নিজস্ব প্রতিবেদকঃ
সুপ্রিম কোর্টের বিচারকদের বিরুদ্ধে অসদাচরণের অভিযোগ তদন্ত ও অপসারণ সংক্রান্ত সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায়ই বহাল রেখেছেন সর্বোচ্চ আদালত। আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে সাত বছর আগে এই রায় দিয়েছিলেন আপিল বিভাগ। পরে এ রায় পুনর্বিবেচনা (রিভিউ) করতে আবেদন করেছিল রাষ্ট্রপক্ষ।
প্রধান বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদের নেতৃত্বাধীন ছয় বিচারপতির আপিল বেঞ্চ গতকাল রবিবার সেই রিভিউ আবেদন নিষ্পত্তি করে রায় দিলেন।
এই রায়ের মধ্য দিয়ে সুপ্রিম কোর্টের কোনো বিচারকের বিরুদ্ধে অসদাচরণের অভিযোগ উঠলে তদন্ত সাপেক্ষে তাঁকে অপসারণ করতে পারবে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল, যে ক্ষমতা আগে সংসদের হাতে নিয়েছিল আওয়ামী লীগ সরকার।
আদালতে রিভিউ আবেদনের পক্ষে শুনানি করেন রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা (অ্যাটর্নি জেনারেল) মো. আসাদুজ্জামান। রিটকারীর পক্ষে শুনানি করেন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী মনজিল মোরসেদ। এ ছাড়া সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির পক্ষ থেকে রিভিউ শুনানিতে অংশ নেন সাবেক সম্পাদক রুহুল কুদ্দুস কাজল।
বিচারপতিদের পদত্যাগ নিয়ে রাষ্ট্রপক্ষের সম্পূরক আবেদন ও শুনানি
শুনানিতে অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান বলেন, ‘ষোড়শ সংশাধনী বাতিল করে আপিল বিভাগের দেওয়া রায়ে ৯৬ অনুচ্ছেদের ২ থেকে ৭ উপ-অনুচ্ছেদ পর্যন্ত পুনর্বহালের কথা বলা হয়েছে। কিন্তু বর্তমান মুদ্রিত সংবিধানে ৯৬ অনুচ্ছেদের ১ ও ৮ উপ-অনুচ্ছেদ রাখা হয়নি। ফলে বিচারকদের পদত্যাগ নিয়ে অস্পষ্টতা রয়ে গেছে। এটি দূর করতেই অতিরিক্ত গ্রাউন্ডে সম্পূরক আবেদন করেছি।
মো. আসাদুজ্জামান বলেন, ‘ষোড়শ সংশোধনীর মাধ্যমে ৯৬ অনুচ্ছেদের ৪ উপ-অনুচ্ছেদে বিচারপতিদের পদত্যাগসংক্রান্ত ৮ অনুচ্ছেদটি প্রতিস্থাপন করা হয়। এই প্রতিস্থাপনকেও অবৈধ ও সংবিধান পরিপন্থী বলে বাতিল করেছেন আপিল বিভাগ। যেহেতু ষোড়শ সংশোধনী বাতিলই রয়েছে, সেহেতু পদত্যাগের বিষয়ে এই অস্পষ্টতা তৈরি হয়েছে।’
তখন প্রধান বিচারপতি প্রশ্ন রেখে বলেন, ‘তাহলে বিচারপতিদের পদত্যাগের পদ্ধতি বা পন্থা কী হবে?’ জবাবে অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, ‘এ জন্যই অতিরিক্ত গ্রাউন্ডে (যুক্তিতে) সম্পূরক রিভিউ আবেদন করা হয়েছে। আবেদনটি গ্রহণ করার জন্য আরজি জানাচ্ছি।
এরপর শুনানি করেন সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সাবেক সম্পাদক রুহুল কুদ্দুস কাজল।
শুনানিতে রিটকারীপক্ষের আইনজীবী মনজিল মোরসেদ বলেন, ‘যদি কেউ নিজ ইচ্ছায় পদত্যাগ করতে চান সে ক্ষেত্রে কোনো আইন বা বিধানের প্রয়োজন নেই। ৯৬(৮) অনুচ্ছেদ না থাকার পরও সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিরা পদত্যাগ করেছেন এবং তা কার্যকর হয়েছে। ফলে আমি মনে করি, রিভিউ আবেদনটি সরাসরি খারিজ করা হোক।’
এরপর রায় দেন আদালত। রায়ে প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘সংবিধানের পুরো ৯৬ অনুচ্ছেদটি পুনঃস্থাপন করা হলো। আর রাষ্ট্রপক্ষের রিভিউ আবেদনটি পর্যবেক্ষণসহ নিষ্পত্তি করা হলো।
সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী অবৈধ ঘোষণা করা সর্বোচ্চ আদালতের রায় পুনর্বিবেচনার (রিভিউ) আবেদন মঞ্জুর বা খারিজের ওপর নির্ভর করছে সুপ্রিম কোর্টের বিচারকদের অপসারণক্ষমতা সংসদের ওপর ন্যস্ত হবে, নাকি সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের হাতে থাকবে।’
তিন বিচারকের বিরুদ্ধে অসদাচরণের অভিযোগ
প্রায় সাত বছর ধরে রিভিউ আবেদনের নিষ্পত্তি ঝুলে থাকার মধ্যে ২০১৯ সালের ২২ আগস্ট অসদাচরণের অভিযোগে হাইকোর্টের তিন বিচারককে বিচারকাজ থেকে বিরত থাকতে বলা হয়। এরপর তিন বিচারক ছুটিতে যান। পরে তাঁদের ছুটির মেয়াদ বাড়ানো হয়। ছুটিতে যাওয়ার পাঁচ বছর পরও তাঁদের বিরুদ্ধে ওঠা অসদাচরণের অভিযোগের সুরাহা হয়নি। অথচ তাঁরা বিচারক হিসেবে সব সুযোগ-সুবিধাই ভোগ করছেন।
এই তিন বিচারক হলেন বিচারপতি সালমা মাসুদ চৌধুরী, বিচারপতি কাজী রেজাউল হক এবং বিচারপতি এ কে এম জহিরুল হক।
ষোড়শ সংশোধনীর পূর্বাপর
সুপ্রিম কোর্টের বিচারকদের অপসারণের ক্ষমতা সংসদের হাতে ফিরিয়ে নিতে ২০১৪ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর সংবিধানের ৯৬ অনুচ্ছেদ সংশোধনের প্রস্তাব সংসদে পাস হয়, যা ষোড়শ সংশোধনী হিসেবে পরিচিত। পরে সুপ্রিম কোর্টের ৯ জন আইনজীবীর রিট আবেদনে হাইকোর্ট ২০১৬ সালের ৫ মে এই সংশোধনী অবৈধ ঘোষণা করেন।
২০১৭ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি আপিল শুনানিতে অ্যামিকাস কিউরি নিয়োগ দেন আপিল বিভাগ। ওই বছরের ৮ মে হাইকোর্টের দেওয়া রায়ের বিরুদ্ধে আপিল শুনানি শুরু হয়, চলে ১১ দিন। শুনানির পর রাষ্ট্রপক্ষের আপিল খারিজ এবং হাইকোর্টের রায় বহাল রেখে ৩ জুলাই রায় দেন সর্বোচ্চ আদালত। এর মধ্য দিয়ে সংবিধানের ৯৬ অনুচ্ছেদের ছয়টি উপ-অনুচ্ছেদ পুনরুজ্জীবিত করেন সর্বোচ্চ আদালত। ফলে ১৯৭৭ সালে সামরিক শাসক জিয়াউর রহমানের সময় করা সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের বিধান ফিরে আসে সংবিধানে।
ষোড়শ সংশোধনী বাতিল করায় সংবিধানের ৯৬ অনুচ্ছেদের ছয়টি ধারা পুনর্বহাল হয়। কাউন্সিলের দায়িত্ব সম্পর্কে ৪ নম্বর ধারায় বলা আছে, বিচারকদের জন্য পালনীয় একটি আচরণবিধি কাউন্সিল নির্ধারণ করে দেবে এবং একজন বিচারকের বিরুদ্ধে অভিযোগ পেলে সে বিষয়ে তদন্ত করবে।
তদন্ত করার পর কাউন্সিল যদি সংশ্লিষ্ট বিচারকের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ বা তাঁর অসামর্থ্যের প্রমাণ পায় এবং বিষয়টি রাষ্ট্রপতিকে জানায়, তাহলে ৬ নম্বর দফা অনুসারে রাষ্ট্রপতি ওই বিচারককে অপসারণের আদেশ দেবেন। আর ৭ নম্বর ধারায় বলা হয়েছে, তদন্তের ক্ষেত্রে কাউন্সিলই নিজের কর্মপদ্ধতি ঠিক করবে এবং সুপ্রিম কোর্টের মতো ক্ষমতা ধারণ করবে।
২০১৭ সালের ১ আগস্ট ৭৯৯ পৃষ্ঠার পূর্ণাঙ্গ রায়টি প্রকাশ পেলে ওই বছরের ২৪ ডিসেম্বর রাষ্ট্রপক্ষ রায় পুনর্বিবেচনার (রিভিউ) আবেদন করে। এরপর বিভিন্ন সময় এই আবেদন আপিল বিভাগের কার্যতালিকায় এলেও রাষ্ট্রপক্ষ ও রিটকারীপক্ষের আবেদনে শুনানি পিছিয়ে যায়। গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার আন্দোলনে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ঘটে। এরপর গত ৮ আগস্ট নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে প্রধান উপদেষ্টা করে অন্তর্বর্তী সরকার গঠন করা হয়। সরকার গঠনের পর ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে পদত্যাগ করেন প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসানসহ আপিল বিভাগের পাঁচ বিচারপতি। পরে ১০ আগস্ট দেশের ২৫তম প্রধান বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ পান সৈয়দ রেফাত আহমেদ। এ অবস্থায় ষোড়শ সংশোধনী মামলার রিভিউ আবেদনের শুনানি করতে আপিল বিভাগে আবেদন করে রিটকারীপক্ষ।
এখন আর প্রশ্ন তোলার কোনো সুযোগ নেই : অ্যাটর্নি জেনারেল
অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান সাংবাদিকদের বলেন, ‘যে মুহূর্তে ষোড়শ সংশোধনী বাতিল করা হয়েছে, সেই মুহূর্ত থেকে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল রিভাইভ (পুনরুজ্জীবিত) হয়েছে। ফলে সাত বছর আগে আপিল বিভাগ যে রায় দিয়েছেন, সেই রায় কার্যকর ছিল, আছে। এখানে কোনো অস্পষ্টতা নেই। আর রিভিউ নিষ্পত্তি করে রায় দেওয়ার পর এখন আর প্রশ্ন তোলার কোনো সুযোগ নেই।’
আরেক প্রশ্নে অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, ‘অসদাচরণের অভিযোগ ওঠা বিচারপতিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার পথ খোলা ছিল, এটি এখন আরো বেশি খোলা হলো। একটা দরজার দুইটা কপাট থাকে। আগে হয়তো একটা কপাট খোলা ছিল, এখন দুইটা কপাটই খুলে গেল।’
অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, ‘সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল পুনরুজ্জীবিত হওয়া মানে বিচার বিভাগ দুর্বৃত্তায়ন, রাজনীতির খপ্পর থেকে বেরিয়ে এসেছে। তাঁরা (প্রধান বিচারপতিসহ আপিল বিভাগের জ্যেষ্ঠ দুই বিচারপতি) যেন তাঁদের শক্তি, মেরুদণ্ড সঠিকভাবে কাজে লাগাতে পারেন। তাঁরা যদি কাজে না লাগান, ইতিহাস বিচার করবে।’
রিটকারীপক্ষের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী মনজিল মোরসেদ বলেন, ‘সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল বহাল ছিল, আছে। তার পরও রিভিউ আবেদন করেছিল রাষ্ট্রপক্ষ। আবেদনটি নিষ্পত্তি করে সংবিধানের ৯৬ অনুচ্ছেদ পুরোটা প্রতিস্থাপন করে দিয়েছেন। ফলে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের মাধ্যমে বিচারপতিদের অপসারণ করতে আর কোনো বাধা থাকছে না।’
সময় জার্নাল/তানহা আজমী