সময় জার্নাল ডেস্ক:
এবারের সাধারণ নির্বাচনে পাকিস্তান মুসলিম লিগ-নওয়াজ (পিএমএলএন) এর নির্বাচনী স্লোগান ছিল ‘পাকিস্তান কো নওয়াজ দো’, অর্থাৎ ‘পাকিস্তানকে নওয়াজ দাও’। এবারের স্লোগানটি মূলত ২০১৮ সালের নির্বাচনী স্লোগানের প্রতিরূপ। ওই বছরের পাকিস্তান সাধারণ নির্বাচনে দলটির নির্বাচনী স্লোগান ছিল ‘ভোট কো ইজ্জত দো’। বাংলায় বললে যার অর্থ দাঁড়ায় ‘ভোটকে সম্মান দাও’।
‘নওয়াজ শরিফ চতুর্থবারের মতো প্রধানমন্ত্রী হবেন’, নির্বাচনী প্রচারণার সময় দেওয়া এই ধরনের স্লোগানের কথা দলটির ভোটারদের মন থেকে এখনো মুছে যায়নি। এটা ঘোষণা করা হয়েছিল যে, সম্ভাব্য পিএমএলএন-এর নেতৃত্বাধীন সম্ভাব্য জোট সরকারের প্রধানমন্ত্রী হবেন নওয়াজ-ই। কিন্তু শেষ পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রী হিসেবে মনোনীত হয়েছেন নওয়াজ শরিফের ভাই শেহবাজ শরিফ।
এক সপ্তাহ আগে, গত ৮ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তানের সাধারণ নির্বাচনের দিন পিএমএলএন নেতা নওয়াজ শরিফ যখন তার নির্বাচনী এলাকার একটি ভোটকেন্দ্র থেকে ভোট দিয়ে বের হচ্ছিলেন, তখন একজন সাংবাদিক তার কাছে জানতে চান যে, নির্বাচনের পর জোট সরকার গঠনের সম্ভাবনা কতটুকু। তখন নওয়াজ শরিফ কিছুটা রাগ করে বলেছিলেন, ‘এই ধরনের কথা বলবেন না। সরকার যারা-ই গঠন করুক, একক সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে সরকার গঠিত হলে সেটা সবসময় ভালো হয়।’ কিন্তু ভোটের ফলাফলে নওয়াজ শরিফের একক সংখ্যারিষ্ঠতা প্রাপ্তির আশা শেষ পর্যন্ত পূরণ হয়নি।
পাকিস্তান নির্বাচন কমিশনের দেওয়া অসম্পূর্ণ এবং অনানুষ্ঠানিক (বেসরকারি) ফলাফল অনুযায়ী, নির্বাচনে নওয়াজ শরিফের নেতৃত্বাধীন দল পিএমএল-এন ৭৫টি আসনে জয়লাভ করেছে। বিলাওয়াল ভুট্টোর দল পাকিস্তান পিপলস পার্টি জিতেছে ৪৫টি আসনে। এছাড়া, মুত্তাহিদা কওমি মুভমেন্ট (এমকিউএম) ১৭টি এবং অন্য দলগুলো জিতেছে ২৫টি আসন।
কিন্তু এবারের নির্বাচনে পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের দল পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফ, সংক্ষেপে পিটিআই সমর্থিত স্বতন্ত্র প্রার্থীরা মোট ৯৩টি আসনে জয়যুক্ত হয়েছেন। জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম, এমকিউএম এবং স্বতন্ত্র প্রার্থীরা মিলে জোট সরকার গঠন করার কথা। কিন্তু পিপিপি ঘোষণা দেয় যে, সুনির্দিষ্ট কিছু শর্তসাপেক্ষে তারা জোট সরকার গঠনে অংশ নেবে। কিন্তু উলামায়ে ইসলাম জোট গঠনের আহ্বান প্রত্যাখ্যান করে এবং বিরোধী দল হিসেবে থাকার সিদ্ধান্ত নেয়।
এই রাজনৈতিক পরিকল্পনা করার সময়, মঙ্গলবার রাতে মুসলিম লীগ ঘোষণা করে যে, জোট সরকারের প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী নওয়াজ শরিফ হবেন না, হবেন তার ছোট ভাই শেহবাজ শরিফ। পিএমএলএন-এর বক্তব্য অনুযায়ী, দলের নেতা নওয়াজ শরিফ নিজেই এই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।
কিন্তু এই ঘোষণার পর রাজনীতিক ও সাংবাদিক মহলে একগাদা আলোচনার জন্ম হয়েছে। এর মাঝে উল্লেখযোগ্য হলো, এমন সিদ্ধান্ত গ্রহণের আসল কারণ কী? কিংবা, নওয়াজ শরিফকে রাজনীতির ময়দান থেকে সরিয়ে দেওয়ার জন্য এটা কোনো ষড়যন্ত্র নয় তো? কিন্তু এই সমস্ত জল্পনা-কল্পনাকে অস্বীকার করে নওয়াজ শরিফের কন্যা মারিয়াম নওয়াজ টুইটারে লিখেছেন- ‘প্রধানমন্ত্রী পদ গ্রহণ না করার অর্থ হিসেবে যদি মনে করা হয় যে, নওয়াজ শরিফ রাজনীতির মাঠ ছেড়ে চলে যাচ্ছেন, তাহলে সেটা সম্পূর্ণ ভুল ধারণা। পরবর্তী পাঁচ বছরে তিনি কেবল সক্রিয় রাজনীতিই করবেন না, সেইসাথে তিনি ফেডারেশন এবং পাঞ্জাবে তার সরকারকে সবরকম পৃষ্ঠপোষকতাও করবেন।’
মারিয়াম নওয়াজ আরও বলেছেন, ‘অতীতের তিন নির্বাচনে জনগণ নওয়াজ শরিফকে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা দিয়েছে এবং তিনি তার নির্বাচনী ভাষণে স্পষ্টভাবে বলেছেন যে, তিনি কোনো জোট সরকারের অংশ হবেন না। যারা নওয়াজ শরিফের স্বভাব সম্বন্ধে পরিচিত, তারা জানেন যে, তিনি তার নীতিতে কতটা অটল। শেহবাজ শরিফ এবং আমি তার নেতৃত্ব ও তত্ত্বাবধানে কাজ করবো।’
মারিয়াম নওয়াজের এই ব্যাখ্যার পর আরও কিছু প্রশ্ন থেকে যায় এবং সেগুলোর উত্তরই আমরা খোঁজার চেষ্টা করবো।
‘নওয়াজ শরিফ প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী হবেন’, এমন গুঞ্জন কেন তৈরি হয়েছিল?
নির্বাচনি প্রচারণার সময় পিএমএল-এন জনগণকে এমন একটি ধারণা দিয়েছিল যে, তিনবারের প্রধানমন্ত্রী, পিএমএল-এন প্রধান নওয়াজ শরিফই চতুর্থবারও পিএমএল-এন থেকে প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী হবেন। নির্বাচনের আগে বিভিন্ন জনসভা এবং গণমাধ্যমে দেওয়া সাক্ষাৎকারে দলের নেতারা নওয়াজ শরিফকে প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী হিসেবে ঘোষণা করেছিলেন।
এ প্রসঙ্গে পিএমএলএন-এর জ্যেষ্ঠ নেতা মোহাম্মদ জুবায়ের বলেন, ‘এটা না করলে এই নির্বাচনে পিএমএলএন যত ভোট পেয়েছে, হয়ত বা সেটা পেত না।’
দলটির আরেক জ্যেষ্ঠ নেতা এবং সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রানা সানাউল্লাহ বেসরকারি টিভি চ্যানেল জিও-কে দেওয়া সাক্ষাৎকারে এই বিষয়টিকে ব্যাখ্যা করে বলেন, পিএমএল-এন প্রথম দিন থেকেই নওয়াজ শরিফকে চতুর্থবারের মতো প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দেখতে চেয়েছিল। কিন্তু নির্বাচনে পিএমএল-এন একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়নি। তাই দল শেহবাজ শরিফকে সামনে আনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
তিনি আরও বলেন, কোনো দলই একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়নি। কিন্তু দিনশেষে এটা জনগণের সিদ্ধান্ত এবং আমরা তাদের এই সিদ্ধান্তকে সম্মান জানাই। রানা সানাউল্লাহর মতে, নওয়াজ শরিফ নিজে এবং দলের অন্য নেতারা বিশ্বাস করেন যে, শেহবাজ শরিফ জোট সরকারকে আরও দক্ষতার সাথে পরিচালিত করতে পারবেন।
পিএমএল-এন’র জ্যেষ্ঠ নেতা মোহাম্মদ জুবায়ের বলেন, বর্তমানে নওয়াজ শরিফের সঙ্গে ‘স্ট্যাবলিস্টমেন্ট’, অর্থাৎ প্রভাবশালী মহলের খুব ভালো সম্পর্ক। তাই, প্রভাবশালী মহল এখন নওয়াজ শরিফের জন্য হুমকিস্বরূপ না। তিনি বলেন, ‘নওয়াজ শরিফ একজন সফল নেতা হিসেবে রাজনীতিতে প্রত্যাবর্তন করতে চেয়েছিলেন এবং তিনি এও প্রমাণ করতে চেয়েছিলেন যে, তার সঙ্গে জনগণের সমর্থন ও সহানুভূতি আছে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সেটা হয়নি। বরং, জনসমর্থন দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে গিয়েছিল।’ তিনি বলেন, রাজনীতিতে চার বছর অনেক লম্বা সময় এবং নওয়াজ শরিফ মনে হয় এটা বুঝতে পেরেছেন।
‘মানুষ তার প্রতি সহানুভূতিশীল। কিন্তু এই নির্বাচনে এটা পরিষ্কার হয়ে গেছে যে, চার বছর পর দেশে ফিরে এসে আপনি খুব সহজেই আবার নিজের জায়গা তৈরি করে নিতে পারবেন না।’
রানা সানাউল্লাহ বলেন, রাজনীতিতে পূর্ব অভিজ্ঞতা থাকার কারণেই শেহবাজ শরিফ এই মনোনয়ন পেয়েছেন। তিনি বলেন, শেহবাজ শরিফের ১৩টি রাজনৈতিক দলের সমন্বয়ে গঠিত জোট সরকারকে (পিডিএম) ১৬ মাস ধরে সফলভাবে পরিচালনা করার অভিজ্ঞতা রয়েছে। তাই, সামগ্রিক পরিস্থিতি বিবেচনা করে দলের শীর্ষ এবং জ্যেষ্ঠ নেতারা মনে করেছেন, এই অবস্থায় শেহবাজ শরিফেরই দলের নেতৃত্ব দেওয়া উচিত।
‘নওয়াজের প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী না হওয়ার সিদ্ধান্ত ভালো’
তবে পিএলএম-এন-এর রাজনীতি পর্যবেক্ষণকারী বিশ্লেষকদের মতে, প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী না হওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে ভালো করেছেন নওয়াজ শরিফ। পাকিস্তানের জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক নুসরাত জাভেদ, যিনি আশির দশক থেকে এখন পর্যন্ত অনুষ্ঠিত হওয়া পাকিস্তানের সব সাধারণ নির্বাচন কাভার (সংবাদ সংগ্রহ) করেছেন; তার মতে, নওয়াজ শরিফের প্রধানমন্ত্রী না হতে চাওয়ার সিদ্ধান্ত মোটেও বিস্ময়কর কিছু না। তিনি বলেন, এখানে অবাক হওয়ার মতো কিছু নেই। কারণ, নওয়াজ শরিফ একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা না পেয়ে প্রধানমন্ত্রী হতে চাননি এবং এরকম কিছুর ইঙ্গিত তিনি নির্বাচনের দিনই দিয়েছিলেন।
এ বিষয়ে আরও ব্যাখ্যা করতে গিয়ে মোহাম্মদ জুবায়ের বলেন, ‘আরেকটি বিষয় হলো, এর আগের ১৬ মাসের পিডিএম বা জোট সরকারের ‘ব্যর্থতা’ নওয়াজ শরিফ নিজ চোখে দেখেছেন। তিনি জানেন যে, জোট সরকারের প্রতিটি রাজনৈতিক দলের মানসিকতা ভিন্ন এবং তাদের সবাইকে একত্রিত করা খুবই কঠিন একটি কাজ। তাই, প্রধানমন্ত্রী না হওয়ার সিদ্ধান্ত তার নিজের জন্য ভালো।’
এমআই