ড. মুহাম্মদ তাজামুল হক
রমাদান নিয়ে সবার কমবেশি বিভিন্ন রকমের পরিকল্পনা থাকে। বিশেষত পরিবারে ইফতার নিয়ে বাঙ্গালী নারীদের থাকে বিশেষ পরিকল্পনা। সারাদিন পানাহার থেকে বিরত থেকে শারীরিক দুর্বলতা নিয়ে সন্ধ্যায় তৈরি করতে হয় নানারকম খাবার। এতে নারীর মানসিক চাপ ও স্বাস্থ্যের ব্যাপক ক্ষতির পাশাপাশি পারিবারিক আর্থিক অপচয় হয়। এক্ষেত্রে নবীজির ইফতার ও সাহুর পরিকল্পনা আমাদের কিছুটা স্বস্তি দিতে পারে।
নবীজি (সা.) পানাহারে বিশেষ কিছু নিয়ম মেনে চলতেন। তিনি রমাদানে নিজেকে সুস্থ ও সবল রাখতে ইফতার ও সাহুর পরিকল্পনায় সাধারণ সহজলভ্য স্বাস্থ্যসম্মত ও পুষ্টিগুণে সমৃদ্ধ খাবার নির্বাচন করেছেন। ইফতার পরবর্তী দুআ থেকে তা অনুমেয়। তিনি বলতেন:
ذَهَبَ الظَّمَاءُ وابتلَّت الْعُرُوْقُ وَ ثَبَتَ الْأَجْرُ اِنْ شَاءَ اللهُ
উচ্চারণ: ‘জাহাবাজ জামাউ; ওয়াব্তাল্লাতিল উ’রুকু; ওয়া ছাবাতাল আঝরূ ইনশাআল্লাহ।’
অর্থ : ‘(ইফতারের মাধ্যমে) পিপাসা দূর হলো, শিরা-উপশিরা সিক্ত হলো এবং যদি আল্লাহ চান সাওয়াবও স্থির হলো’ [আবু দাউদ, আস-সুনান, ২৩৫৭]।
পিপাসা নিবারণ ও জীবনীশক্তি সঞ্চারণকে সামনে রেখে নবীজি (সা.) ইফতার ও সাহুরে সহজলভ্য নিন্মোক্ত খাদ্যপদ নির্ধারণ করেন।
এক. রুতাব, তামার ও পানি: রুতাব হচ্ছে, তাজা খেজুর। নবীজির (সা.) সবচেয়ে পছন্দের বিষয় কাঁচা খেজুর দিয়ে ইফতার ও সাহুর করা। শুকনো খেজুরকে বলা হয় ’তামার’। রুতাব সংগ্রহে না থাকলে তিনি ’তামার’ দিয়ে ইফতার ও সাহুর করতেন। সর্বশেষ পর্যায়ে সম্বল ছিল পানি। তাও মদীনায় স্বচ্ছ ও সুমিষ্ট পানির অভাব ছিল। মদীনার উপরিভাগ থেকে নেমে আসা পানি ছিল খেজুরের মতো কালো রঙ্গের। কোনো কিছু না থাকলে শুধুমাত্র সে পানি দিয়ে তিনি ইফতার ও সাহুর করতেন।
عَنْ أَنَسِ بْنِ مَالِكٍ، قَالَ " كَانَ النَّبِيُّ صلى الله عليه وسلم يُفْطِرُ قَبْلَ أَنْ يُصَلِّيَ عَلَى رُطَبَاتٍ فَإِنْ لَمْ تَكُنْ رُطَبَاتٌ فَتُمَيْرَاتٍ فَإِنْ لَمْ تَكُنْ تُمَيْرَاتٌ حَسَا حَسَوَاتٍ مِنْ مَاءٍ "
আনাস ইবনু মালিক (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) মাগরিবের সালাত আদায়ের আগেই কিছু তাজা খেজুর দিয়ে ইফতার করতেন। তাজা খেজুর না পেলে কিছু শুকনো খেজুর দিয়ে ইফতার করে নিতেন। আর যদি শুকনা খেজুর না পেতেন তবে কয়েক ঢোক পানি পান করে নিতেন [তিরমিযী, আস-সুনান, ৬৯৪]
দুই. পানি মিশ্রিত ছাতু: সমকালীন আরবের প্রচলিত ও সহজলভ্য খাবার ছিল ছাতু। পানির সাথে ছাতু মেশানোকে ‘জাদহ’ বলা হয়। ইবন আবু আওফা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন,
كُنْتُ مَعَ النَّبِيِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فِي سَفَرٍ، فَصَامَ حَتَّى أَمْسَى قَالَ لِرَجُلٍ: انْزِلْ فَاجْدَحْ لِي
“এক সফরে আমি নবীজি (সা.)-এর সঙ্গে ছিলাম। তিনি সন্ধ্যা পর্যন্ত সাওম পালন করেন। এরপর এক ব্যাক্তিকে বললেন, সওয়ারী থেকে নেমে ছাতু গুলিয়ে নিয়ে আসো [মুসলিম, আস-সহীহ, ১১০১]।
রমাদানের শিক্ষা সবকিছুতে পরিমিতিবোধ চর্চা। এ মাসে সারাদিন খাদ্য গ্ৰহণ থেকে বিরত থাকার পর অনেক কিছু খেয়ে ফেলার মনে হতে পারে। নবীজি (সা.) ইফতারে অনধিক ৩ টি (তিন) খেজুর খেয়েছেন [আবু ইয়ালা, আল-মুসনাদ, ৩৩০৫]। সিয়াম পালনের দিনগুলোতে খাবারে পরিমিতিবোধ সৃষ্টি নবী জীবনের শিক্ষা। তাই ইফতার ও ইফতার পরবর্তী রাতের খাবার হালকা ও হজমযোগ্য হওয়া বাঞ্ছনীয়। সারাদিন সাওম আদায়ের পর অনেক কিছু একসঙ্গে খেয়ে ফেললে হিতে বিপরীত হয়। তারাবির ও কিয়ামুল্লাইল করা অসম্ভব হয়ে উঠে। উপরন্তু শরীরের জন্য হয়ে যেতে পারে ক্ষতির কারণ। ইবনুল কায়্যিম (র.) ইফতারে নবীজির (সা.) পরিমিতিবোধের বিশ্লেষণ করে লিখেছেন,
" وَفِي فِطْرِ النَّبِيِّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ مِنَ الصَّوْمِ على الرطب، أَوْ عَلَى التَّمْرِ، أَوِ الْمَاءِ تَدْبِيرٌ لَطِيفٌ جِدًّا، فَإِنَّ الصَّوْمَ يُخَلِّي الْمَعِدَةَ مِنَ الْغِذَاءِ، فَلَا تَجِدُ الْكَبِدُ فِيهَا مَا تَجْذِبُهُ وَتُرْسِلُهُ إِلَى الْقُوَى وَالْأَعْضَاءِ، وَالْحُلْوُ أَسْرَعُ شَيْءٍ وُصُولًا إِلَى الْكَبِدِ، وَأَحَبُّهُ إِلَيْهَا، وَلَا سِيَّمَا إِنْ كَانَ رُطَبًا، فَيَشْتَدُّ قَبُولُهَا لَهُ، فَتَنْتَفِعُ بِهِ هِيَ وَالْقُوَى ، فَإِنْ لَمْ يَكُنْ، فَالتَّمْرُ لِحَلَاوَتِهِ وَتَغْذِيَتِهِ، فَإِنْ لَمْ يَكُنْ، فَحَسَوَاتُ الْمَاءِ تُطْفِئُ لَهِيبَ الْمَعِدَةِ، وَحَرَارَةَ الصَّوْمِ، فَتَتَنَبَّهُ بَعْدَهُ لِلطَّعَامِ، وَتَأْخُذُهُ بِشَهْوَةٍ " .
”নবীজির (সা.) কাঁচা খেজুর বা শুকনো খেজুর কিংবা পানি দিয়ে ইফতার করার মাঝে রয়েছে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ রহস্য। প্রকৃতপক্ষে, সাওম পাকস্থলিকে খাদ্যশুন্য করে। ফলে যকৃত তাতে এমনকিছু খুঁজে পায় না যা জীবনীশক্তি সঞ্চালনে এবং অঙ্গগুলিতে প্রেরণ করা যায়। মিষ্টদ্রব্য লিভারে দ্রুত পৌঁছে এবং তা উপযুক্তও বটে; বিশেষত যদি তা কোমল খেজুর হয়, তবে তা সহজে হজমযোগ্য হয় এবং তা দ্বারা শক্তি সঞ্চারিত হয়; আর যদি এমনটি না থাকে তবে শুকনো, তাতেও রয়েছে মিষ্টতা এবং পুষ্টিগুণ। যদি তাও না পাওয়া যায়, তবে পানি। কেননা, তা পাকস্থলির উষ্ণতা এবং সাওমের উত্তাপ নিবারণ করে। তারপর তা খাদ্য গ্ৰহণের জন্য প্রস্তুত করে এবং সাগ্রহে তা গ্ৰহণ করে" [ইবনু আল-কায়্যিম, যাদু আল-মাআদ, ৪/২৮৭]।
আল্লাহ তাআলা আমাদের পরিবারগুলোতে রমাদানে পরিমিতিবোধ চর্চার তৌফিক দিন।
লেখক
ড. মুহাম্মদ তাজামুল হক, সহযোগী অধ্যাপক, ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।
আরইউ