রায়হান উদ্দিন তন্ময়, স্টাফ রিপোর্টার।। সময় জার্নাল : করোনায় যখন পুরো পৃথিবী ছিল গৃহবন্ধী। তখন সেই সময়টাকে কাজে লাগিয়ে অনেক উদ্যোক্তা বের হয়ে এসেছে অনলাইনে এবং তাদের মধ্যে বেশির ভাগই নারী। অনলাইনের মাধ্যমে বিভিন্ন প্লাটফর্মকে কাজে লাগিয়ে অনেকে সফলতার সাথে নিজেদের কাজ নিয়ে এগিয়ে গিয়েছেন।
রুপগঞ্জের মেয়ে শাহিনুর বেগম তাদেরই একজন। পঞ্চাশোর্ধ এই নারী কাজ করছেন মাটির চুলায় রান্না করা বিভিন্ন দেশীয় খাবার নিয়ে। গ্রামের সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্ম হলেও আর দশজন বাঙালি মেয়ের মতন বাল্যবিবাহের শিকার হন। তারপর পারিবারিক কলহ এবং সাংসারিক টানাপোড়নের কারনে নির্যাতনের শিকার হয়ে একমাত্র মেয়েকে নিয়ে ফিরে আসেন পিত্রালয়ে।
পড়াশোনা বেশিদূর করতে না পারলেও হাতের কাজ, রান্নাবান্না এবং ব্যবসায়ের প্রতি ছিল অসম্ভব রকমের ঝোঁক। অবশেষে করোনাকালীন সময়ে যখন পুরো পৃথিবী স্তব্ধ তখনই একমাত্র মেয়ের উৎসাহে শখের বসে পুনরায় কাজ শুরু করেন। যে মেয়েকে নিজে একসময় হাতে কলমে লেখাপড়া শিখিয়েছিলেন সেই একমাত্র মেয়ের হাত ধরেই উদ্যোক্তা হয়ে উঠা।
শুরুটা হয়েছিল ৫জুন ২০২০ তারিখে। মা-মেয়ের জমানো মাত্র ১৫০০ টাকা মুলধন নিয়ে এবং পণ্য ছিল ঘানি ভাঙানো খাঁটি সরিষার তেল এবং মাটির চুলায় রান্না করা বিভিন্ন গ্রামীণ খাবার। ছয় মাস না পেরোতেও ব্যাপক সাড়া পান, ধীরেধীরে পেইজের বিক্রি ও রিপিট কাস্টমার বাড়তে থাকে। পাশাপাশি তাদের উদ্যোগ এবং রান্না ঢাকা শহরে প্রচুর জনপ্রিয়তা পায়। শুরু হতে থাকে পেইজের সফলতা, মাত্র ৩মাসেই মাটির চুলায় রান্না করা বিভিন্ন খাবার বিক্রি করে লাখপতির খাতায় নাম আসে।
বর্তমানে প্রতিমাসে আয় প্রায় ৫০০০০ টাকা। বিভিন্ন কর্পোরেট অফিস এবং পারিবারিক প্রোগ্রামে উনি রান্না করা খাবার সরবরাহ করেন। মাটির চুলায় ঘরোয়া পরিবেশে রান্না করা এসব গ্রামীণ খাবার খুব অল্পসময়ে জনপ্রিয়তা পেয়েছে। উনার সিগনেচার রান্না হচ্ছে ‘ঘাটি ভাঙানো খাঁটি সরিষার তেল ও বাটা মশলা দিয়ে মাটির চুলায় রান্না করা মাংস এবং শুটকি ভুনা’।
এছাড়াও রয়েছে খাটি সরিষার তেল, কালোজিরার তেল, নকশিপিঠা, সিজনাল আচার, দই-পায়েস এবং বিভিন্ন গ্রামীণ খাবার। সবকিছু উনারা গ্রামীণ ধাচে কাস্টমারের চাহিদা অনুযায়ী তৈরি করেন এবং সময়মতো পৌঁছে দেন। রান্নাতে কোনো প্রকার ফ্রোজেন উপকরণ ব্যবহার করা হয় না এবং সবকিছু টাটকা বা ফ্রেশ উপকরণ ব্যবহৃত হয়। আর এটাই খাবারের প্রধান বৈশিষ্ট্য। যা তাদের উদ্যোগকে আরো আলাদা করে তুলেছে।
শাহিনুর বেগমের সাথে কথা বলে জানা যায়, ‘ছোটকাল থেকেই উনি গ্রামীণ রান্নাবান্না এবং গ্রামীণ পরিবেশের সাথে পরিচিত। তাছাড়া সবাই ফাস্টফুড জাতীয় বিদেশি খাবারের প্রতি বেশি আগ্রহী। অথচ আমাদের নিজস্ব দেশীয় খাবারগুলো দিন দিন হারিয়ে যাচ্ছে। তাই নতুন মোড়কে পুরাতন দেশীয় খাবারগুলো সবার মাঝে ছড়িয়ে দিতে চান।’
তিনি বলেন, ‘আমাদের সমাজে রান্নাবান্নার কাজকে অনেক কটুদৃষ্টিতে দেখা হয়। প্রথমে সবাই আমার উদ্যোগকে নিয়ে হাসি-ঠাট্টা করতো। উদ্যোগ নিয়ে নিজের পরিবারের কাছেই অনেক বাঁধার সম্মুখীন হয়েছি। কিন্তু আমার মেয়ে আমার হাত শক্ত করে ধরে রেখেছিল।’
শাহিনুর বেগম বলেন ‘ঢাকার পাশ্ববর্তী হওয়াতে খাবার ডেলিভারি দিতে অনেক সমস্যা হতো। মাঝেমধ্যে ডেলিভারিম্যান না আসলে, আমার মেয়ে নিজেই খাবার ডেলিভারি করার জন্য যেতো। প্রথম ছয় মাস মেয়ে আমাকে স্মার্টফোন চালানো, ব্যবসায়ের খুঁটিনাটি, কাস্টমার হ্যান্ডেলিং এবং প্যাকেজিং সবকিছু শিখিয়েছে। এখন সে শুধু পেইজের ব্যাপারগুলো দেখে আর বাকি সবকিছু আমি দেখাশোনা করি। যদিও আমাকে সাহায্য করার জন্য তিন-চারজন আছেন, তবুও সবকাজ আমি নিজ হাতে করতে পছন্দ করি। শুরুর দিকে নিজে বাজার করতাম সাথে আমার মেয়েও যেতো। সবসময় সে আমার পাশে শক্ত খুঁটির মতো লেগে থাকে।’
প্রতিটা কাজই অনেক চ্যালেঞ্জ নিয়ে করতে হয়। আর নারীদের অনেক কিছু চিন্তা-ভাবনা করে কাজ করতে হয়। প্রতিটা সফল নারীর পিছনে থাকে অনেক অদেখা গল্প। অনেক শ্রম, ধৈর্য ও ত্যাগ-তিতীক্ষা । এছাড়া সমাজ ও সামাজিকতা সব কিছু মাথায় রেখে কাজ করতে হয়। সব বাঁধা-বিপত্তি সামাল দিয়ে তিনি এখন স্বাবলম্বী। এরই মধ্যে তিনি ১০ লাখ টাকার উপরে দেশীয় খাবার বিক্রি করেছেন এবং চিন্তা করছেন অনলাইনের এই ব্যবসাটাকে বাস্তবে রুপ দেয়ার জন্য। জুন মাসের ৫তারিখ উনাদের উদ্যোগের একবছর পুরণ হবে। উনাদের উদ্যোগের নাম NittoXpress।
সময় জার্নাল/আরইউ