ইলিয়াস হোসেন : সরকারের নির্দেশে টানা ২১ মাস ধরে নিরবচ্ছিন্ন দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন চিকিৎসকসহ স্বাস্থ্যকর্মীরা। ডেঙ্গু থেকে প্রাণঘাতী করোনা মহামারীকালে ছুটিবিহীন কাজের কোন ধরনের স্বীকৃতি বা নূন্যতম উৎসাহমূলক প্রণোদনা মেলেনি স্বাস্থ্যকর্মীদের ভাগ্যে। এদিকে, রাষ্ট্রের প্রয়োজনে যে মহান ত্যাগ স্বীকার করেছেন স্বাস্থ্যকর্মীরা, তার যথাযথ মূল্যায়নের দাবি জানিয়েছে বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েন (বিএমএ) ‘র সভাপতি ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক।
চিকিৎসকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, দীর্ঘদিন ধরে টানা ছুটি বাতিল থাকার কারণে তারা অনেকেই শারিরীক ও মানসিকভাবে ক্লান্ত হয়ে পড়েছেন। অনেকেই মানসিকভাবে অবসাদগ্রস্ত। কেননা পরিশ্রমের পর বিশ্রাম অপরিহার্য। বিশ্রাম পেলে শারিরীক ও মানসিক ধকল কাটিয়ে উঠে আবার নব উদ্যমে সেবা দেয়ার কর্ম স্পৃহা তৈরি হয়। কিন্তু বিগত দিনগুলোতে শ্রান্তি বিনোদন ছুটিও বাতিল করা হয়েছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, সারা দেশে ডেংগুর প্রকোপ বেড়ে যাওয়ার প্রেক্ষিতে ৩১ জুলাই ২০১৯ খ্রিঃ স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্য সেবা বিভাগ, প্রশাসন-১ অধিশাখা থেকে এক অফিস আদেশের মাধ্যমে পরবর্তী নির্দেশ না দেয়া পর্যন্ত সকল চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীদের সবধরনের ছুটি বাতিল করে।
পরবর্তীতে দেশে করোনা মহামারী ছড়িয়ে পড়ায় ২০২০ এর ১৯ মার্চ স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্য সেবা বিভাগ, প্রশাসন-১ শাখা থেকে এক আদেশের মাধ্যমে সকল চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীদের সবধরনের ছুটি বাতিল করা হয়। যা আজও বহাল আছে।
স্বাস্থ্যকর্মীরা বলেন, ২০১৯ বছর জুড়ে ডেঙ্গু জ্বরের প্রকোপ ছিল। বছরের শেষ মাসে আসে করোনা ভাইরাস মহামারী। আন্তর্জাতিকমানের সুরক্ষা সামগ্রী না থাকলেও করোনাযুদ্ধে পিছপা হননি চিকিৎসক, নার্স সহ স্বাস্থ্যকর্মীরা। পরিবারের মায়া ছেড়ে, আপনজনদের ঝুঁকি আছে জেনেও অদম্য মনোবল আর অসীম সাহসিকতার সাথে করোনার সাথে লড়ে যান তারা। তাদের এ লড়াই ছিল অসম লড়াই। এই লড়াইয়ে শহীদ হয়েছেন দুই শতাধিক চিকিৎসকসহ অনেক স্বাস্থ্যকর্মী।
এদিকে, ছুটি না থাকায় পরিবারকে যথেষ্ট সময় দিতে পারছেন না স্বাস্থ্যকর্মীরা। স্বজন-সন্তানদের ভালভাবে যত্ন নিতে পারছে না তারা। এতে করে পারিবারিক বন্ধনে সমস্যা হচ্ছে,বাবা-মায়ের আদর থেকে বঞ্চিত হচ্ছে বাচ্চারা। শিশুদের শারিরীক ও মানসিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। মা-বাবাও মানসিকভাবে ভেংগে পরছেন।
ছুটি না থাকায় পারিবারিক ও সামাজিক কর্মকাণ্ডে স্বাভাবিকভাবে অংশ নিতে পারছেন না স্বাস্থ্যকর্মীরা। এতে সামাজিকতা রক্ষা করা যাচ্ছেনা। অনেকের সামজিক সম্পর্কে ফাটল ধরছে। আত্মীয়-স্বজনকে সময় দেয়া যাচ্ছেনা।
যাদের বাড়ি গ্রামে বা কর্মস্থল থেকে অনেক দূরে তারা তো নিজের বাবা,মা,আত্মীয় স্বজন অসুস্থ হলে তাদের দেখতে যেতেও পারেন না। অনেক সময় অসুস্থ বাবা,মায়ের চিকিৎসা করার সুযোগটুকুও পান না।
কোভিড ডেডিকেটেড হাসপাতালে ডিউটিরত স্বাস্থ্যকর্মীদের অবস্থা আরো করুণ। টানা ১৪/১৫ দিন করোমা ইউনিটে ডিউটি করে,বাসায় বা হোটেলে ফিরে ১৪/১৫ দিন কোয়ারান্টাইন পিরিয়ড কাটিয়ে আবার হাসপাতালে ডিউটিতে ফিরতে হয়। বাসায় গিয়ে দূর থেকে বাচ্চাদের দেখতে হয়। একটু কোলে নেয়া যায় না। আদর করা যায় না, পাশে যদি তার কোন ক্ষতি হয়। এত শারিরীক ও মানসিক ধকল সয়ে শত প্রতিকূলতার মাঝে চিকিৎসা সেবা দিয়ে যাচ্ছে চিকিৎসক,নার্স ও অন্যান্য স্বাস্থ্যকর্মীরা।
এ বিষয়ে এফডিএসআর এর চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. আবুল হাসনাৎ মিল্টন সময় জার্নালকে বলেন, কোভিড মহামারী মোকাবেলায় শুরু থেকেই ডাক্তাররা সামনে থেকে জনগণকে চিকিৎসা সেবা প্রদান করে আসছে। কোনকিছুর বিনিময়ে নয়, বরং মানবতা ও পেশাগত দায়িত্ববোধের জায়গা থেকেই ডাক্তাররা চিকিৎসা সেবা প্রদান করে যাচ্ছেন।
তারপরও গত বছর ৭ এপ্রিল মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঘোষণা দিয়েছিলেন যে, চিকিৎসাসেবা দিতে গিয়ে এবং করোনা ভাইরাস (কোভিড-১৯) সংক্রমণ প্রতিরোধে দায়িত্বপালনকালে কেউ আক্রান্ত হলে পদমর্যাদা অনুযায়ী ৫-১০ লাখ টাকা এবং মারা গেলে ২৫-৫০ লাখ টাকার স্বাস্থ্যবিমা দেওয়া হবে। একইসঙ্গে চিকিৎসক, নার্স, স্বাস্থ্যকর্মী, মাঠ প্রশাসনের কর্মকর্তা-কর্মচারী, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য প্রত্যক্ষভাবে নিয়োজিত প্রজাতন্ত্রের অন্যান্য কর্মচারীদের একটা বিশেষ ইন্সুরেন্স সুবিধা দেওয়ার ঘোষণাও দিয়েছিলেন তিনি।
ডা. মিল্টন দুঃখ করে বলেন, মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণার এক বছরের অধিককাল অতিবাহিত হলেও আজ অব্দি অধিকাংশ ডাক্তারই প্রতিশ্রুত প্রণোদনার অর্থ হাতে পান নি। কাদের অবহেলায় প্রণোদনা নিয়ে এমন দীর্ঘসুত্রিতা ও জটিল পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে, তা খুঁজে বের করা দরকার।
প্রণোদনার অর্থই কিন্তু মূখ্য নয়, বরং ভাল কাজের জন্য এটি একটি সরকারী স্বীকৃতি যা বর্তমান ও ভবিষ্যতে ডাক্তারদের কাজে আরো বেশী উৎসাহিত করবে। সুতরাং আমরা চাই, ডাক্তারদের প্রাপ্য প্রণোদনার অর্থ অবিলম্বে প্রদান করার দাবি জানান এফডিএসআর এর চেয়ারম্যান।
চিকিৎসক স্বাস্থ্যকর্মীদের মহান ত্যাগের বিষয়টা প্রধানমন্ত্রীকে অবহিত করার আশ্বাস দিয়েছেন বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএ) সভাপতি ডা. মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিন। সময় জার্নালকে তিনি জানান, বিশাল এই ত্যাগের স্বীকৃতিস্বরূপ স্বাস্থ্যকর্মীরা যাতে বাড়তি প্রণোদনা পান সে ব্যাপারে সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা চালাবে বিএমএ।
এভাবে টানা ছুটিবিহীন ডিউটি পালন কষ্টকর মন্তব্য করেছেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. এবিএম খুরশিদ আলম। সময় জার্নালকে তিনি জানান, আসলে চিকিৎসকসহ স্বাস্থ্যকর্মীদের কাজের ধরনটাই এমন। রাষ্ট্রের প্রয়োজনে যে দুরযোগে তারা বাড়তি দায়িত্ব পালন করবেন। তারপরও, স্বাস্থ্যকর্মীরা যাতে প্রণোদনা পেতে পারেন সে প্রচেষ্টা আমরা অব্যাহত রেখেছি। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে সরকারের কাছে আবেদনের আশ্বাস দেন স্বাস্থ্যখাতের সর্বোচ্চ প্রতিষ্ঠানের প্রধান।
তিনি আরও বলেন, চিকিৎসক-নার্সসহ অন্যান্য জনবলের ঘাটতি মোকাবেলায় সরকার বিশেষ ব্যবস্থা নিয়েছে। শিগগিরই আরও নতুন স্বাস্থ্যকর্মী নিয়োগ দেয়া হবে। তখন সমস্যা অনেকটাই কমে যাবে বলে আশা প্রকাশ করেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. এবিএম খুরশিদ আলম।
সময় জার্নাল/ইএইচ