সাইফুল ইসলাম রুদ্র, নরসিংদী জেলা প্রতিনিধি:
দালালের মাধ্যমে অবৈধভাবে লিবিয়া হয়ে সমুদ্র পথে ইতালি যাওয়ার সময় ভূমধ্যসাগরে নৌকা ডুবিতে আব্দুল নবী (২২) নামে নরসিংদীর এক যুবকের মরদেহ উদ্ধার হয়েছে। লিবিয়া পুলিশ মরদেহ উদ্ধার করে সেখানকার হিমঘরে রাখার পর বৃহস্পতিবার রাতে এক প্রবাসী ফোন করে তার মৃত্যুর বিষয়টি পরিবারের লোকজনকে নিশ্চিত করেন বলে জানিয়েছেন আব্দুল নবীর বড় ভাই মাহ আলম।
নিহত আব্দুল নবী (২২) নরসিংদীর রায়পুরা উপজেলার উত্তর বাখরনগর ইউনিয়নের বড়চর গ্রামের মৃত হযরত আলীর ছেলে। একই সঙ্গে যাওয়া নরসিংদী জেলার আরও কমপক্ষে ১৩ জন নিখোঁজ থাকায় তাদের একই পরিনতি হয়েছে বলে ধারণা করছেন পরিবারের লোকজন। তবে এ বিষয়ে কেউ কোন অভিযোগ বা তথ্য জানাননি বলে জানিয়েছেন নরসিংদীর অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (অপরাধ) অনির্বাণ চৌধূরী ও জেলা প্রশাসক আবু নইম মোহাম্মদ মারফ খান।
স্থানীয়ভাবে নিখোঁজদের মধ্যে ৭ জনের নাম পরিচয় পাওয়া গেছে। তারা হলেন নরসিংদীর বেলাব উপজেলার নারায়ণপুর ইউনিয়নের টান লক্ষীপুর ও চর লক্ষীপুর এলাকার বিল্লাল মিয়ার ছেলে সৈকত (২০), রহিম মিয়ার ছেলে আবু তাহের (২৭), রতন মিয়ার ছেলে জহিরল ইসলাম (১৯), আউয়াল মিয়ার ছেলে উজ্জল মিয়া (১৮), ওবায়দুল্লাহর ছেলে রহমত উল্লাহ (২০), মোক্তার হোসেন এর ছেলে জিহাদ (১৯) এবং কিশোরগঞ্জ জেলার কুলিয়ারচর উপজেলার বড় ছয়সূতি এলাকার বাছেদ মিয়ার ছেলে স্বপন (২৭)। তারা কয়েক মাস আগে ১০ থেকে ১২ লাখ টাকা খরচ করে দালাল চক্রের মাধ্যমে অবৈধভাবে ইতালি যাওয়ার উদ্দেশ্যে দেশ ছাড়েন।
নিহত আব্দুল নবীর ভাই মাহ আলম সাংবাদিকদের জানান, আব্দুল নবী ৫ বছর সৌদী আরব থাকার পর দেশে ফিরেন। ফেরার পর ৪ মাস আগে দালাল চক্রের মাধ্যমে লিবিয়া হয়ে ইতালি পাড়ি দেওয়ার উদ্দেশ্যে দেশ ছাড়েন। পরে লিবিয়ার গেম ঘর থেকে নবী সহ সঙ্গীয় আরও ১২-১৩ জন ইতালির উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন। ভূমধ্যসাগরে ৮ থেকে ১০ কিলোমিটার অতিক্রম করার পর তাদের বহনকারী নৌকা বা বোট ফেটে যায়। এসময় ভয়ে তারা লিবিয়ায় ফিরে আসেন। এই ঘটনার পর দালালের অভিভাবকদের সাথে গ্রাম্যসালিসে বসে নবী হোসেনসহ অন্যান্যদের টাকাসহ পাসপোর্ট ফেরত চাওয়া হয়। পাসপোর্ট ফেরত না দিয়ে আবারও তাদের ইতালি পাঠানো হবে বলে জানানো হয়। সর্বশেষ এক মাস আগে লিবিয়া থেকে পরিবারের সাথে
ফোনে যোগাযোগ করেন আব্দুল নবী। এসময় তাকেসহ অন্যান্যদের গেম ঘরে নেয়া হবে জানান নবী।
এরপর পরিবারের সাথে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে নবীসহ সঙ্গীয় অন্যান্যদেরও। গত বৃহস্পতিবার (২২ জুন) রাত আনুমানিক ৯টার দিকে লিবিয়া প্রবাসী এক বাংলাদেশি ফোন করে নবীর মরদেহ উদ্ধার হয়েছে বলে জানান। ভূমধ্যসাগরে নৌকা ডুবির পর মরদেহ উদ্ধার করে হিমঘরে রাখার পর লিবিয়া পুলিশ ওই প্রবাসীর মাধ্যমে পাসপোর্ট দেখে নবীর মরদেহ শনাক্ত করে পাসপোর্টে থাকা নাম্বারে খবর জানাতে বলেন।
বেলাব উপজেলার চর লক্ষীপুর গ্রামের নিখোঁজ সৈকতের বাবা বিল্লাল মিয়া ও রহমত উল্লাহর মা খালেদা বেগম বলেন, ১০ থেকে ১২ লাখ টাকার বিনিময়ে স্থানীয় দালাল লক্ষীপুর এলাকার মনা মিয়ার ছেলে আলম মিয়ার মাধ্যমে তাদের ছেলেসহ অন্যান্য ১২-১৩ জন ইতালি পাড়ি দেবেন চুক্তি হয়। লিবিয়া থেকে ইতালি যাওয়ার জন্য কয়েকবার চেষ্টার পরও যেতে না পেরে স্থানীয় দালালের পরিবারের কাছে চাপ দিয়ে টাকা ফেরত চাওয়া হয়। তারা টাকা ফেরত না দিয়ে জোরপূর্বক আবারও তাদের লিবিয়া গেম ঘর থেকে ইতালি পাঠানো হবে বলে জানায়। এরপর থেকে গত এক মাস ধরে তাদের সাথে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয় পরিবারের।
নরসিংদীর বেলাব ও রায়পুরা উপজেলাসহ জেলার অন্যান্য উপজেলার কমপক্ষে ১৩ জন নিখোঁজ রয়েছে দাবী করছেন স্থানীয়রা। নিখোঁজ হওয়া লোকজন নিহত আব্দুল নবীর সঙ্গের যাত্রী ছিলেন বলে ধারনা করছেন পরিবারের সদস্যরা। নিখোঁজরা জীবিত না কী মৃত কোন তথ্য না পেয়ে আহাজারি করছেন তারা।
অভিযুক্ত দালাল আলম মিয়ার মা রেহেনা বেগম বলেন, এক মাস ধরে আলমের সাথেও পরিবারের কোন যোগাযোগ নেই। আলম মিয়াও নিখোঁজ হওয়াদের সাথে একই নৌকায় ছিলেন বলে ধারনা করছেন তিনি। তাদের পরিবারেও আহাজারি চলছে। ভিড় করছেন নিখোঁজ অন্যান্যদের পরিবারের সদস্যরাও।
নরসিংদীর অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (অপরাধ) অনির্বাণ চৌধূরী বলেন, অভিবাসন প্রত্যাশী নিহত ও নিখোঁজ হওয়ার খবরটি আমরা বিভিন্ন মাধ্যমে শুনেছি, সরকারীভাবে কোন তথ্য নেই। কোন পরিবারের পক্ষ থেকেও এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট থানায় কেউ কোন অভিযোগ করেনি। অভিযোগ পেলে প্রয়োজনীয় আইনগত পদক্ষেপ নেয়া হবে।
জেলা প্রশাসক আবু নইম মোহাম্মদ মারফ খান বলেন, লিবিয়া হয়ে ইতালী যাওয়া পথে নিহত বা নিখোঁজের কোন তথ্য জানা নেই। এ বিষয়ে কেউ কোন অভিযোগ জানাননি বা সরকারী কোন দপ্তর থেকেও এমন কোন তথ্যও আসেনি।
এমআই