সাইফ ইব্রাহিম, ইবি প্রতিনিধি:
ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে (ইবি) নবীন এক শিক্ষার্থীকে নগ্ন করে নির্যাতনের অভিযোগ উঠেছে দুই শিক্ষার্থীর বিরুদ্ধে। নির্যাতনে ভুক্তভোগীকে রড দিয়ে মারা, নগ্ন করে টেবিলের উপর দাঁড় করিয়ে রাখা ও পর্ন ভিডিও দেখতে বাধ্য করা হয় বলে অভিযোগ ভুক্তভোগীর।
গত বুধবার (৭ ফেব্রুয়ারী) রাতে লালন শাহ হলের গণরুমে (১৩৬ নং কক্ষে) রাত ১২ টা থেকে ভোর পর্যন্ত এই র্যাগিংয়ের ঘটনা ঘটে। ঘটনার সুষ্ঠু তদন্তে মঙ্গলবার (১৩ ফেব্রুয়ারি) পৃথক দুইটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে বিশ্ববিদ্যালয় ও হল প্রশাসন।
ভুক্তভোগী বিশ্ববিদ্যালয়ের আল-ফিকহ এবং লিগ্যাল স্টাডিজ বিভাগের ২০২২-২৩ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী। অভিযুক্তরা, শারীরিক শিক্ষা বিভাগের ২০২১-২২ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী মুদাচ্ছির খান কাফি এবং ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের একই বর্ষের মোহাম্মদ সাগর। তারা উভয়েই শাখা ছাত্রলীগের কর্মী এবং সাধারণ সম্পাদক নাসিম আহমেদ জয়ের অনুসারী।
ভুক্তভোগী ও হলের শিক্ষার্থীদের সাথে কথা বলে জানা যায়, ভুক্তভোগী ও অভিযুক্তরা লালন শাহ হলের ১৩৬ নম্বর রুমে থাকেন। ঘটনার দিন রাতে ওই কক্ষে অভিযুক্তরাসহ কয়েকজন পরিচয়পর্বের নামে ভুক্তভোগীকে ডাকেন। শুরু থেকেই তারা ভুক্তভোগীর বাবা-মা এর নাম তুলে গালিগালাজ করতে থাকেন। এছাড়া ভুক্তভোগীকে বিভিন্ন অশ্লীল অঙ্গভঙ্গি করতে বাধ্য করা হয়। এসময় সে অস্বীকৃতি জানালে তাকে রড দিয়ে মারা হয়। পরে অভিযুক্তরা ভুক্তভোগী শিক্ষার্থীকে জোরপূর্বক উলঙ্গ করে টেবিলের উপর দাঁড় করিয়ে রাখে এবং পর্নোগ্রাফি ভিডিও দেখতে বাধ্য করেন। পরে ওই অবস্থায় ভুক্তভোগীকে ‘নাকে খত’ (মেঝেতে নাক লাগিয়ে নির্দিষ্ট সীমানা অতিক্রম করা) দেওয়া সহ বিভিন্নভাবে নির্যাতন করা হয়। এভাবে রাত সাড়ে ১২ টা থেকে ভোর সাড়ে ৪টা পর্যন্ত দফায় দফায় চলে নির্যাতন। এছাড়া ঘটনার বিষয়ে চুপ থাকতে অভিযুক্তরা ভুক্তভোগীকে বিভিন্নভাবে ভয়ভীতি দেখান এবং ৩/৪ বার তার বিছানাপত্র রুমের বাইরে ফেলে দেন।
ভুক্তভোগী শিক্ষার্থী বলেন, ‘গত বুধবার আমার সাথে এমন একটি অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটেছে। তবে পরে হলের ছাত্রলীগের সিনিয়র ভাইয়েরা বিষয়টা মিটমাট করে দেয়। মিটমাটের পর অভিযুক্তদের হলে তেমন একটা দেখা যায়নি।
অভিযুক্ত শিক্ষার্থী মোহাম্মদ সাগর বলেন, ‘এ বিষয়ে আমি কিছুই জানি না। ওইদিন আমি হলের বাইরে ছিলাম।’ কাফির সঙ্গে মুঠোফোনে একাধিকবার কল করেও যোগাযোগ করা যায়নি। বর্তমানে অভিযুক্তদের কেউই হলে নেই বলে জানা গেছে।
শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক নাসিম আহমেদ জয় বলেন, কারো ব্যক্তিগত কাজের দায় সংগঠন নেবে না। ঘটনা শোনার পর আমরা ভুক্তভোগীর জন্য হলে একটি সিটের ব্যবস্থা করে দিয়েছি। আমরা ভুক্তভোগীর পাশে আছি। যদি ভুক্তভোগী এ বিষয়ে অভিযোগ দেয় এবং অভিযুক্তরা ছাত্রলীগ কর্মী হয়। তবে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
এদিকে ছাত্রলীগের নেতৃবৃন্দরা অভিযুক্তদের বিচারের কথা বললেও ঘটনার বিষয়ে মুখ না খুলতে ছাত্রলীগের কর্মীদের দ্বারা ভুক্তভোগী শিক্ষার্থীকে বিভিন্ন হুমকি দেওয়া হচ্ছে বলে জানিয়েছে একটি সূত্র। জানা যায়, ঘটনার পরদিন দুপুরে জিয়া মোড়ে শাখা ছাত্রলীগের কর্মী হাফিজ এবং নাসিম আহমেদ মাসুমসহ কিছু নেতাকর্মী বিষয়টি সমাধান করে দেন। পরে দ্বিতীয় দফায় রাতে ছাত্রলীগকর্মী শাহিন আলম, নাসিম আহমেদ মাসুম এবং লিখন লালন শাহ হলের ১৩৬ নং কক্ষে বসে ভুক্তভোগী এবং অভিযুক্তদের মাঝে বিষয়টি পুনরায় সমাধান করেন। এসময় বিষয়টি নিয়ে মুখ না খুলতে নাসিম আহমেদ মাসুম ভুক্তভোগীকে বিভিন্ন হুমকি দেন। সর্বশেষ গতকাল হল কর্তৃপক্ষ অভিযুক্ত রুমে তদন্ত করতে গেলে তার কিছুক্ষণ পূর্বে ছাত্রলীগের কর্মীরা গণরুমের সকল শিক্ষার্থীকে রুম থেকে বের করে দেন বলে জানা গেছে। ফলে সেসময় রুমে কাউকে পাওয়া যায়নি বলে হল প্রভোস্ট জানান।
ছাত্রলীগকর্মীদের মধ্যস্থতায় বিষয়টি সমাধানের পর তাদের চাপে প্রশাসন বরাবর কোনো অভিযোগ দেয়নি ভুক্তভোগী শিক্ষার্থী। তবে বিষয়টি প্রকাশ্যে আসার পর ঘটনার তদন্তে আজ হল প্রশাসন হলের আবাসিক শিক্ষক ড. আলতাফ হোসেনকে আহবায়ক করে চার সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করে। কমিটিতে সদস্য হিসেবে আছেন হলের আবাসিক শিক্ষক আব্দুল হালিম ও অধ্যাপক ড. হেলাল উদ্দিন। সদস্য সচিব হিসেবে আছেন হলের সহকারী রেজিস্ট্রার জিল্লুর রহমান। কমিটিকে আগামী সাত কার্যদিবসের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে।
বিষয়টি নিশ্চিত করে লালন শাহ হলের প্রভোস্ট অধ্যাপক ড. আকতার হোসেন বলেন, আমরা একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছি। বিষয়টা সময় সাপেক্ষ হওয়ায় কমিটিকে আগামী সাত কার্যদিবসের মধ্যে তদন্ত সাপেক্ষে প্রতিবেদন জমা দিতে বলেছি।
অন্যদিকে শেখ রাসেল হলের প্রভোস্ট ড. দেবাশীষ শর্মাকে আহবায়ক করে তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করেছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। কমিটিতে সদস্য হিসেবে রয়েছেন আইন প্রশাসক ড. আনিচুর রহমান এবং সদস্য সচিব হিসেবে রয়েছেন সহকারী প্রক্টর মিঠুন বৈরাগী। কমিটিকে দ্রুত সময়ের মধ্যে প্রতিবেদন জমা দিতে হবে।
প্রক্টর অধ্যাপক ড. শাহাদৎ হোসেন আজাদ বলেন, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন র্যাগিং শব্দটিকে কোনোভাবেই মেনে নেবে না। প্রক্টরিয়াল বডি এবং প্রশাসনের পক্ষ থেকে তদারকির কোনো ঘাটতি নেই। যখনই যেটা আমাদের নজরে এসেছে আমরা ছাড় দেইনি। এ ঘটনায় অভিযোগ না পাওয়ার পরও আমরা জানার পর তদন্ত কমিটি গঠন করেছি।
প্রসঙ্গত, এর আগে গত বছরের জুনে একই হলের একই কক্ষে দুই ছাত্রলীগকর্মী দ্বারা এক নবীন ছাত্রকে নগ্ন করে করে র্যাগিংয়ের ঘটনা ঘটে। র্যাগিংয়ে ভুক্তভোগী ছাত্রকে একটি প্লাস্টিকের বোতল কেটে তার সাথে যৌনসঙ্গমে বাধ্য করা হয়। এ ঘটনায় ভুক্তভোগী শিক্ষার্থী বিচার চেয়ে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন বরাবর লিখিত অভিযোগ দিলেও পরে ছাত্রলীগের বিশেষ চাপে অভিযোগ তুলে নিতে বাধ্য হয় ভুক্তভোগী ছাত্র।
এমআই