আল জাবের রাফি, বুটেক্স প্রতিনিধি
রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ। পবিত্র ঈদ-উল ফিতর ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের একটি বিশেষ উৎসব। পবিত্র এক মাস সিয়াম সাধনার পর এই দিনটি তারা খুব আমেজের সাথে পালন করে। দীর্ঘ সময় ঘর থেকে দূরে থাকা শিক্ষার্থীরা এই সময় ঈদের খুশি ভাগাভাগি করে নিতে ফিরে যায় আপন আঙ্গিনায়। এই খুশিতে অন্যমাত্রা দেয় 'ঈদ কেনাকাটা’।
বেশিরভাগ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা এখন আত্মনির্ভরশীল। তাদের ঈদ কেনাকাটা পুরোটা সাড়ে টিউশনে পাওয়া অর্থ দিয়ে। যদিও বাধ সাধে প্রতিটি পণ্যের গলাকাটা মূল্যে। এ যেন সাধ থাকতেও বাধা দেয় সাধ্য। চলুন শুনে আসা যাক চড়া দ্রব্যমূল্যের এই বাজারে বাংলাদেশ টেক্সটাইল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুটেক্স) শিক্ষার্থীদের ঈদের কেনাকাটা নিয়ে ভাবনা—
বুটেক্সের ৪৭তম ব্যাচের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক শিক্ষার্থী বলেন, এবারের ঈদ আমার জন্য বিগত বছরগুলোর চেয়ে অনেকটাই ভিন্ন। কারণ যখনই মনে হয়েছে জীবনের আঁকাবাঁকা মূহুর্তগুলো উতরে নিজেকে গুছিয়ে নিতে পেরেছি তখনই দুঃসংবাদ আসলো বাবা চাকরি হারিয়েছেন। এমতাবস্থায় পরিবারের পাশে দাঁড়াতে নিজের ব্যস্ততা আরও বাড়িয়ে দেই। তাছাড়া বর্তমানে বাজারে দ্রব্যমূল্যের লাগামহীন ঊর্ধগতিতে যেখানে প্রত্যেকেরই নাভিশ্বাস অবস্থা সেখানে আমাদের জন্য ঢাকা শহরে থাকা যেন বিলাসিতা মনে হলো। এর মাঝে এই রমজান মাসে মরার উপর খাঁড়ার ঘা-র মতো আমাদের বাসায় চুরি হলো। চুরি হওয়া জিনিসপত্রের মাঝে আমার তিল তিল করে টিউশনের জমানো টাকায় কেনা ল্যাপটপটাও ছিলো যেটা আগত পরীক্ষার প্রস্তুতির জন্য খুব বড় সহায়ক ছিলো। ভেবেছিলাম এই ঈদে পরিবারের সবাইকে কিছু উপহার দিব আর নিজের জন্য একটা পাঞ্জাবি কিনবো। কিন্তু পরিস্থিতির এমন বেহাল দশায় নিজের জন্য তো দূরে থাক বাবাকে একটা টি-শার্ট গিফট করা ছাড়া আর কাউকেই তেমন কিছু গিফট করতে পারিনি। এর মাঝেই মনে হলো রমজান মাস ধৈর্য্যের মাস, তাই ধৈর্য্য ধারণ করাই সবচেয়ে উত্তম হবে আমার জন্য এই পরিস্থিতিতে।
একই ব্যাচের সনাতন ধর্মাবলম্বী শিক্ষার্থী সৌমিক সাহা জানান, ঈদুল ফিতর হিন্দু ধর্মানুসারিদের উৎসব না হলেও বন্ধুবান্ধবদের সাথে কেনাকাটা অনেকটা হয়ে যায়। তিনিও গিয়েছিলেন বন্ধুর সাথে পাঞ্জাবি কেনার সঙ্গী হয়ে। নিজেও কিনেছেন একটি পাঞ্জাবি। অনলাইন-অফলাইন প্রতিক্ষেত্রেই পাঞ্জাবির মূল্য যেন আকাশচুম্বী। বিশেষত ঈদের এই সময়টায় সব ছেলেই পাঞ্জাবি কেনার চেষ্টা করে। কিন্তু এবছর চড়া মূল্যের বাজারে গুণমান এবং দাম সবকিছু মিলিয়ে পাঞ্জাবি পাওয়া বেশ কষ্টসাধ্য হয়ে গেছে।
৪৮তম ব্যাচের শিক্ষার্থী তায়াসসুক ইমাম জানান, সন্তান হিসেবে বাবা-মার জন্য কিছু একটা করতে পারাই যেন সবচেয়ে বড় সার্থকতা। কেনাকাটার অভিজ্ঞতা তেমন না থাকায় এবং আকাশ ছোঁয়া দামের জন্য এই ঈদের বাজারে বাবার জন্য একটি পাঞ্জাবী এবং মায়ের জন্য একটি থ্রি পিসই কিনতে পেরেছেন তিনি। তাও কিনেছেন সারা বছর টিউশনের জন্য টাকা দিয়ে। নিজের জন্য কিছু কেনার ইচ্ছা থাকলেও চড়ামূল্যের বাজারে তা আর সম্ভব হয়নি।
একই ব্যাচের শিক্ষার্থী সাঈদ ফাতিন বলেন, ভার্সিটিতে ভর্তি হওয়ার পর এইটা আমার দ্বিতীয় ঈদ। এইবারও ঈদ শপিং ঢাকা থেকেই করা হয়েছে। চেষ্টা করেছি বিভিন্ন ব্র্যান্ডের দোকান থেকে নিতে কারণ এইসব জায়গায় রুচিশীল পণ্য সহজেই পাওয়া যায় যদিও আউটলেটগুলোতে আমার কিছু ক্ষেত্রে দাম একটু বেশি মনে হয়েছে। তাও ঈদ খুশির সামনে এইসব দাম বাধা হয় নি। টিউশনি আর কোচিং করিয়ে কিছুটা স্বাবলম্বী হওয়ার পর থেকেই পরিবারের জন্য প্রতি ঈদে কিছু উপহার দেয়ার চেষ্টা করি এইবার ও তার ব্যাতিক্রম হয় নি, নিজের সামর্থ্যের মধ্যে পরিবারের জন্য ঈদে কিছু নিয়ে যাওয়ার আনন্দের তুলনা হয় না।
একই ব্যাচের আরেক শিক্ষার্থী তানভীর হাসান তন্ময় বলেন, আগে এক হাজার টাকা হলে আমার মার্কেট হয়ে যেত সেখানে এখন এই টাকায় নিজের জন্য একটা ভালো শার্ট কেনাও মুশকিল হয়ে যাচ্ছে। বাড়ির সবার জন্য কিনতে গেলে বাজেট দশ হাজার পেরিয়ে যাচ্ছে যেখানে আমার টিউশনের বেতন মাত্র সাত হাজার টাকা। তাই সবাইকে দেয়ার ইচ্ছা থাকলেও তা সম্ভব হয় না। জিনিসপত্রের দাম আমাদের মত মধ্যবিত্তদের নাগালের বাইরে, আমরা চাইলেও সব কিনতে পারিনা। অনেক ভেবে চিনতে দামাদামি করে সবচেয়ে কমদামী জিনিসটাই আমাদের কিনতে হয়। বাবা-মা বেসরকারি শিক্ষক। তারা এখনো মাসের বেতন ও বোনাস পায়নি। বাবার খামার থাকায় গরু বিক্রির টাকা দিয়ে পরিবারের সবার মার্কেট করতে পেরেছি এবার। কিন্তু অনেকের তো তাও নেই, তারা কিভাবে করছে আল্লাহ ভালো জানেন। এগুলো ভাবলেই খারাপ লাগে সবসময়, মনে হয় যদি আরেকটু সাপোর্ট করতে পারতাম পরিবারকে।
৪৯তম ব্যাচের শিক্ষার্থী নাবিলা জানান, দ্রব্যমূলের ঊর্ধ্বগতিতে নিত্য প্রয়োজনীয় সকল পণ্যই যেন আজ হাতের নাগালের বাইরে। সবকিছুর দাম যেন জনমনে ক্ষোভ বাড়িয়েই চলেছে। নিজের খরচ চালাতে আমি কয়েকটি টিউশন করাই। এই বছর প্রথমবার আমি নিজের পাশাপাশি বাবা-মা এবং বোনকেও ঈদের কেনাকাটা করে দিয়েছি। এই কারণে এবারের ঈদটা তুলনামূলকভাবে বেশি ভালোলাগার এবং আনন্দের। তবে প্রতিটি পণ্যেই কড়া মূল্যের ছাপ প্রতীয়মান ছিল।
একই ব্যাচের শিক্ষার্থী মাহমুদুল হাসান জোনায়েত জানান, ঈদের শপিং বিষয়টা বেশ আনন্দদায়ক প্রত্যেকের জন্য। তবে দ্রব্যমূল্যের উর্ধগতি, অসাধু ব্যবসায়ীদের অতি মুনাফা লিপ্সা আমাদের এই আনন্দের পথে প্রাথমিক ও সবচাইতে বড় বাধা। মাসের ১০ তারিখ এর আগে অভিভাবকদের বেতন দেয়ার অনীহা, রমজানে সকল দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতি সব মিলিয়ে অভিভাবকরাও সীমাহীন দুর্ভোগ এর মধ্যে দিনাতিপাত করছেন। তাই আপাতত ঈদের জন্য সেভাবে কিছু কেনাকাটা হয় নি তবে ইচ্ছে আছে, চেষ্টা করছি।
আরইউ