যমেও ছড়াতে পারে ?

- অনেকগুলো কারণ তাঁরা বলেছেন। সব বুঝবে না। সহজ ভাবে বলতে গেলে, 

এক. উন্নত বিশ্বে, যেমন ইউরোপ, আমেরিকা, যেখানে মানুষ অনেক স্বাস্থ্য সচেতন, স্বাস্থ্যবিধিও বেশি মেনে চলে, তবুও সে সব দেশে যে দ্রুত হারে করোনা ছড়িয়েছে, তা তাদের ভাষায় বাতাস বাহিত বা এরোসল সংক্রামণের দ্বারাই সম্ভব। শুধু ড্রপলেট বা ক্লোজ কন্টাক্টের মাধ্যমে সম্ভব নয়।  

দুই, করোনা কোয়ারেন্টাইন হোটেলে কেউ কারো সংস্পর্শে না এসেও করোনা আক্রান্ত হয়েছে, এমন উদাহরণ আছে।

তিন, প্রায় পঞ্চাশ ভাগ করোনা আক্রান্ত রুগীর কোনো উপসর্গ থাকে না। সুতরাং তাদের হাঁচি কাশিও তেমন থাকে না। কিন্তু তাদের কথা বলার সময় এরোসল বের হয় যাতে করোনা ভাইরাস থাকতে পারে এবং অন্যকে আক্রান্ত করতে পারে। এই জন্যই ৩৩% থেক ৫৯% ভাগ করোনা আক্রান্ত রুগী অন্য কোনো করোনা উপসর্গ-ওয়ালা রুগীর সংস্পর্শে এসেছে, এমন ইতিহাস পাওয়া যায় না। 

চার, যারা বদ্ধ ঘরে কিংবা এসি রুমে বাস করে, তাদের করোনা বেশি হয়, কিন্তু যারা খোলা আকাশের নীচে কিংবা খোলা মেলা ঘরে বাস করে কিংবা কাজ করে, তাদের করোনা কম হয়। কারণ, বদ্ধ ঘরে এরোসল অনেকক্ষণ ভেসে থাকে কিন্তু খোলা জায়গায় তা বাতাসে উড়ে যায় ও পাতলা হয়ে যায়, ফলে সংক্রামণের হার কমে যায়।

পাঁচ, বাংলাদেশের কথা যদি বাদও দেই, উন্নত বিশ্বে যেখানে ডাক্তাররা কন্টাক্ট ও ড্রপলেট ইনফেকশন থেকে বাঁচার জন্য উন্নত মানের পিপিই ব্যবহার করেও করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন, যা হয়ত এরোসল সংক্রামণের মাধ্যমেই সম্ভব। 

ছয়, করোনা রুগী ছিল এমন রুম বা গাড়ির বাতাস পরীক্ষা করে দেখা গেছে, তিন ঘণ্টা পর্যন্ত সেই বাতাসে জীবন্ত করোনা ভাইরাস পাওয়া গেছে। এটাও এরোসল হলেই সম্ভব। কারণ ড্রপলেট হলে এতক্ষণ বাতাসে ভেসে থাকত না, নীচে পড়ে যেত। 

সাত, কোভিড হাসপাতালের এয়ার ফিল্টারের মধ্যেও করোনা ভাইরাস পাওয়া গেছে যেখানে একমাত্র এরোসলের মাধ্যমেই যাওয়া সম্ভব, ড্রপলেটের মাধ্যমে নয়। 

- থামো, থামো, আর বলতে হবে না, আমার মাথা ঘুরতেছে। এই যে এত কথা বললা, এ সবই তো ধারণা বা হাইপোথেসিস। কোনোটাই তো প্রমাণিত সত্য নয়।

- তা ঠিক। তবে ধারণা বা হাইপোথেসিস থেকেই তো একদিন থিওরি বের হয় বা সত্য প্রমাণিত হয়। তাছাড়া কন্টাক্ট ও ড্রপলেট সংক্রামণও তো নিশ্চিত ভাবে প্রমাণিত সত্য নয়। 

- তার মানে তুমি কী কইতে চাইতাছো ? এই যে সামাজিক দূরত্ব, স্বাস্থ্যবিধি, এ সব কিছু মানার দরকার নাই ?

- না রে পাগলী, আমি তা বলতে চাচ্ছি না। তবে আমরা যে সবাই শুধু কন্টাক্ট ও ড্রপলেটের মাধ্যমে সংক্রামণের দিকে নজর দিচ্ছি, কিন্তু এরোসল সংক্রামণকে উপেক্ষা করছি, এটা ঠিক নয়। করোনা যদি সত্যি সত্যি এরোসলের মাধ্যমেও ছড়ায়, তাহলে তুমি যতই সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখো, যেমন এক সীট বাদ দিয়ে গাড়িতে বসো, আর সেই গাড়ি যদি এসি গাড়ি হয় এবং একজনও করোনা আক্রান্ত রুগী সেই গাড়িতে থাকে, তাহলে সে তার এরোসলের মাধ্যমে অনেককে আক্রান্ত করতে পারে।

আজ থেকে বিশ বছর আগেও অফিস আদালতে বড় বড় জানালা থাকত, মাথার উপর একাধিক ফ্যান বনবন করে ঘুরত, ঘরের মধ্যে তাজা হাওয়া খেলত, এখন সব অফিস আদালত থাই গ্লাসে মুড়ে বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। সব ঘরে এখন এসি চলে। সেই সব অফিসে যতই তুমি তাপমাত্রা মাপো, “নো মাস্ক, নো সার্ভিস”, মেনে চল, তুমি তো উপসর্গ বিহীন রুগী সনাক্ত করতে পারবে না। সে তো সেই বদ্ধ ঘরে কথা বলে, হেসে-খেলে এরোসল ছড়িয়ে যাবে, যার মধ্যে হয়ত থাকবে হাজার হাজার করোনা ভাইরাস।

আবার মাস্ক বলতে তো আমরা থুঁতনির কাছে একটা বহু ব্যবহৃত মুখোশ ঝুলিয়ে রাখি, সেটা আর যাই হোক, এরোসল ঠেকাতে পারে না। সুতরাং বদ্ধ পরিবেশে করোনার সংক্রমণের ঝুঁকি অনেক বেড়ে যাচ্ছে। একই কথা সেন্ট্রাল এসি যুক্ত বড় বড় শপিং মলগুলোর বেলায়ও প্রযোজ্য। এই জন্যই বোধহয় ধনী দেশগুলোতে কিংবা মধ্য এবং উচ্চবিত্ত মানুষের মধ্যে করোনা সংক্রামণের হার এত বেশি।

- হুম। তোমার কথায় যুক্তি আছে। তা এই এরোসল সংক্রামণের হাত থেকে বাঁচার উপায় কী ?

- আমরা যে স্বাস্থ্যবিধি বর্তমানে মেনে চলছি, তা তো অবশ্যই মানতে থাকব। তবে যেহেতু তা এরোসল সংক্রামণের হাত থেকে বাঁচাতে পারবে না, তাই আমাদের ভিড় ও বদ্ধ জায়গা এড়িয়ে চলতে হবে। এসি যুক্ত গণ পরিবহনে না চলে জানালা খোলা গাড়িতে চলতে হবে। নইলে বাইসাইকেল, মটর সাইকেল, রিক্সা, স্কুটারে চলা বেশি স্বাস্থ্য সম্মত হবে। অথবা হাঁটার অভ্যাস করতে হবে। খোলা জায়গায় বাজার ঘাট করতে হবে। সব চাইতে ভালো হয়, অনলাইনে কেনাকাটা করা। লিফট পরিহার করে সিঁড়ি ব্যবহার করতে হবে। অফিস আদালতে, বাসা বাড়িতে যতদূর সম্ভব, দরজা জানালা খোলা রেখে বাতাস প্রবাহের ব্যবস্থা করতে হবে যাতে ভাসমান এরোসল বাতাস উড়িয়ে নিয়ে যায়।  

- কোন বোকার স্বর্গে বাস করো তুমি ডাক্তার ? সাধারণ স্বাস্থ্যবিধিই মানে না বাঙালি, আর তুমি বলছ, এসি বাদ দিয়ে সব অফিস আদালত, বাসা বাড়ির থাই গ্লাস ভেঙ্গে আদি কালের মতো জানালা বানাতে ? করোনার হাত থেকে বাঁচতে আর কোনো সহজ উপায় আছে কিনা বলো ?

- আছে, যত দ্রুত সম্ভব, ভ্যাক্সিনেশনের মাধ্যমে ইমিউনিটি তৈরি করতে হবে।   

- সেটাই বা সহজ কোথায় ? তোমরা মানুষগুলা এতই বদ, যে জীবন রক্ষাকারী ভ্যাকসিন নিয়াও রাজনীতি করো। উল্টা পালটা কথা বলে মানুষের মাঝে ভ্যাকসিনের প্রতি নেতিবাচক মনোভাব তৈরি করো। সরকার বিনে পয়সায় ভ্যাকসিন দিচ্ছে, অথচ কেঁদে কেঁদেও তেমন সাড়া পাচ্ছে না।

- বড় বিচিত্র এই দেশ আর বিচিত্র এই দেশের মানুষ সেলুকাস !

- তার মানে, দিল্লী হনুজ দূরস্ত ?

- অপ্রিয় হলেও সেটাই সত্যি কাজল রাণী !

বিদ্রঃ এটি একটি সামাজিক সচেতনতা মূলক পোস্ট। চাইলে নির্দ্বিধায় শেয়ার কিংবা কপি পেস্ট করতে পারেন।


Somoy Journal is new coming online based newspaper in Bangladesh. It's growing as a most reading and popular Bangladeshi and Bengali website in the world.

উপদেষ্টা সম্পাদক: প্রফেসর সৈয়দ আহসানুল আলম পারভেজ

যোগাযোগ:
এহসান টাওয়ার, লেন-১৬/১৭, পূর্বাচল রোড, উত্তর বাড্ডা, ঢাকা-১২১২, বাংলাদেশ
কর্পোরেট অফিস: ২২৯/ক, প্রগতি সরণি, কুড়িল, ঢাকা-১২২৯
ইমেইল: somoyjournal@gmail.com
নিউজরুম ই-মেইল : sjnewsdesk@gmail.com

কপিরাইট স্বত্ব ২০১৯-২০২৪ সময় জার্নাল