মোহাম্মদ বাহাউদ্দিন:
গোটা মানবজাতির জন্য ইসলাম এক কল্যাণধর্মী জীবনবিধান, যার প্রধানতম অনুষঙ্গ হলো শিক্ষা। শিক্ষা বা জ্ঞানকে আলো আর অজ্ঞানতা বা মূর্খতাকে অন্ধকারের সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে। ইসলামের পবিত্র ঐশী মহাগ্রন্থ আল কোরআনের প্রথম নাজিলকৃত আয়াতে কারিমাতেও আমরা সেই শিক্ষা ও জ্ঞানের অনুপম প্রকাশ দেখতে পাই। ইরশাদ হচ্ছে- ‘ইকরা বিসমি রাব্বিকাল্লাজি খালাক’ অর্থাৎ পড়ো তোমার সেই প্রতিপালকের নামে, যিনি তোমায় সৃষ্টি করেছেন।
খ্রিষ্টীয় ষষ্ঠ শতকে আরবের মরুময় যেই সমাজ ও সময়ে ইসলামের আবির্ভাব ঘটেছে ইতিহাসের ভাষায় তাকে ‘আইয়ামে জাহেলিয়া’ তথা অন্ধকারের যুগ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। মূলত শিক্ষা ও জ্ঞানের অনুপস্থিতি ও অভাবের কারণেই তদানীন্তন আরব সমাজ মানবেতিহাসের ভয়াবহ অজ্ঞানতা তমসাচ্ছন্নতায় নিমজ্জমান ছিল। অজ্ঞানতা আর মূর্খতার কারণেই তারা সব ধরনের বর্বরতার সীমা ছাড়িয়ে গিয়েছিল। তুচ্ছাতিতুচ্ছ কারণে তারা নিজেদের মধ্যকার ঝগড়া-বিবাদকে দীর্ঘস্থায়ী ও সর্ববিধ্বংসী যুদ্ধে রূপ দিত। জ্ঞানের আলোকমালার অভাবে তাদের পুরো পরিবেশ, সমাজ ও জীবনপ্রণালি এক অমানিশার ঘোর আঁধারে আচ্ছন্ন হয়ে সর্বনাশের কিনারে দাঁড়িয়েছিল। ইতিহাসের সর্বনিকৃষ্ট ও অজানা গহ্বর পানে দ্রুত ধাবমান এক অমানবিক সমাজ ও সময়ের কৃষ্ণ-আঁধারকে ঐশী জ্ঞানের আলোকচ্ছটায় উদ্ভাসিত করা হয়। জ্ঞানের আলোকেই বিশ্বের সবচেয়ে জঘন্য যুগকে মানবেতিহাসের সর্বোৎকৃষ্ট যুগে পরিণত করা হয়েছিল।
বিশ্বনবী মোহাম্মদ (সা.) সগৌরবে ঘোষণা করেছেন- ‘ইন্নামা বুইসতু মুআল্লিমান’ অর্থাৎ সুনিশ্চিতভাবে আমাকে পাঠানো হয়েছে শিক্ষক হিসেবে। তাই তিনি জাতি, ধর্ম, বর্ণ, গোত্র ও সম্প্রদায় নির্বিশেষে গোটা বিশ্বমানবতার মহান শিক্ষক। কেননা এই শিক্ষক পরিচয়ের মাঝেই নিহিত রয়েছে শিক্ষা ও জ্ঞানের মাহাত্ম্য, জ্ঞানের অন্তর্নিহিত গভীর তাৎপর্য। জাগতিক প্রাতিষ্ঠানিক জ্ঞান ও শিক্ষা সেই মহান শিক্ষা ও জ্ঞানকে কখনোই অতিক্রম করতে বা সমপর্যায়ে উপনীত হতে সক্ষম নয়।
সে জন্য ‘উম্মি নবী’ হয়েও তিনি ‘উস্তাজুল আসাতিজা’ তথা সব শিক্ষকের শিক্ষক হিসেবে স্বীকৃত। তাই জর্জ বার্নার্ড শর মতো আধুনিক বিশ্বের জ্ঞানী-শিক্ষিতরা সেই মহাজ্ঞানের ধারকের সর্বোন্নত আদর্শের কাছে আত্মসমর্পণ করেন। সব সংকীর্ণতার ঊর্ধ্বে উঠে এই তাবত জগৎ-সংসারের সমুদয় দায়দায়িত্ব তুলে দিতে চান মানবিকতা আর অসাম্প্রদায়িকতার মহান দূত মহানবী (সা.)-এর হাতে। যে জ্ঞান মানুষকে বুঝতে শেখায়, সুকুমার বৃত্তিগুলোর বিকাশ ঘটায়, উন্নত আদর্শ আর মহত্তম নীতিবোধকে জাগ্রত করে, পশুত্বকে পরাভূত করে, মানবিকতা আর সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও চারিত্রিক মূল্যবোধগুলো ফুটিয়ে তোলে, সৃষ্টিকে চিনতে আর পরম স্রষ্টাকে মানতে সাহায্য করে- সেটিই তো প্রকৃত জ্ঞান। ইসলাম সেই জ্ঞানকেই ‘আল ইলমু নূরুন’ অর্থাৎ জ্ঞানই হচ্ছে আলোক বলে অভিহিত করেছে।
সেই জ্ঞানার্জনের কোনো সুনির্দিষ্ট বয়সসীমা নেই, কেননা ‘উতলুবুল ইলমা লাহদি ইলাল মাহদি’- জ্ঞানার্জন করো দোলনা থেকে কবর পর্যন্ত। যে শিক্ষিত সে জানে, যে জ্ঞানার্জন করে সে জ্ঞানী সত্তায় পরিণত হয়। কোরআনে কারিমের ভাষায়, ‘হাল য়াসতাতিউনাল্লাজিনা য়ালামুনা ওয়াল্লাজিনা লা য়ালামুন’ যারা জানে আর যারা জানে না, তারা কখনো মর্যাদার দিক থেকে সমান হতে পারে না। বরং ‘য়ারফাউল্লাহু ল্লাযিনা আমানু মিনকুম ওয়াল্লাজিনা উতুল ইলমা দারাজাত’ তোমাদের মধ্যে যারা বিশ্বাস স্থাপন করেছে আর যাদের জ্ঞানের নেয়ামতে ভূষিত করা হয়েছে তাদের সর্বোন্নত মর্যাদার অধিকারী করা হয়েছে।
সমাজের এই জ্ঞানী শ্রেণির ব্যতিক্রমী বৈশিষ্ট্যও মহান স্রষ্টার কাছে স্বীকৃত। জ্ঞানীদের ব্যাপারে মহান আল্লাহর উল্লেখযোগ্য ঘোষণা- আমার সমগ্র সৃষ্টির মাঝে কেবল জ্ঞানীরাই আমাকে ভয় করার নীতি অবলম্বন করে চলে। যে প্রকৃত জ্ঞানী, মহান আল্লাহ তার কল্যাণকামী- আল্লাহতায়ালা যার কল্যাণ চান তাকে ইসলামের বিশুদ্ধ জ্ঞানদান করেন। মুসলিম শরিফের হাদিস অনুযায়ী মানুষের মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে তার সব আমল বন্ধ হয়ে গেলেও সেই জ্ঞানের বরকতময় ঝরনাধারার প্রস্রবণ অব্যাহত থাকে।
কোরআনে কারিমে শিক্ষা ও জ্ঞানের নেয়ামতকে সবকিছুর ঊর্ধ্বে স্থান দেয়া হয়েছে- ‘আর রাহমান আল্লামাল কোরআন খালাকাল ইনসান আল্লামাহুল বায়ান’ পরম দয়ালু আল্লাহ, শিক্ষা দিয়েছেন পবিত্র কোরআন, সৃষ্টি করেছেন মানুষ এবং তাকে শিখিয়েছেন ভাব প্রকাশের বিষয়াবলি। হজরত আদমের (আ.) যে শ্রেষ্ঠত্ব, তা মূলত জ্ঞানের কারণে- ‘ওয়া আল্লামা আদামাল আসমাআ কুল্লাহা’- আমি আদমকে শিক্ষা দিয়েছি বস্তুজগতের সব জ্ঞান।
লেখক: অধ্যাপক, ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
এমআই