মাইদুল ইসলাম:
ফেসবুক স্ক্রল করতে গিয়ে হঠাৎ হ্যান্ড পেইন্ট কাঠের কাপে চোখ আটকে গেল। ’এক সাথে পথ চলা’ ‘এক কাপ চায়ে শুধু তোমাকে চাই’ প্রিয়জনের জন্য লেখা লাইনের সঙ্গে হাতে করা নান্দনিক সব কারুকার্যের মিশেল চোখ আটকানোর কারণ। নি:সন্দেহে প্রিয়জনের কথা ভেবে এই হ্যান্ড পেইন্ট কাঠের চায়ের কাপ বানানো। ‘কাঠের শহর’ নামক ফেসবুক পেজটিতে এ পোস্ট দেখে আলাপ করি এর স্বত্বাধিকারী মৌমিতা ইসলামের সাথে। জানলাম তার হাতের তৈরি গহনার সমাহার ও আঁকা নানা ডিজাইনের কাঠের কাপ, সুপারি পাতার ওয়ালম্যাট, পাঞ্জাবি, জুটের ব্যাগ ইত্যাদির মাধ্যমে চাকরি ছেড়ে ব্যবসায়ী হওয়ার গল্প। একে একে জানালেন হ্যান্ড পেইন্ট পণ্য আর কাঠের শহরের গল্প। যার শুরুটা হয়েছিল করোনাকালে।
শিক্ষাজীবন থেকে ৯-৫টা চাকরি করতে চাওয়া মৌমিতা শুরুতে ভাবেইনি ব্যবসা দাড় করাতে পারবে।
”আমি সবসময় একটা সেটেলড ক্যারিয়ার চেয়েছিলাম। ৯:০০-৬:০০টা চাকরি করবো, এটাই ইচ্ছা ছিলো স্টুডেন্ট লাইফ থেকে। করেছিও কিছু দিন। কিন্তু ছেলের জন্য ছেড়ে দেই। ভেবেছিলাম ও একটু বড় হলে আবার চাকরির চেষ্টা করবো। কিন্তু তারপর করোনা চলে আসলো। তখন ঘরে বসে বসেই মনে হলো অনেক তো সময় নষ্ট হলো, অবস্থা কবে স্বাভাবিক হবে তাও জানি না। তো ঘরে বসেই কিছু করার চেষ্টা করা যাক। পারার মধ্যে ছোট বেলা থেকে একটা কাজই একটু পারতাম- তা হলো কার্টুন আঁকা! যদিও ছবি আঁকা বা এই কাঠের শহরের যত কাজ বলেন, কোনোটাই আমি শিখি নি বা কোর্স করি নি। ঐ ছোট বেলার আঁকা কে পুঁজি করেই, ৭ দিন ইউটিউব ঘাটাঘাটি করে, কিছু বেসিক আইডিয়া নিয়ে আল্লাহর নাম নিয়ে শুরু করে দিলা” বলছিলেন ‘কাঠের শহরের স্বত্বাধিকারী মৌমিতা ইসলাম।
ছবি- কাঠের শহরের সৌজন্যে
শুরুটা সহজ ছিলনা, তবে তার পরিকল্পনা ছিলো কিছু একটা করতে হবে, সময়টা কে কাজে লাগাতে হবে। নিজেকে আগে ঝালাই করতে হবে! কারণ কিছু একটা বানালেই তো হয়না, ওটা কে বিক্রি করার মতো করে বানাতে হবে! তাই প্রথম চ্যালেঞ্জটা ছিল যে কিভাবে নজর কাড়বে মানুষের।
মৌমিতা জানায়, আর এসব চলে না, কতো জন কেই দেখি এসব করতে, ধৈর্য্য রাখতে পারবা না- এসব শুনেছি টুকটাক। গায়ে লাগাই নি। আমার পরিবার আমার সাপোর্টে ছিলো, তাই নিজের উপর ভরসা টা অন্তত ছিলো যে যাই করি না কেনো, ওটা খারাপ হবে না। আর এভাবেই শুরু তার।
নকশা করা, ওটা কে এক্সিকিউট করা, নতুন কি করা যায় তার প্ল্যানিং করা, এই কাজ গুলো একাই করেন তিনি। কিন্তু ম্যাটেরিয়াল কেনা, ওগুলো কে ব্যবহার উপযোগী করা, প্রডাক্ট প্যাকেজিং- এগুলোর সিংহ ভাগ টাই করে তার বাবা। মৌমিতার কাজে সবসময় সহয়তা করে যাচ্ছেন তার বাবা-মা।
তিনি বলেন, এ কাজ একা আসলে করা সম্ভব হতোই না একদম। কারণ আমার বাচ্চা টা ছোট,ওকে একা রেখে কাজ করা যায় না। আমার বাবা-মা এই দিক গুলো তে এতো টাই সাপোর্ট দিয়ে যাচ্ছেন যে আমও নিশ্চিন্তে কাজ করতে পারি।
ছবি- কাঠের শহরের সৌজন্যে
শুরু টা হয়েছিল বিভিন্ন রকম কাঠের গয়না দিয়ে। তিনি যখন শুরু করেন, তখন কাঠের গয়না সম্পর্কে অনেকেই জানতেন, অলরেডি অনেক গুলো অনলাইন পেইজ স্টাবলিশড হয়ে গিয়েছিলো। তাদের মধ্যে থেকে আলাদা করে জায়গা পাওয়া টা একটু সময়ের ব্যাপার ছিলো।
”তবে এরপর আমার ৬-৭ মাসের মাথায় আমার সবচেয়ে ইউনিক প্রডাক্ট, হাতে আঁকা কাঠের কাপ আনি। আমার জানা মতে আমিই এই কাজ টা শুরু করি। আর এটা আমার ব্যবসায় সত্যি অনেক সাফল্য আনে, পরিচিতি পেতেও সাহায্য করে।”
ছবি- কাঠের শহরের সৌজন্যে
আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। এরপর আস্তে আস্তে কাস্টমাইজড পাঞ্জাবি, জুটের ব্যাগ, সুপারি পাতার ওয়ালম্যাট নিয়েও কাজ করেন। আর সামনে "ক্লে" নিয়ে আরও কাজ করার ইচ্ছা আছে তার।
নিজস্ব কিছু ক্রিয়েট করতে চায় মৌমিতা, যেটা দেখে একজন অন্তত যেনো বলে যে এটা মৌমিতা'র নিজের তৈরী, এটা কাঠের শহর-এর নিজস্ব প্রডাক্ট! এজন্যই হাতে বানানোর পণ্য নিয়ে কাজ করাটা বেছে নিয়েছেন তিনি।
’আমি চাইলেই বাজারের যেকোনো রেডিমেড প্রোডাক্ট এনে ব্যবসা করতে পারতাম। যেটাকে রিসেল বলে। কিন্তু ওটায় আমার নিজস্বতা বলে কিছু থাকতো না!’
’লকডাউনের সময় থেকে অনলাইন শপিং-এর চাহিদা অনেক বেড়ে গেছে। যদিও এখনো অনেক মানুষ অনলাইন সেলার দের বিশ্বাস করেন না! তবুও বেশির ভাগ মানুষ ব্যস্ততার জন্য হলেও অনলাইন শপিং-এ ঝুকছেন। আর এটাই আমাদের জন্য প্লাস পয়েন্ট! আমরা যারা হাতে তৈরী পণ্য নিয়ে কাজ করি,আমাদের কাজের ধরণ অনুযায়ী আপনাকে আপনার পছন্দ মতো এমন একটা পণ্য বানিয়ে দিতে পারবো,যেটা আর কারো নেই,শুধু আপনার আছে! এই ইউনিকনেস টা রেডিমেড পণ্যে নেই, চাইলেও এতো ভ্যারাইটি তারা আনতে পারবে না। এই জন্যই হাতে তৈরী পণ্যের চাহিদা দিন দিন বাড়ছে বলে জানান মৌমিতা ইসলাম।
এই অনলাইন ব্যবসার শুরু তে খুবই অল্প বিনিয়োগ ছিলো। ”এই কাজ শুরু করতে খুব বেশি বিনিয়োগ লাগে না। কিছু দিন ইন্টারনেট ঘাটাঘাটি করে একটু আইডিয়া করে নিলে অনেক অপ্রয়োজনীয় খরচ এড়ানো সম্ভব। আর যে কোনো ব্যবসায় বিনিয়োগ আস্তে আস্তেই বাড়ানো উচিত। আর বর্তমানে আয় প্রতি মাসে ভ্যারি করে। কারণ এখন বাজারে কাঁচামালের দাম প্রতিনিয়ত বাড়ছে। কিন্তু আমি চাইলেই আমার পণ্যের দাম বাড়াতে পারি না। আর যেহেতু এগুলো শৌখিন পণ্য, মানুষ রেগুলার এই পণ্য গুলো কেনে না। তাই উঠানামা হয়েই যায়।”
ভবিষ্যতে নিজের একটা কারখানা করতে চান, যেখানে নিজের মতো করে ডিজাইন করে সব কাঁচামাল গুলো প্রস্তুত রাখা যাবে। ‘কাঠের শহরের” জন্য কাঠের সব কাঁচামাল, কাপ, মগ বিভিন্ন জায়গা থেকে যোগাড় করতে হয়। মাঝে মাঝে এমন হয় যে সময় মতো কাঁচামাল পাওয়া যায়না, বা পেলেও তার গুণগত মান ভালো হয় না। এ কারণেই তিনি চান নিজের একটা কারখানা হোক।
এমআই