জাহিদুল ইসলাম, রাবি প্রতিনিধি:
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে স্থানীয় লোকজনের সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে গত বছরের ১১ মার্চ। আজ সোমবার ঘটনার এক বছর পূর্ণ হলেও তদন্তের প্রতিবেদনে কী আছে, সেটি জানা যায়নি। তদন্ত প্রতিবেদনের ফাইল কোথায় আছে সেটিও জানেন না কেউ। বিশ্ববিদ্যালয়ের সদ্য সাবেক রেজিস্ট্রার বলছেন, তিনি ফাইল উপাচার্য দফতরে পাঠিয়েছেন।
তবে সেটি জানেন না বলে জানিয়েছেন উপাচার্য। নিয়মানুযায়ী উপাচার্যের স্বাক্ষরের পর সেটি সিন্ডিকেটে উত্থাপিত হওয়ার কথা থাকলেও প্রতিবেদন জমা হওয়ার ১০ মাস পেরোলেও সেটি উত্থাপিত হয়নি। ফলে ঘটনার রহস্য উন্মোচিত হয়নি।
বিশ্ববিদ্যালয়ের জ্যেষ্ঠ শিক্ষকেরা বলছেন, সত্য উদঘাটন ও তদন্তের সুপারিশ অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। কিন্তু বর্তমানে সেটি সত্য ধামাচাপা দেওয়ার মাধ্যম হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রশাসন আন্দোলন স্তিমিত করার জন্যই তদন্ত কমিটি গঠন করে। যার ফলে এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি হওয়ার আশঙ্কা প্রকাশ করছেন তাঁরা।
প্রতিবেদনের বিষয়ে তদন্ত কমিটির আহ্বায়ক ও সহ-উপাচার্য অধ্যাপক হুমায়ুন কবীর বলেন, তারা ঘটনা তদন্ত করে একটি তদন্ত প্রতিবেদন প্রস্তুত করেন। পরে সেটি রেজিস্ট্রার দপ্তরে জমা দেন।
বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন রেজিস্ট্রার অধ্যাপক আবদুস সালাম বলেন, তদন্ত কমিটি তার কাছে প্রতিবেদন জমা দিয়েছিল। তিনি সেটি উপাচার্য দপ্তরে পাঠিয়েছিলেন। কিন্তু সেটি সিন্ডিকেট সভায় উত্থাপিত হয়নি।
তদন্ত প্রতিবেদন কেন সিন্ডিকেট সভায় উত্থাপিত হয়নি এ ব্যাপারে জানতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক গোলাম সাব্বির সাত্তার মুঠোফোনে বলেন, ‘সবকিছুই সিন্ডিকেটে যায় না। ফাইল কোথায় আছে, আমি এই মূহুর্তে বলতে পারব না। দেখতে হবে আমার দপ্তরে আছে কি না।’ তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের একাধিক দায়িত্বশীল সূত্র জানিয়েছে, বিষয়টি স্পর্শকাতর হওয়ায় উপাচার্য হয়তো সেটি সামনে নিয়ে আসতে চাননি।
বিশ্ববিদ্যালয় সূত্রে জানা গেছে, গত বছরের ১১ মার্চ সন্ধ্যায় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থীর সঙ্গে একটি বাসের সুপারভাইজারের সঙ্গে কথা-কাটাকাটির জেরে বিনোদপুর বাজারে সংঘর্ষের সূত্রপাত হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে স্থানীয় লোকজন এ সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়েন।
হামলা-সংঘর্ষ ও পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ছোড়া কাঁদানে গ্যাসের শেলে আহত হন দুই শতাধিক শিক্ষার্থী। এ সময় একটি পুলিশ বক্স ও রাস্তার ধারের অন্তত ৩০টি দোকান পুড়িয়ে দেওয়া হয়। ঘটনার প্রতিবাদে ১২ মার্চ সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত বিক্ষোভ করেন শিক্ষার্থীরা। এ সময় তাঁরা চারুকলা সংলগ্ন রেললাইন ও ঢাকা-রাজশাহী মহাসড়কে অগ্নিসংযোগ করে সড়ক অবরোধ করেন। এ ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন, পুলিশ ও রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিদের আসামি করে তিনটি পৃথক মামলা করে।
সংঘর্ষের দুই দিন পর ১৩ মার্চ বিশ্ববিদ্যালয়ের সহ-উপাচার্য অধ্যাপক হুমায়ুন কবীরকে আহ্বায়ক করে পাঁচ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। কমিটিকে সাত কার্যদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়। তবে দুই মাসেরও বেশি সময় পর রেজিস্ট্রার দপ্তরে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেয় কমিটি। পরে সেটি উপাচার্যের দপ্তরে হস্তান্তর করে সাবেক রেজিস্ট্রার অধ্যাপক আবদুস সালাম। কিন্তু প্রতিবেদন জমা হওয়ার ১০ মাস পেরোলেও সেটি আজও সিন্ডিকেটে উত্থাপিত হয়নি। জানা যায়নি প্রতিবেদনে কী আছে। ফলে ব্যবস্থা গ্রহণ করা সম্ভব হয়নি দোষীদের বিরুদ্ধে।
সত্য ধামাচাপা ও আন্দোলন স্তিমিত করার জন্যই তদন্ত কমিটি গঠন করা হয় বলে মন্তব্য করেছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ফরিদ উদ্দিন খান। তিনি বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়গুলো নামমাত্র তদন্ত কমিটি গঠন করে। তাঁরা কোনো রকম একটা দায়সারা রিপোর্ট জমা দেয়।
অনেক ক্ষেত্রে আবার ভালো করে রিপোর্ট জমা দিলেও কর্তৃপক্ষ আলোর মুখ দেখান না। সত্য উদঘাটন ও তদন্ত প্রতিবেদন অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণের জন্যই তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। যাতে মানুষ সত্য ঘটনাটি জানতে পারে এবং ভবিষ্যতে এ ধরনের ঘটনার যেন পুনরাবৃত্তি না ঘঠে। প্রতিবেদন প্রকাশ না হওয়ার ক্ষেত্রে প্রশাসনের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয় থাকে। এই জায়গায় প্রশাসনের নৈতিক দৃঢ়তার ঘাটতি আছে বলে মনে হয়।
পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক সালেহ্ হাসান নকিব বলেন, ‘এটিই একমাত্র ঘটনা নয়। এ রকম আরও অনেক ঘটনা আছে, যেগুলোর প্রতিবেদন এখনও প্রকাশিত হয়নি। বর্তমানে যে কোনো দুর্ঘটনা বা কেলেঙ্কারি ঘটলেই দেখা যায় একটা তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। পরে তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনও তৈরি করা হয়। কিন্তু সেই প্রতিবেদন আর সামনে আসে না। একটা সময় মানুষও সেই ঘটনা ভুলে যায়। এসব তদন্ত কমিটির ঘটনা বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়ের রীতিতে পরিণত হয়েছে।’
বিশিষ্ট নাট্যজন ও ম্যানেজমেন্ট স্ট্যাডিজ বিভাগের অধ্যাপক মলয় ভৌমিক বলেন, যখন কোন স্পর্শকাতর বিষয় নিয়ে সবার মধ্যে রাগ, ক্ষোভের সৃষ্টি হয় তখন বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। কারণ এর ফলে বিষয়টি আপাতত থেমে যায়। বিশ্ববিদ্যালয়ের বেশিরভাগ ঘটনার ক্ষেত্রে এমনটি ঘটে।
এভাবে অসংখ্য তদন্তের প্রতিবেদন আলোর মুখ দেখে না। আমি গত ৩০ বছর ধরে একই অবস্থা দেখে আসছি। কেউ কখনো প্রতিবেদন প্রকাশের জন্য কথা বলে না, রাস্তায় দাঁড়ায় না। কখনো কখনো সেন্টিমেন্ট, লোকাল ইন্টারেস্ট এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের বৃহৎ স্বার্থে প্রতিবেদন প্রকাশ করা না হলেও সব ক্ষেত্রে তো বিষয়টি একরকম না। অন্যায় হলে যদি শাস্তি না হয় তাহলে অন্যায় প্রশ্রয় পেয়ে যায়।
সময় জার্নাল/এলআর