শিরোনাম
আনোয়ার হোসাইন :
পড়াশোনায় একটু কম মনোযোগী আমার মেয়ে, অন্ততঃ গড় পরতা বাংলাদেশী পরিবারের চেয়ে! ছবি আঁকা, কিংবা কাউকে নকল করে দেখানো অথবা হাতে মেহেদির আলপনা এঁকে ঘন্টার পর ঘন্টা পার করে দিতে ওর কোন কষ্ট হয়না, যত কষ্ট তার পড়াশোনায়! আমার স্ত্রী খুব সিরিয়াস টাইপের ছাত্রী ছিল, যখন যেটা ধরেছে সেটা নাড়ি নক্ষত্র সহ গিলে ফেলেছে! আর তাঁরই মেয়ে এতটা অমনোযোগী কেমন করে হতে পারে, ভেবেই পায়না! এই নিয়ে সারাক্ষন দুশ্চিন্তায় মায়ের ঘুম হারাম, আর সাথে আমি কেমন ধরণের পিতা, যে মেয়ের ব্যাপারে কোন মাথা ঘামায়না, তাই নিয়ে ঘোর সন্দেহে জীবন কাটে তাঁর!
স্কুল থেকে একবার চিঠি পাঠিয়ে আমাকে জরুরী তলব! পড়িমরি করে স্কুলে ছুটে গিয়ে ক্লাসটীচার এর সাথে দেখা করতেই আমাকে প্যারেন্টিং এর উপর একগাদা উপদেশ! মেয়ের পড়াশোনা নিয়ে অনেক উপদেশ দিলেন স্কুলের জাঁদরেল টিচার মিস ফারজানা! জানিনা উনি আসলেই মিস নাকি মিসেস, যেহেতু ক্লাসের ছেলে মেয়েরা মিস ডাকে আমিও তাই লিখলাম! যাইহোক একগাদা প্রতিশ্রুতি দিয়ে এলাম স্কুলে যে আমি বিশেষ খেয়াল রাখব মেয়ের পড়াশোনায়! মনে মনে ভাবলাম, তাহলেই হয়েছে! এটা ওর মায়ের ডিপার্টমেন্ট, আমার উপর একরত্তি ভরসা নাই মেয়ের পড়াশোনা নিয়ে! আমি পারলে মেয়ের সাথে গল্প করেই কাটিয়ে দিই সারাদিন, পড়া ফাঁকি দিয়ে!
প্রথমে মেয়ে কে ইংলিশ মিডিয়ামেই দিয়েছিলাম! পরে স্কুল গুলোতে ইংলিশ ভার্সন নামে নতুন একটা শাখা খুললো, যেখানে বাংলাদেশী কারিকুলাম ইংরেজিতে শেখানো হবে! বরাবরই দেশি শিক্ষার অনুরাগী এই আমি ও আমার স্ত্রী একমত হলাম যে এই নতুন পদ্ধতিতে দেশি পড়াশোনা সবই হবে, সাথে ইংরেজীটাও রপ্ত হবে বেশ! মেয়ের জন্য খুব কষ্টদায়ক হয়নি কারণ ও ইংরেজিটা বাংলার মতোই একটা ভাষা হিসাবেই নিয়েছে, ফলে ইংরেজিতে আমাদের স্বভাবজাত দুর্বলতা ও পায়নি!
সামনে জেএসসি পরীক্ষা এল! চিন্তায় আমার স্ত্রীর ঘুম নাই, সারাক্ষন দুঃশ্চিন্তা মেয়ে না জানি কি করে এই পরীক্ষায়! সামাজিক মর্যাদার লড়াই আত্মীয় ও বন্ধু মহলে! অন্য বাচ্চারা কেমন করে প্রস্তুতি নিচ্ছে পরীক্ষার জন্য, আর আমার মেয়ে কিরকম অলস সময় পার করছে এই নিয়ে আমার স্ত্রীর মহাচিন্তা! যদি মেয়ের ক্লাসের বন্ধুরা ওর চেয়ে বেশি ভাল রেজাল্ট করে ফেলে তাহলেতো সর্বনাশ! মানে মেয়ে যদি মোটামুটি মানের একটা A গ্রেড পেলেই আমরা আকাশের চাঁদ হাতে পাই আরকি! আমার স্ত্রী ব্যাপক পরিশ্রম শুরু করে দিল মেয়েকে এই পরীক্ষার বৈতরণী পার করানোর জন্য! রাতদিন এক করে মেয়েকে নিয়ে ব্যাস্ত! ফাঁকে ফাঁকে মেয়ের বন্ধুর মায়েদের সাথে ফোনে কথা বলে জেনে নেওয়া তারা কেমন করছে! ছাত্র ছাত্রীদের চাইতে মায়েদের টেনশন হাজার গুনে বেশি, টের পেলাম হাড়ে হাড়ে!
আমাদের সময়ে মা শুধু খবর নিতেন যাতে পরীক্ষার দিন ডিম বা রসগোল্লা জাতীয় কিছু না খাই, বাকিটা আল্লাহ ভরসা! এখন মায়েরা দুশ্চিন্তার ঠেলায় পারলে পরীক্ষার হলে গিয়ে পরীক্ষা দিয়ে এসে যদি খানিক শান্তি পায়! আর আমার মেয়ের মত উদাসীন ছাত্রীর মায়ের দুঃশ্চিন্তা খানিক বেশিই হবে!
পরীক্ষা শুরু হল! মেয়ে পরীক্ষার হলে ঢুকলে মায়েরা সব মুখ শুকিয়ে বাইরে বসে থাকে, যেন ভিতরে মেয়েদের বিচার চলছে! আমিও মুখ কাঁচুমাচু করে এদিকওদিক ঘুরে বেড়াই! যেন খুব চিন্তাগ্রস্ত পিতা আমি! আসলে চিন্তা করার তেমন কোন কারণ খুঁজে না পেয়ে নিজেই নিজেকে নিয়ে চিন্তিত! কেমন ধরণের বাপ আমি? এভাবে শামুকের মত ধীরগতিতে পরীক্ষার দিন গুলো পার হল! এবার শুরু হল রেজাল্টের টেনশন!
রেজাল্টের দিন যতই এগিয়ে আসছে আর আমার বাসার পরিবেশ গম্ভীর হয়ে আসছে! যেন বিচারের রায় হবে, আমরা সবাই আসামি! কিযে সাজা হয়! মানে কিযে রেজাল্ট হয়!! রাতে ঘুমাতে পারিনা, দুঃশ্চিন্তায় না! আমার স্ত্রীর চিন্তায়, যদি মেয়ের রেজাল্ট খারাপ হয় তাহলে সে বোধহয় হার্ট এটাক করবে!
আজ রেজাল্ট হবে! সকাল থেকেই প্রস্তুত সবাই, স্কুলে যাওয়ার জন্য, ওখানেই জানা যাবে আসল রেজাল্ট!
রেজাল্ট আসতে থাকল ক্লাসের সব স্টুডেন্টদের, অনেকেই ছিল যারা ভাল করার কথা কিন্ত তাদের রেজাল্ট তেমন ভাল হয়নি, মানে আশানুরূপ হয়নি! আমার স্ত্রী পারলে অজ্ঞান হয় যায় শোকে ও চিন্তায়, না জানি কি রেজাল্ট করে আমার অমনোযোগী এই মেয়ে! আরেকটু যদি সিরিয়াস হত মেয়েটা পড়াশোনায়!
ফাইনালি মেয়ের রেজাল্ট এল A প্লাস! আমার স্ত্রী যেন হঠাৎ আকাশের চাঁদ পেল হাতে! কেঁদেই ফেলল! আনন্দে! এরপর জানা গেল মেয়ে আমার গোল্ডেন জিপিএ ৫ পেয়েছে! খুশিতে আমার স্ত্রী পাগল হতে কেবল বাকি! পরে জানা গেল মেয়ে আমার সেই বছর ইংলিশ ভার্সনের ক্যাটাগরিতে ঢাকার স্কুল গুলোতে সেরা দশ জনের মধ্যে একজন! সে ট্যালেন্টপুলে বৃত্তিও পাবে! খুশিতে আমার স্ত্রী হাউমাউ করে কেঁদেই ফেলল!
আমার মেয়ে নির্বিকার! যেন এই রেজাল্ট নিয়ে এত হৈচৈয়ের কি আছে?
লেখক : আনোয়ার
ফিলাডেলফিয়া (সিটি অফ ব্রাদারলি লাভ)
ডিসেম্বর ১০, ২০২০