ডা. মো. আল-আমিন খান | ভারত থেকে বাংলাদেশে ঘুরতে আসার পর বাংলাদেশী এক তরুণীকে পছন্দ হয়ে যায় যুবকের, প্রেম করে বিয়ে করে পরে বাংলাদেশেই থেকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় যুবক। ঠিক গল্পের মত সুন্দর এই দম্পতির কোলজুড়ে আসে ফুটফুটে কন্যা সন্তান। কন্যার মুখের দিকে তাকালে মনে হয় পৃথিবীর সমস্ত সুখ এইখানে নিহিত।
উপরের এই সত্যিকারের গল্পটি সামনের দিকে আরও সুন্দর হতে পারতো, কিন্তু ঠিক এক বছর যেতে না যেতেই বাবা মা লক্ষ্য করেন তাদের আদরের সন্তানটি ফ্যাকাশে হয়ে যাচ্ছে, বাড়ছে শিশুর দুর্বলতা। ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়ার পর ডাক্তার পরীক্ষা করে ঘোষণা করেন শিশুটি থ্যালাসিমিয়া আক্রান্ত। বাবা মায়ের মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়ে। তারা জানতে পারেন এ রোগের চিকিৎসা কয়েকদিন পর পর অন্যের রক্ত নিতে নিতে অকাল মৃত্যুর জন্য প্রস্তুতি নেওয়া।
যে বাচ্চার হাত ধরে চুমু খেত সেই বাচ্চার হাতগুলোতে আজ ক্যানুলা করা, প্রতিবার ক্যানুলার সময় বাচ্চার কান্নার আওয়াজ যেনো বাবার বুকে তীরের মত বাঁধে। মা এই বয়সী বাচ্চাদের দিকে তাকায়ে থাকে আর কি যেন ভাবে। বউকে নিয়ে গল্পে আড্ডায় এখন আর শিলিগুড়ি যাওয়ার প্লান হয় না। চিন্তা হয় পরের মাসে রক্ত জোগাড় নিয়ে। থ্যালাসেমিয়া আক্রান্ত প্রতিটি পরিবারের চিত্র এটি।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্যমতে এদেশের জনসংখ্যার সাত শতাংশ অর্থাৎ প্রায় দেড় কোটি মানুষ থ্যালসেমিয়ার বাহক এবং প্রতিবছর অসংখ্য নতুন থ্যালাসিমিয়া আক্রান্ত শিশু জন্মগ্রহণ করছে। যে পরিবারে একজন থ্যালাসিমিয়া আক্রান্ত রোগী রয়েছে কেবল তারাই বলতে পারে অই পরিবারের কি কষ্ট। অথচ সামান্য একটু সচেতন হলেই এই পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হত না।
থ্যালাসেমিয়া রোগ কি?
থ্যালাসেমিয়া একটি বংশগত রক্তস্বল্পতা জনিত রোগ। মানবদেহের রক্তের লোহিত রক্তকনিকার মধ্যে হিমোগ্লোবিন (হিম +গ্লোবিন) থাকে। মানবদেহের ১৬ ও ১১ নং ক্রোমোজোমে যথাক্রমে আলফা ও বিটা জীন থাকে। আলফা ও বিটা জীনদ্বয় যথাক্রমে আলফা ও বিটা গ্লোবিন নামক প্রোটিন তৈরি করে।এখন জন্মগতভাবে যদি আলফা ও বিটা জীনে সমস্যা থাকে তাহলে আলফা ও বিটা গ্লোবিন নামক প্রোটিনও ত্রুটিপূর্ণ হয়। আলফা ও বিটা গ্লোবিন নামক প্রোটিন ত্রুটিপূর্ণ থাকার কারনে হিমোগ্লোবিনও ত্রুটিপূর্ণ হয় যা লোহিত রক্তকনিকার একটি প্রধান উপাদান। তাই একজন সুস্থ মানুষের লোহিত রক্তকনিকার আয়ু ১২০ দিন হলেও থ্যালাসেমিয়া রোগীর ত্রুটিপূর্ণ গ্লোবিনের কারনে এর আয়ু হয় ২০-৬০ দিন। অপরিপক্ক অবস্থাত লোহিত রক্তকণিকা ভেঙ্গে যায় বা মারা যায় তাই রক্তস্বল্পতা দেখা দেয়। শিশুর স্বাভাবিক বৃদ্ধি ব্যাহত হয়। শরীর দুর্বল হয়ে পড়ে। ধীরে ধীরে শরীরের দরকারী অঙ্গ যেমন প্লীহা, যকৃৎ বড় হয়ে যায় এবং কার্যক্ষমতা হারাতে থাকে। মুখমন্ডলের হাড়ের বিকৃতি ঘটে।
এ রোগের চিকিৎসা কি?
থ্যালাসেমিয়া আক্রান্ত শিশুকে অন্যের রক্ত নিয়ে বেঁচে থাকতে হয়। রক্তস্বল্পতার জন্য প্রতি ১/২ মাস অন্তর অন্তর ১/২ ব্যাগ রক্ত নিতে হয়। ঘন, ঘন রক্ত নেওয়ায় এবং একই সাথে পরিপাকনালী থেকে আয়রন শোষন বেড়ে যাওয়ায় শরীরে আয়রনের মাত্রা বেড়ে যায়। তখন আয়রন কমানোর ওষুধ খেতে হয়। নিয়মিত রক্ত দিয়ে রক্তরোগ বিশেষজ্ঞের পরামর্শ অনুযায়ী চিকিৎসা করালে থ্যালাসিমিয়া রোগিকে ২০-৩০ বছর বাঁচানো সম্ভব। সঠিক চিকিৎসা অত্যন্ত ব্যয়বহুল ও সবার পক্ষে নেওয়া সম্ভব হয়না বিধায় অকালে ঝড়ে পড়ে হাজারো প্রাণ। অস্থিমজ্জা প্রতিস্থাপন হচ্ছে এ রোগের একমাত্র স্থায়ী চিকিৎসা এবং এর জন্য ৪০-৫০ লক্ষ টাকা খরচের প্রয়োজন এবং সবক্ষেত্রে সফল নাও হতে পারে।
এ রোগ কিভাবে ছড়ায়?
একজন থ্যালাসেমিয়া আক্রান্ত শিশু কেবল তখনি জন্মগ্রহণ করবে যখন বাবা মা দুজনই থ্যালাসেমিয়ার বাহক হবেন। থ্যালাসেমিয়ার বাহক হচ্ছে এমন ব্যাক্তি যাদের দেহে তাদের সমবয়সী যেকোন ব্যাক্তির চেয়ে কম রক্তকণিকা উৎপন্ন হলেও তাদের কোনো লক্ষণ বা জটিলতা দেখা যায় না, তারা জন্ম থেকে যতদিন বাচবে এভাবেই বাচবে এবং কোনো চিকিৎসার ও প্রয়োজন হয়না। এবং পরীক্ষা না করালে থ্যালাসেমিয়া রোগীর বাহকরা জানেনওনা তারা থ্যালাসেমিয়ার বাহক
(১) যখন বাবা মা কেউয়ি থ্যালাসেমিয়ার বাহক ননঃ সকল সন্তানই থ্যালাসেমিয়ার মুক্ত।
(২) যখন বাবা মা যেকোন একজন থ্যালাসেমিয়ার বাহকঃ থ্যালাসেমিয়া আক্রান্ত কোনো শিশু জন্মগ্রহণ করবে না কিন্তু প্রতিটি বাচ্চার থ্যালাসেমিয়া বাহক হওয়ার সম্ভাবনা ৫০ ভাগ এবং সম্পূর্ণ সুস্থ হওয়ার সম্ভাবনা ৫০ ভাগ
(৩) যখন বাবা মা উভয়ই থ্যালাসেমিয়ার বাহকঃ এক্ষেত্রে প্রতিটি শিশু থ্যালাসেমিয়া আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা ২৫ ভাগ, সুস্থ হওয়ার সম্ভাবনা ২৫ ভাগ, এবং বাহক হওয়ার সম্ভাবনা ৫০ ভাগ।
এখন দুজন থ্যালাসেমিয়া বাহকের মিলনে যখন বাচ্চা হবে সেক্ষেত্রে বলা সম্ভব না প্রথম বাচ্চা বা কততম বাচ্চা সুস্থ হবে তাই তখন সন্তান গ্রহনের ক্ষেত্রে মাতৃজঠরে বাচ্চার DNA test এর মাধ্যমে বাচ্চার থ্যালাসেমিয়া নির্নয় একমাত্র ভরসা।
মায়ের গর্ভে বাচ্চার বয়স যখন ১১-১৫ সপ্তাহ তখন Chorionic villus sampling (প্রাথমিক গর্ভফুল হতে কোষকলা সংগ্রহ) অথবা ১৫-১৮ সপ্তাহে Amniocentesis (গর্ভের বাচ্চার চারপাশের পানি সংগ্রহ) এর মাধ্যমে বাচ্চার DNA সংগ্রহের পরীক্ষা করে গর্ভের বাচ্চার থ্যালাসেমিয়া রোগ আছে কিনা তা শতভাগ নিশ্চিত হওয়া যায়। এ সময় বাচ্চার আকার থাকে দেড় থেকে দুই ইঞ্চির মত, কাজেই সুস্থ বাচ্চা পাওয়া না পাওয়া সম্পর্কে নিশ্চিত হয়ে বাবা মা গর্ভাবস্থা চালিয়ে যাওয়ার ব্যপারে সিদ্ধান্ত নিতে পারে।
থ্যালাসেমিয়া প্রতিরোধের উপায় :
শুধুমাত্র একজন থ্যালাসেমিয়া বাহকের সাথে আরেকজন থ্যালাসেমিয়া বাহকের বিয়ে প্রতিরোধ অথবা সন্তান নেওয়া প্রতিরোধ করতে পারলেই থ্যালাসেমিয়া প্রতিরোধ সম্ভব। বাংলাদেশ থ্যালাসেমিয়া ফাউন্ডেশন এর তথ্যমতে দেশে বর্তমান থ্যালাসেমিয়া বাহকের সংখ্যা এক কোটি দশ লাখ।
কাজেই আপনি নিশ্চিন নন আপনি এবং আপনার পার্টনার থ্যালাসেমিয়ার বাহক কিনা। আপনার ঘরে একমাত্র তখনই থ্যালাসেমিয়া আক্রান্ত শিশু জন্মগ্রহণ করবে যখন স্বামী স্ত্রী উভয়ই থ্যালাসিমিয়ার বাহক হোন। কোনো ব্যাক্তি থ্যালাসেমিয়ার বাহক কিনা তা শুধুমাত্র একটি টেস্ট Hb. Electrophoresis. পরীক্ষার মাধ্যমে ১০০% নিশ্চিত হওয়া যায়।
বিবাহের পূর্বে এই পরীক্ষা এই দেশে বাধ্যতামূলক করা গেলে থ্যালাসিমিয়া আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বৃদ্ধি শূন্যের কোঠায় নিয়ে আসা সম্ভব। কোনো বাবা মায়ই চান না তাদের ঘরে একজন থ্যালাসেমিয়া আক্রান্ত শিশু জন্মগ্রহণ করুক।
৮ মে বিশ্ব থ্যালাসেমিয়া দিবসে আমাদের প্রতিপাদ্য হোক থ্যালাসেমিয়া মুক্ত একটি সমাজ, দেশ, পৃথিবী গড়ার লক্ষ্যে নিজ নিজ যায়গা থেকে সচেষ্ট থাকা।
লেখক: মেডিকেল অফিসার, শিশু বিভাগ, গণস্বাস্থ্য সমাজ ভিত্তিক মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল।
সময় জার্নাল/আরইউ