মোঃ এমদাদ উল্যাহ, চৌদ্দগ্রাম (কুমিল্লা):
# লোকবল সঙ্কটেও অগ্রগতি
# বেতন বাড়ানোর দাবি মাঠকর্মীদের
প্রত্যন্ত অঞ্চলে পরিবার পরিকল্পনা কর্মসূচি বাস্তবায়নে নিরলসভাবে কাজ করছে মাঠকর্মীরা। স্বাধীনতাত্তর পরিবার পরিকল্পনা,
গ্রামীণ মানুষের স্বাস্থ্য ও পুষ্টি সেবায় সাফল্য অর্জনে মাঠকর্মীদের ভুমিকা অপরিসীম। তাঁদের অধিকাংশ কর্ম এলাকারই
বাসিন্দা। তাঁরা মানুষের বাড়ি বাড়ি যান। তাঁরা আত্মীয়ের মতো মানুষের ঘরে যান, মানুষকে সেবা দেন, স্বাস্থ্য সচেতন করেন,
ভালো থাকার পরামর্শ দেন। এতে সারাদেশে কমেছে মাতৃমৃত্যু হার। কমেছে বাল্য বিবাহের হারও।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, সারা দেশে সরকারি ও বেসরকারি বিভিন্ন সংস্থার স্বাস্থ্য মাঠকর্মীরা কাজ করছেন। সরকারি
পর্যায়ে রয়েছে স্বাস্থ্য সহকারী, পরিবারকল্যাণ সহকারী, কমিউনিটি হেলথ কেয়ার প্রোভাইডার, সহকারী স্বাস্থ্য পরিদর্শক,
পরিবার পরিকল্পনা পরিদর্শক, ফ্যামিলি ওয়েলফেয়ার ভলান্টিয়ার, সাব-অ্যাসিস্ট্যান্ট কমিউনিটি মেডিকেল অফিসার। বিভিন্ন
বেসরকারি প্রতিষ্ঠান বা এনজিওগুলোর মাঠ পর্যায়ে রয়েছে স্বাস্থ্যসেবা দেওয়ার কর্মী। প্রত্যন্ত অঞ্চলে মাঠকর্মীদের কাজে লাগিয়ে জাতীয় কর্মকান্ডকে সফল করে তোলার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত বাংলাদেশের পরিবার পরিকল্পনা কর্মসূচি। মাঠকর্মীরা বাড়ি বাড়ি গিয়ে মানুষকে সচেতন করে হাতে তুলে দিয়েছেন জন্মনিয়ন্ত্রণ সামগ্রী। দেশের মানুষকে পরিবার ছোট রাখায় অভ্যস্ত করে তুলেছেন। স্বাধীনতাকালে একজন মা গড়ে ছয়টির বেশি সন্তান জন্ম দিতেন, বর্তমানে সেই সংখ্যা কমে প্রায় দুইয়ে নেমে এসেছে।
সম্প্রতি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পরিসংখ্যান উদ্ধৃত দিয়ে চিকিৎসা ও বিজ্ঞান সাময়িকী ল্যানসেট বলেছিল, জনসংখ্যার অনুপাতে
ভারত বা পাকিস্তানের চেয়ে বাংলাদেশে স্বাস্থ্য মাঠকর্মীর সংখ্যা বেশি। মাঠপর্যায়ে স্বাস্থ্যসেবা দেওয়ার জন্য যেসব দেশ বিশেষ
কর্মী বাহিনী গড়ে তুলেছিল, তারমধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। গত শতকের ষাটের দশকে গুটি বসন্তের টিকা দেওয়া, ম্যালেরিয়া
নিয়ন্ত্রণ ও পরিবার পরিকল্পনা কাজের মাধ্যমে এই কাজ শুরু হয়েছিল। স্বাধীনতাত্তর এই কাজ হয়েছিল আরও সু- সংগঠিতভাবে।
পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের মাঠকর্মীদের সেবাসমূহ: দীর্ঘমেয়াদি জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি, স্থায়ী জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি গ্রহণকারী দম্পতির পূণরায় সন্তান জন্মদানে সক্ষমতার জন্য সেবা, পরিবার পরিকল্পনা পদ্ধতি ব্যবহারজনিত পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া ও জটিলতা সেবা, স্বল্পমেয়াদি অস্থায়ী জন্ম নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতির সেবা, বয়ঃসন্ধিকালীন সেবা, গর্ভবতী সেবা, প্রসব সেবা, গর্ভোত্তর সেবা, মাসিক নিয়মিতকরণ ও গর্ভপাত সংক্রান্ত, প্রজননতন্ত্রের সংক্রমণ ও এইচআইভি-সংক্রমণ সেবা, ৫ বছরের কম বয়সের শিশুদের স্বাস্থ্য সেবা, সাধারণ রোগীর সেবা, জরায়ু-মুখের ক্যানসারের পূর্বাবস্থা এবং প্রাথমিক পর্যায়ের স্তন ক্যানসার নির্ণয় ও রেফার করা, নবজাতকের স্বাস্থ্য সেবা পরিচর্যা, স্থায়ী জন্ম নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতির সেবা, ঝুঁকিপূর্ণ গর্ভবতী মায়ের স্বাস্থ্য পরিচর্যা এবং রেফার করা, ইপিআই টিকাদান, বন্ধ্যা দম্পতিকে পরামর্শ প্রদান ও রেফার করা, স্বাস্থ্য শিক্ষামূলক সেবা।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর ‘মনিটরিং দ্য সিচুয়েশন অব ভাইটাল স্ট্যাটিস্টিকস অব বাংলাদেশ (এসভিআরএস) ২০২১’ জরিপ সূত্রে জানা গেছে, বর্তমানে বিবাহিত নারীদের মধ্যে ৬৪ দশমিক ৬ শতাংশের কিছু বেশি নারী আধুনিক জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি ব্যবহার করেন। এর বিপরীতে মাত্র ১ দশমিক ২ শতাংশ নারী সনাতন পদ্ধতি ব্যবহার করছেন। আগের বছরের তথ্যের সঙ্গে তুলনা করলে দেখা যায়, আধুনিক পদ্ধতির ব্যবহার বেড়েছে ২ দশমিক ৩ শতাংশ। বিপরীতে সনাতন পদ্ধতির ব্যবহার কমেছে ২০ শতাংশ। একটি নির্দিষ্ট আধুনিক জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি ব্যবহারের চিত্র বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, শহরাঞ্চলের তুলনায় প্রত্যন্ত অঞ্চলে আধুনিক পদ্ধতি ব্যবহারের মাত্রা ১ দশমিক ৪ শতাংশ বেশি। যে পদ্ধতিটি প্রত্যন্ত অঞ্চলে ৬৪ দশমিক ৯ শতাংশ নারী ব্যবহার করেন, শহরাঞ্চলে সেটির ব্যবহারের হার ৬৩ দশমিক ৫ শতাংশ। আধুনিক জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি ব্যবহারে এগিয়ে ২০-২৪ বয়সী বিবাহিতরা।
জরিপের তথ্য সংগ্রহের সময় নারীরা জানান, ১৫-৪৯ বছর বয়সী ৬৫ দশমিক ৬ শতাংশ বিবাহিত নারী যে কোনো ধরনের জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি ব্যবহার করছেন। প্রত্যন্ত এলাকায় বসবাসকারী নারীরা শহরাঞ্চলে বসবাসকারী নারীদের তুলনায় জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি অভিযোজন করেছেন বেশি। এছাড়া প্রত্যন্ত অঞ্চলের নারীদের তুলনায় শহুরে নারীদের মধ্যে সনাতন পদ্ধতি ব্যবহারের অনুপাত ১ দশমিক ৯ গুণ বেশি।
জনস্বাস্থ্যবিদেরা মনে করেন, স্বাস্থ্য খাতের অগ্রগতিতে অবশ্যই মাঠকর্মীদের বড় ভূমিকা আছে। সরকার সৃজনশীলভাবে স্বাস্থ্য
খাতকে এগিয়ে নিতে মাঠকর্মীদের কাজে লাগিয়েছে। এ ক্ষেত্রে অন্য দেশের অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়েছে তারা। পাশাপাশি
দেশের গবেষণালব্ধ ফলাফল কাজে লাগিয়েছে। তবে সরকারের নীতি, পরিকল্পনা, সহায়তা, নজরদারি ছাড়া সম্পূর্ণ স্বাধীনভাবে
তাঁদের পক্ষে কাজ করা সম্ভব নয়। এছাড়া তাদের বেতন বাড়ানোর দিকেও সরকারের নজর দেয়া জরুরী।
মাঠকর্মীদের সচেতনতায় স্থায়ী বন্ধাত্বকরণে উদ্বুদ্ধ হওয়া দুই সন্তানের জননী চৌদ্দগ্রাম উপজেলার কাশিনগর ইউনিয়নের ভারত সীমান্তবর্তী অশদিয়া এলাকার রহিমা বেগম বলেন, ‘আগে আমাদের মায়েরা সচেতন ছিলেন না। আমরা আট ভাই-বোন ছিলাম। কিন্তু বর্তমানে মাঠকর্মীদের কাউন্সিলিংয়ে আমরা স্বামী-স্ত্রী সচেতন হয়েছি। আমার দুই সন্তান। স্থায়ী বন্ধাত্বকরণ করেছি। আমাদের মতো অনেকেই এখন স্থায়ী বন্ধাত্বকরণ করছে। ফলে নারীরা নানামুখী সমস্যা থেকে রক্ষা পাচ্ছে। তবে এ নিয়ে আরও প্রচার-প্রচারণা দরকার বলে মন্তব্য করেন তিনি’।
উপজেলার জগন্নাথদীঘি ইউনিয়নের পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের মাঠকর্মী সুরাইয়া বেগম বলেন, ‘বিভিন্ন সেবার পাশাপাশি আমরা পরিবার পরিকল্পনা নিয়ে মানুষদের মাঝে সচেতনতা তৈরি করতে সক্ষম হয়েছি। এখন মানুষ পরিকল্পিতভাবেই সব
কিছু করে। এতে করে পরিবার পরিকল্পনায় সাফল্য অর্জন সম্ভব হয়েছে’। তিনি আরও বলেন, ‘মাঠকর্মীরা যে বেতন পান, তা
একেবারেই অপ্রতুল। বর্তমান সময়ে এই বেতনে একটি পরিবারের খরচ বহন করা কষ্টকর। তাই, সরকারের নিকট আকুল আবেদন, শিগগিরই পরিবার পকিল্পনা অধিদপ্তরের মাঠকর্মীদের বেতন বাড়ানো হোক’।
চৌদ্দগ্রাম উপজেলা পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা মোঃ আবু কাউছার বলেন, ‘লোকবল সঙ্কটেও পরিবার পরিকল্পনা কর্মসূচি
বাস্তবায়নে মাঠকর্মীরা নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে। অধিদপ্তরের তথ্য, শিক্ষা ও উদ্বুদ্ধকরণ(আইইএম) শাখার অধীনে ২০১৮ সালের জুলাই মাসে শুরু হওয়া ‘সুখি পরিবার ১৬৭৬৭’ কল সেন্টার ৩৬৫ দিন ২৪ ঘণ্টা খোলা থাকে। দিনের যে কোন সময় ফোন করে এই কেন্দ্র থেকে সেবা ও পরামর্শ পায় সেবাগ্রহীতারা। এক কথায়, সারাদেশেই মাঠকর্মীদের প্রচেষ্টায় পরিবার পরিকল্পনায় সাফল্য অর্জন সম্ভব হয়েছে’।
এমআই