শিরোনাম
আনোয়ার হোসাইন :
আমার তখন রাজশাহীতে পোস্টিং, আনুমানিক ২০০৩/০৪ হবে। ইন্ডিয়ায় গেছিলাম পরিবার নিয়ে বেড়াতে। ওদেরকে ঢাকার বাসায় রেখে রাজশাহী কর্মস্থলে ফিরব তাই রাতের বাসে রওনা দিলাম। সেদিন ছিল ক্রিসমাসের ছুটি, বাসে বেশি যাত্রী তেমন ছিলনা, সবমিলিয়ে গোটা দশেক যাত্রী। আমি বরাবরের মত জেগেই আছি, রাতের বাসে কিংবা ভ্রমণের সময় ঘুম আমার তেমন একটা আসেনা। মানুষজনের ঘুমানো দেখছি, কিংবা অন্যমনস্ক হয়ে তাকিয়ে আছি আশেপাশের গ্রাম বা শহর, কখনও অন্ধকারের দিকে। ভাবছিলাম- এবারের ছুটিটা ভালই কাটল বেশ, ইন্ডিয়া ঘুরে। দিল্লিতে কয়েকদিন থেকে, জয়পুর, আজমীর, আগ্রা আবার দিল্লি হয়ে কলকাতা তারপর ঢাকা। হঠাত একটা কথা মনে পড়তেই মনে মনে হেসে উঠলাম! আগ্রার হোটেলে আমার মেয়ে ছোঁয়া হঠাৎ ঘুম ভেঙ্গে ব্যাকুল হয়ে কাঁদতে লাগল, আমরা তো থ! হোল কি মেয়ের! অনেক জিজ্ঞেস করার পর সে বলল, “আমি বাড়ি যাব। আমার একটুও ভাল লাগছেনা, তোমরা এখনি বাড়ি চল”। ওইটুকুন মেয়ের বাড়ির জন্য এত টান, বুকটা একটু চিন-চিন করে উঠল। যাইহোক অনেক বুঝিয়ে শান্ত করে বাকি সময় ভালই কাটালাম।
বাস এগিয়ে চলেছে, মাঝখানে ছোট একটা যাত্রাবিরতি সিরাজগঞ্জে, রাত প্রায় দশটা বাজে, চারিদিকে শুন-শান নীরবতা, শুধু বাসের তীব্র গতি আর পাল্লা দিয়ে হর্ন, কোন কারণ ছাড়াই। ঝড়ের বেগে নাটোর পৌঁছে গেলাম, বেশ কিছু যাত্রী নাটোরে নেমে গেল, সবমিলিয়ে জনা পাঁচেক যাত্রী তখন বাসে, সবাই ঘুমাচ্ছে, আমি ছাড়া। আমার বেশ লাগছে এই দ্রুত ছুটে চলা। নাটোর ছেড়ে বাস আবার ছুটতে শুরু করে দিল সেই পাগলা ঘোড়ার মত। বানেস্বরের কাছে আরও দুই একজন যাত্রী নেমে গেল, আমি সামনে ফাঁকা রাস্তার দিকে চেয়ে বসে আছি, এইতো আর কিছুক্ষণ, তারপরেই রাজশাহী পৌঁছে যাব। অফিসের ড্রাইভার সাহেব আলি বাসস্ট্যান্ডে থাকবে, কালকে অফিসে কিছু জরুরি কাজ, এইসব বিচ্ছিন্ন সব চিন্তাভাবনা মাথায়, রাস্তার দিকে তাকিয়ে আছি। সামনে ফাঁকা রাস্তায় দূরে একটা আখের লরি আখ বোঝাই করে নিয়ে হেলে দুলে এগিয়ে যাচ্ছে মনে হোল। আশেপাশে সুগারমিল আছে, সেখানেই যাচ্ছে ভাবলাম। আমাদের বাস তখন আবার সেই পঙ্খিরাজের মত উড়ে চলেছে, সামনের লরিটা এখন বেশ কাছে চলে এসেছে। আখের লরিগুলো এমনই হয়, মনে মনে ভাবছি, কোথাও যাওয়ার তাড়া নেই, প্রায় গরুর গাড়ির মত স্লো।
ভাল করে তাকাতেই দেখি লরিটাতো নড়ছেনা! প্রায় পুরা রাস্তা জুড়ে আখ ছড়িয়ে, অর্ধেকের বেশি রাস্তা জুড়ে ওটা নিথর হয়ে থেমে আছে! ডানে যেটুকু রাস্তা তাতে একটা সাইকেল বা বড়জোর একটা রিক্সা পার হতে পারবে! চোখ বন্ধ করে ফেললাম সাথে সাথে, কিংবা চোখ আমার অজান্তেই বন্ধ হয়ে গেল ঠিক মনে নাই। হঠাৎ নিজেকে প্রচণ্ড হালকা মনে হোল, মনে হোল আমি উড়ছি, চোখ খুলে গেল, দেখলাম বাসের ড্রাইভার ব্রেকের উপর দাঁড়ানো, প্রাণপণে চেষ্টা করে যাচ্ছে বাসটাকে নিয়ন্ত্রণ করতে! বাসটা চোখের নিমিষে ডানদিকে উলটে গেল, একবার, দুইবার, মনে হোল অনন্ত কাল ওটা রাস্তায় ঘুরপাক খাচ্ছে! আমার চোখে ভেসে উঠল আমার বড়ভাই সেলিমের কথা, সে আমার ছোট বেলায় বাস এক্সিডেন্টে মারা গিয়েছিল।
মনে পড়ল মায়ের কথা, এইতো মাত্র একঘণ্টার দুরুত্বে, ভেসে উঠল ঢাকায় রেখে আসা বউ, ছোট্ট মেয়ে ছোঁয়া, তারপর মনে হোল এভাবেই জীবনের সমাপ্তি? অনন্ত কাল ধরে বাসের ভিতর ঘুরপাক খাচ্ছি, শক্ত করে ধরে আছি সামনের কোন একটা রড বা কিছু, আর বার বার মনে ভেসে উঠছে নানা কথা। কত হিসেব নিকেশ করে ফেললাম এত অল্প সময়ে, সিনেমার ফ্ল্যাশব্যাকের মত! মৃত্যুর সময় তাহলে সময় স্থির হয়ে যায়, বুঝলাম! এখন অপেক্ষা করছি সেই সময় যখন আমার যাত্রা শুরু হবে অচিন দেশে! কিছুক্ষণ পরে বাসটা স্থির হল, আমি তখন জীবন মৃত্যুর মাঝামঝি, বুঝতে পারছিনা, আমি কি আলরেডি মারা গেছি নাকি এখনো বেঁচে?
বাসটা আর নড়ছেনা, কোন শব্দ নেই, শুধু কেউ যেন গুঙিয়ে কাঁদছে সামনে। আমি হাত বুলিয়ে দেখলাম আমার শরীরে, মনে হোল পুরা শরীরটা যেন থেঁতলে গেছে ব্যথায়! বুঝলাম বেঁচে আছি এখনো! প্রথমেই মনে হোল যেমন করেই হোক বের হতে হবে এখান থেকে, উঠে দাঁড়াতেই পায়ের নিচে কেমন মনে হোল, বাসের ভিতর ঘন অন্ধকার, পকেট থেকে মোবাইল বের করে আলো জালতেই দেখলাম পায়ের নিচে জানালা , আমি জানালার উপর দাঁড়িয়ে আছি, উপরে তাকাতেই চোখে পড়ল আকাশ! আর আমি নড়তেই বাসটাও কেমন জানি দুলে উঠল। যাক বেঁচে আছি বলেই মনে হচ্ছে, তাহলে বের হতেই হবে নাহলে আবার কখন আগুণ টাগুণ লেগে যায়! কোন রকমে উপরের জানালা একটু সরিয়ে দুইহাত দিয়ে বাদুড়ঝোলা হয়ে মাথাটা বের করতেই আমি ভয়ে নীল!রাস্তা হঠাৎ যেন দো তালা সমান উঁচুতে! আসলে বাসটা খাদে, আমি বাসের উপর থেকে লাফ দিয়ে মাটিতে পড়েই দুই হাত দিয়ে মাটি, ঘাস জাপটে ধরে নিশচুপ পড়ে থাকলাম কতক্ষণ মনে নাই!
হাচরে পাছড়ে রাস্তায় উঠে এলাম, উঠে নিজের চোখকেই বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছিল!রাস্তার পাশে বেশ নিচে খাদ আর তারপরেই একটা বড় পুকুর, খাদ আর পুকুরের ঠিক মাঝামাঝি বাসটা পড়ে আছে, আর একফুট সামনে আগালেই বাসটা পানিতে পড়ে নিশ্চিত ডুবে যেত! মনে মনে আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করলাম, আমাকে এইরককম দুর্ঘটনার পরেও বাঁচিয়ে রাখার জন্য।
ফোন করলাম রাজশাহীতে আমার সহকর্মী শিমুলকে, লোকেশন জানিয়ে বললাম যতদ্রুত সম্ভব আসতে, রাত তখন প্রায় একটা। আশে পাশের গ্রামের লোকজন আসতে লাগল, তাদেরই কেউ একজন একগ্লাশ পানি দিল, ঢকঢক করে পানি খেয়ে বললাম ভাই আপনারা দেখেন, বাসের ভিতর আর কেউ আছে কিনা! ড্রাইভার সম্ভবত আগেই লাফিয়ে নেমে গিয়েছিল, একজন মানুষ তখনও বাসের মধ্যে, বেশ আহত। লোকজন ধরাধরি করে তাকে বের করল।
শিমুল আর ওর ফ্রেন্ড ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকোর টেরিটরি ম্যানেজার (নামটা মনে পড়ছেনা) গাড়ি নিয়ে হাজির। আমি বাস কোম্পানির ঢাকার অফিসে ফোন দিয়ে জানালাম এক্সিডেন্টের কথা, রাজশাহীর ডিসি সদর ছিলেন হেমায়েত সাহেব (সম্প্রতি উনি এডিশনাল আইজি হিসেবে অবসরে), উনাকে ফোন দিলাম, উনি কথা দিলেন আহতেদের জন্য সাহায্য পাঠানোর।
আমি গাড়িতে উঠবো, দেখি শিমুল মাটিতে শুয়ে আছে, ওর ফ্রেন্ড বলল, ভাইয়া, শিমুল আপনার এক্সিডেন্ট দেখে ফেন্ট হয়ে গিয়েছে, আমি আকাশ থেকে পড়লাম, উদ্ধার করতে এসে বেচারা নিজেই জ্ঞান হারিয়েছে, বললাম ওর মুখে একটু পানির ছিটা দাও, এর মধ্যে হসপিটালে পৌঁছে যাব আশা করি।
আমরা রাজশাহী মেডিকালে পৌঁছলাম, আমার রাজশাহী অফিসের প্রায় সবাই তখন ওখানে। হাসপাতালের কেউ একজন স্ট্রেচার নিয়ে আসল, আমাকে জিজ্ঞেস করল, রোগী কে? আমি হাত দিয়ে দেখালাম শিমুলকে! সে নেতিয়ে পড়ে আছে স্ট্রেচারের উপর। বেচারা শিমুল!
কিছুক্ষণ পরে বন্ধুস্থানিও প্রফেসর ডাঃ দায়েম উদ্দিন আসলে উনাকে বললাম সব কথা, উনি হাসতে হাসতে শেষ! শিমুলের অবস্থা দেখে। আমাকেও দেখে দিলেন, তেমন কোন মেজর ইনজুরি ছিলোনা। এখানে ওখানে কিছু কাটাছিঁড়া আর মচকে যাওয়া ছাড়া।
তবে বেশ একটা ট্রমার মধ্যে দিয়ে গিয়েছি কিছুদিন, মৃত্যুকে এত কাছে থেকে দেখার এ অভিজ্ঞতা আমি ভুলেই থাকতে চেয়েও কি মনে করে লিখেই ফেললাম।
লেখক : আনোয়ার
ফিলাডেলফিয়া (সিটি অফ ব্রাদারলি লাভ)
আগস্ট ২৫, ২০২০