নিজস্ব সংবাদদাতাঃ
বিদেশে দেশ থেকে পাচার হওয়া সম্পদের তথ্য সংগ্রহে জটিলতা দেখা দিয়েছে। পাচারকারীরা একাধিক দেশের পাসপোর্ট ব্যবহার করে ভিন্ন ভিন্ন দেশে বিনিয়োগ করেছেন। তারা আবার দেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে নো ভিসা রিকয়ারমেন্ট বা এনভিআর ব্যবহার করে বিদেশী পাসপোর্ট নিয়ে দেশে নির্বিঘেœ আসা যাওয়া করছে। ফলে পাচারকৃত অর্থ কোন দেশে কী পরিমাণ পাচার করেছে তার তথ্য পেতে জটিলতা দেখা দিয়েছে। এমনি পরিস্থিতিতে এনভিআর ব্যবহারের ক্ষেত্রে কঠোরতা আরোপের সুপারিশ করেছেন সংশ্লিষ্টরা। তাদের মতে, বিদেশী পাসপোর্ট ব্যবহার করে বিশ্বের যে দেশ থেকেই বাংলাদেশে আসুক না কেন, তাদের ক্ষেত্রে এনভিআর না দিয়ে ভিসা বাধ্যতামূলক করা হলে সহজেই পাচারকৃত অর্থের তথ্য পাওয়া যাবে। বাংলাদেশের আর্থিক গোয়েন্দা ইউনিটের (বিএফআইইউ) সাথে একাধিক গোয়েন্দা সংস্থার বৈঠকে এমন পরামর্শ দেয়া হয়েছে বলে বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্র জানিয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট্ সূত্র জানিয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটনভিত্তিক গবেষণাপ্রতিষ্ঠান গ্লোবাল ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেগ্রিটির রিপোর্ট অনুযায়ী দেড় দশকে বাংলাদেশ থেকে পাচার হয়েছে প্রায় ১৮ লাখ কোটি টাকা। সুইজারল্যান্ডের ব্যাংকগুলোতে ২০২১ সালের হিসাব অনুযায়ী বাংলাদেশীদের গচ্ছিত মোট অর্থের পরিমাণ ছিল ৮৭ কোটি ১১ লাখ সুইস ফ্রাঁ (বর্তমান বিনিময় হারে বাংলাদেশী মুদ্রায় প্রায় ১২ হাজার কোটি টাকা)। চলতি বছরের মার্চ মাসের শেষে মালয়েশিয়ার সরকারি হিসাব অনুযায়ী ‘সেকেন্ড হোম’ সুবিধা নিয়ে দেশটিতে সম্পত্তি কিনেছেন ৩ হাজার ৬০৪ জন বাংলাদেশী। মালয়েশিয়ায় এই সুবিধাভোগী দেশগুলোর তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান চতুর্থ স্থানে। বিতর্কিত ব্যবসায়ী গ্রুপ এস আলম ও সামিট গ্রুপের সিঙ্গাপুরসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অর্থ পাচারের অভিযোগ রয়েছে।
এসব সংবাদ বিভিন্ন সময় দেশী বিদেশী সংবাদ মাধ্যমে উঠে এলেও গত সরকারের এসব সম্পদ উদ্ধারের তেমন কোনো পদক্ষেপ ছিল না। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মুখে গত ৫ আগস্ট স্বৈরাচারী শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করে দেশ থেকে পালিয়ে যাওয়ার পর অন্তর্বর্তী সরকার এসব অর্থ উদ্ধারে তৎপর হয়ে উঠেছে। মাঠে বিএফআইইউসহ একাধিক গোয়েন্দা সংস্থা তদারকি করছে। তারা আইএমএফ, বিশ্ব ব্যাংক, মার্কিন কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা এফবিআইসহ বিভিন্ন দেশের গোয়েন্দা সংস্থার সাথে যোগাযোগ শুরু করেছেন। মাঠপর্যায়ে কাজ করতে গিয়ে বিভিন্ন দেশের পাচার হওয়া অর্থের তথ্য সংগ্রহে যেসব জটিলতা দেখা দিয়েছে তা সম্প্রতি বিএফআইইউ বৈঠকে উঠে এসেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, ২০২৩ সালের আগস্টে সিঙ্গাপুর কর্তৃপক্ষ অর্থ পাচারকারীদের বিরুদ্ধে দেশটির ইতিহাসে সবচেয়ে বড় আকারের অভিযান চালিয়েছিল। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে অবৈধ উপায়ে অর্থ পাচারকারীদের বিরুদ্ধে এ অভিযান চালানো হয়। ব্যাপক এ অভিযানে ১০০ কোটি সিঙ্গাপুর ডলারের সমপরিমাণ সম্পদ ও নগদ মুদ্রা জব্দ করা হয়েছিল বলে আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে খবর প্রচারিত হয়। সম্প্রতি সিঙ্গাপুরে এস আলম গ্রুপের সম্পত্তি কেনা নিয়ে দেশের সংবাদমাধ্যমে আরো নিবিড় অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশিত হওয়ার পর দেশটির আর্থিক গোয়েন্দা সংস্থা দেশে-বিদেশে এ গ্রুপের সম্পদের তথ্য চেয়েছে বিএফআইইউর কাছ থেকে।
বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্র জানিয়েছে, এসব তথ্য উদ্ঘাটনের সময় নানা জটিলতা দেখা দিয়েছে। জানা গেছে, দেশের এক সময় নাগরিক ছিলেন যারা, এখন বিদেশী পাসপোর্টধারী। যেমন এস আলম বাংলাদেশী পাসপোর্ট জমা দিয়ে সিঙ্গাপুরের নাগরিকত্ব গ্রহণ করেছেন ২০২২ সালে- এমন সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। এরকম আরো অনেকেই একাধিক দেশের পাসপোর্ট ব্যবহার করেন। তারা দেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে ভিসার প্রয়োজন নেই (এনভিআর) এমন নির্দেশনা নিয়ে ভিন্ন ভিন্ন সময় ভিন্ন ভিন্ন দেশের পাসপোর্ট ব্যবহার করে দেশে আসা যাওয়া করছেন। ফলে তারা কোন দেশের পাসপোর্ট ব্যবহার করছেন তার কোনো তথ্য থাকছে না। অথচ এসব ব্যক্তি দেশ থেকে টাকা পাচার করে সিঙ্গাপুরের পাসপোর্ট ব্যবহার করে সাইপ্রাসে বিনিয়োগ করেছেন এমন অভিযোগ পাওয়া গেছে। কেউ দুবাই, মালয়েশিয়া, কানাডা, ভিয়েতনাম, মরিশাসসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বিনিয়োগ করেছেন দেশের টাকা পাচার করে। বাংলাদেশী পাসপোর্ট ব্যবহার না করায় তাদের পাচারকৃত অর্থ কোন দেশে বিনিয়োগ করেছেন তার সঠিক তথ্য পাচ্ছে না আর্থিক গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যা। সম্প্রতি বিএফআইইউ-এর সাথে একাধিক গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যদের সমন্বয় বৈঠকে এমন তথ্য উঠে এসেছে। পাচারকৃত সম্পদের সঠিক তথ্য পেতে একাধিক দেশের পাসপোর্ট ব্যবহারকারী এমন বাংলাদেশীদের ‘ভিসা প্রয়োজন নেই’ এমন ছাড়পত্র না দিতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে তারা পরামর্শ দিয়েছেন।
অপর দিকে, অনেক ব্যবসায়ী উদ্যোক্তা রয়েছেন, যারা স্থানীয় ব্যাংকগুলো থেকে বিপুল অঙ্কের অর্থ নিয়ে আর পরিশোধ করছেন না। বিগত ১৫ বছরে আওয়ামী লীগের সমর্থন নিয়ে ও রাষ্ট্রযন্ত্র ব্যবহার করে হাজার হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়ে তারা নানা অজুহাতে ব্যাংকের অর্থ আর পরিশোধ করছেন না। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে তারা এখন ঋণখেলাপি হয়ে যাচ্ছেন। এসব ঋণ খেলাপিদের অনেকেই ব্যাংকের অর্থ পরিশোধ না করেই বিদেশে চলে যাচ্ছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, সেন্ট্রাল ডাটা বেজে এসব ঋণখেলাপিদের নাম সংযুক্ত হচ্ছে। কিন্তু বিমানবন্দর দিয়ে যখন পাড়ি জমাচ্ছেন তখন ইমিগ্রেশন কর্তৃপক্ষের কাছে ঋণ খেলাপিদের তালিকা না থাকায় তাদেরকে আটকানো যাচ্ছে না। এভাবে অনেকেই দেশ থেকে পাড়ি জমালেও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কিছু করার থাকছে না। সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, সিআইবিতে ঋণ তথ্যের সাথে গ্রাহকের পাসপোর্ট নাম্বার উল্লেখ থাকলে সহজেই ঋণখেলাপিদের শনাক্ত করতে পারবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। সম্প্রতি বিএফআইইউ-এর সাথে বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যদের বৈঠকে এমন পরামর্শ দেয়া হয়েছে।
সময় জার্নাল/তানহা আজমী