রুহুল সরকার, রাজীবপুর(কুড়িগ্রাম): একসময় অপ্রচলিত ফলের তালিকায় ছিল লটকন। কিন্তু এখন এটি সম্ভাবনাময় ফল। ভালো বাজার মূল্য এবং ভোক্তাদের চাহিদা থাকায় দেশের বিভিন্ন স্থানে বাণিজ্যিকভাবে চাষ করা হচ্ছে লটকন।
লটকন গাছের কান্ড থেকে শুরু করে ডালপালা পর্যন্ত ঝুলন্ত পুষ্পমঞ্জরিতে থোকায় থোকায় ফল ধরে। ফলের রং হলুদ বর্ণের ভেতরে দুই থেকে পাঁচটি পর্যন্ত বীজ হয়, বীজের উপরের রসালো অংশ খাওয়া হয়ে থাকে। জাতভেদে ফলটি টক এবং টকমিষ্টি আকারেও ছোট বড় হয়।
লটকন Euphorbiaceae পরিবারের অন্তর্ভুক্ত এর বৈজ্ঞানিক নাম Baccaurea sapida। বিভিন্ন দেশে এটিকে বুনোফল হিসেবে বিবেচনা করা হয়।তবে বাংলাদেশ, থাইল্যান্ড,মালয়েশিয়া সহ আরও কয়েকটি দেশে বানিজ্যিক ভাবে এর চাষ শুরু হয়েছে।লটকনের ইংরেজিতে নাম Burmese Grapes (বার্মিজ গ্রেপ) হলেও আমাদের দেশে অঞ্চল ভেদে নটকো, বুবি, বুগি, লটকো সহ আরও বিভিন্ন নামে ডাকা হয়।
মার্চ মাসের দিকে লটকনগাছে ফুল আসে এবং ফল পরিপক্ব হতে প্রায় চার থেকে পাঁচ মাস সময় লাগে। জুন জুলাই ও আগস্ট মাস পর্যন্ত লটকন বাজারে পাওয়া যায়।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে,স্বল্প পরিসরে কুড়িগ্রামের সদর উপজেলার কয়েকটি ইউনিয়ন এবং রাজারহাট উপজেলা, লালমনিরহাট সদর উপজেলার বড়বাড়ী ও মোগলহাট ইউনিয়ন লটকন চাষ হয়।এছাড়াও নরসিংদী জেলার সদর উপজেলা, শিবপুর, বেলাব, মনোহরদীতে প্রচুর পরিমাণে লটকন চাষ হচ্ছে। এ ছাড়া গাজীপুর, ময়মনসিংহ, মানিকগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ ও সিলেট জেলার বিভিন্ন উপজেলায়ও বাণিজ্যিকভাবে চাষাবাদ শুরু হয়েছে।
লটকনের রয়েছে নানাবিধ পুষ্টি গুণ।এতে সবচেয়ে বেশি থাকে ভিটামিন সি এই ভিটামিন ত্বক, দাঁত ও হাড় সুস্থ রাখে। প্রতিদিন দুই থেকে তিনটি লটকন খেলে শরীরে ভিটামিন সি’র চাহিদা পূরণ করতে পারে।এই ফলে নানা রকম খনিজ উপাদান রয়েছে। এর মধ্যে পটাশিয়াম, ক্যালসিয়াম, ক্রোমিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম উল্লেখযোগ্য। এইসব উপাদান শরীরকে সুস্থ রাখে। প্রতি ১০০ গ্রাম লটকনে ৯ গ্রাম ক্যালসিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম, পটাশিয়াম ও ক্রোমিয়াম থাকে। রক্ত ও হাড়ের জন্য বিশেষ উপকারী আয়রন। প্রতি ১০০ গ্রাম লটকনে ৫.৩৪ মি.গ্রা আয়রন থাকে।লটকনে ভিটামিন বি পাওয়া যায়। প্রতি ১০ গ্রাম লটকনে ১০.০৪ মি.গ্রা ভিটামিন বি ওয়ান ও প্রতি ১০০ গ্রামে ০.২০ মি.গ্রা ভিটামিন বি টু পাওয়া যায়।
লটকনে রয়েছে অ্যামাইনো অ্যাসিড ও এনজাইম যা দেহ গঠন ও কোষকলার সুস্থতায় কাজে লাগে। এইসব উপাদান রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে সাহায্য করে।লটকনে কিছু পরিমাণে প্রোটিন ও ফ্যাট পাওয়া যায়। প্রতি ১০০ গ্রাম লটকনে ১.৪২ গ্রাম প্রোটিন ও ০.৪৫ গ্রাম ফ্যাট থাকে। এতে ভিটামিন সি থাকায় চর্মরোগ প্রতিরোধে সাহায্য করে। বমি ও বমিভাব দূর করার পাশাপাশি মানসিক অবসাদ দূর করতেও সাহায্য করে লটকন।
জ্যৈষ্ঠ মাসের গরমে তৃষ্ণা মিটাতে লটকন খাওয়া যায় কারন এতে জলীয় অংশের পরিমাণ বেশি থাকে।
লটকনের পাতার আছে ঔষধি গুণ ! এর পাতা ও শিকড় খেলে পেটের নানারকমের অসুখ ও জ্বর ভালো হয়ে যায়। লটকনের বীজ গনোরিয়া রোগের প্রতিষেধক হিসেবে কাজ করে। ডায়ারিয়া দূর করতে লটকনের পাতার গুঁড়া বেশ ভালো ফল দেয়।তবে অতিরিক্ত অথবা একাধিকবার লটকন খেলে ক্ষুধা মন্দা দেখা দেয়।
লটকনের বীজ মূল্যবান রং উৎপাদনে ব্যবহৃত হয়। সিল্ক, তুলা ও পোশাকশিল্পে এ রং ব্যবহার করা হয়।
লটকনের বংশবিস্তার দুভাবে হয়ে থাকে। বীজ ও অঙ্গজ পদ্ধতিতে। লটকনের পুরুষ ও স্ত্রী-গাছ আলাদা হয়ে থাকে। বীজ দ্বারা বংশবিস্তার করলে স্ত্রী গাছের চেয়ে পুরুষ গাছের সংখ্যা বেশি হয় এবং ফল পেতে ৫ থেকে থেকে ৭ পর্যন্ত সময় লাগে। অঙ্গজ বা গুটি কলম পদ্ধতি ব্যবহারে তিন বছরের মধ্যে ফল পাওয়া যায় কলমের গাছ কিছুটা খাটো হয় একারণে গাছ থেকে ফল তোলা সহজ হয়। একটি বয়স্ক গাছ থেকে প্রতি বছর ১০০ থেকে ১৫০ কেজি ফল পাওয়া যায়। খুচরা বাজারে মান ভেদে প্রতি কেজি লটকন ৫০-৮০ টাকায় বিক্রি হয়।
লটকন গাছ ছায়াযুক্ত স্থানে ভালো জন্মায় ফলে এর সবচেয়ে সুবিধা হল বসতবাড়ির আশে পাশে পতিত জমিতে ছায়াযুক্ত স্থানে এর চাষ করা যায়।বাড়িতে একটি গাছ থাকলেও পরিবারের চাহিদা মিটিয়ে বাড়তি অর্থ আয় করাও সম্ভব লটকন থেকে।
সময় জার্নাল/এমআই