নিজস্ব প্রতিবেদক:
২০০৪ সালের ২১ আগস্ট রাজধানীর বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউতে আওয়ামী লীগের সমাবেশে গ্রেনেড হামলা হয়, যার ফলে ২৪ জন নিহত এবং শতাধিক নেতাকর্মী আহত হন। বৃহস্পতিবার (১৯ ডিসেম্বর) ওই ঘটনায় দায়ের হওয়া মামলার পূর্ণাঙ্গ রায় সুপ্রিম কোর্টের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত হয়েছে। রায়ে বিচারিক আদালতের দেওয়া সাজার রায় বাতিল করে নতুন তদন্তের জন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠানোর নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। ফলে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান, সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবরসহ অনেকে ওই মামলা থেকে খালাস পেয়েছেন।
ওই দিন, শেখ হাসিনার সমাবেশে গ্রেনেড বিস্ফোরণ হয়। এতে শেখ হাসিনা অল্পের জন্য প্রাণে বেঁচে যান, কিন্তু অনেকে নিহত হন এবং আহত হন শতাধিক। আওয়ামী লীগের অভিযোগ—তৎকালীন সরকার হামলার তদন্তে যথাযথ পদক্ষেপ নেয়নি এবং বিভিন্ন রাজনৈতিক কারণে মামলার তদন্ত ভিন্ন খাতে চালানোর চেষ্টা করেছে। পরবর্তী সময়ে ২০০৭ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার মামলার নতুন করে তদন্ত শুরু করে।
প্রথমে ২০০৪ সালে মতিঝিল থানায় এই মামলাটি দায়ের হয়। মামলার তদন্তের সময় প্রথমে ২২ জনকে আসামি করে অভিযোগপত্র দেওয়া হয়, তবে পরবর্তীতে তদন্তে আরও ৩০ জনকে আসামি করা হয়। ২০০৮ সালে তদন্তের পর নতুন অভিযোগপত্র জমা দেওয়া হয়। এরপর ২০১০ সালে, আওয়ামী লীগ সরকার আমলে অধিকতর তদন্ত করা হয় এবং নতুন করে আরও আসামির নাম অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
২০১৮ সালের ১০ অক্টোবর, ঢাকা দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল-১ এই মামলায় রায় ঘোষণা করে। ট্রাইব্যুনাল ১৯ জন আসামিকে মৃত্যুদণ্ড এবং ১৯ জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড প্রদান করেন। এছাড়া, ১১ জন সাবেক পুলিশ ও সেনাবাহিনীর কর্মকর্তাকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড দেন। এদের মধ্যে সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর, সাবেক উপমন্ত্রী আবদুস সালাম পিন্টু, সেনাবাহিনীর সাবেক মেজর জেনারেল রেজ্জাকুল হায়দার চৌধুরী, সাবেক ডিজি (নিরাপত্তা) ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আবদুর রহিম এবং হানিফ পরিবহনের মালিক মো. হানিফসহ বেশ কয়েকজন শীর্ষ ব্যক্তি ছিলেন।
২০১৮ সালে বিচারিক আদালতের রায়ের পর মামলার ডেথ রেফারেন্স হাইকোর্টে পৌঁছায়। ফৌজদারি আইনে কোনো আসামির মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের আগে হাইকোর্টের অনুমোদন নেওয়া বাধ্যতামূলক। হাইকোর্ট এই রায় পর্যালোচনা করে ১ ডিসেম্বর রায় ঘোষণা করে, যেখানে বিচারিক আদালতের দেওয়া সাজা বাতিল করে। এই রায়ের ফলে, তারেক রহমানসহ অন্য ১৯ জন খালাস পেয়েছেন।
হাইকোর্টের বিচারপতি এ কে এম আসাদুজ্জামান ও বিচারপতি সৈয়দ এনায়েত হোসেনের নেতৃত্বাধীন বেঞ্চের দেওয়া রায়ে বলা হয়, প্রতিষ্ঠানগুলোর মাধ্যমে যথাযথ তদন্ত এবং বিশেষজ্ঞদের সাহায্যে নতুন করে এই মামলাটি পুনঃতদন্তের জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে। আদালত তার রায়ে আরও উল্লেখ করেন, এই মামলায় ন্যায়বিচারের স্বার্থে এবং মামলার আসামিদের বিরুদ্ধে যথাযথ অভিযোগের প্রমাণ করার জন্য একটি নতুন তদন্ত প্রয়োজন।
হাইকোর্টের আদেশের পর এই মামলার পূর্ণাঙ্গ রায় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। এর মাধ্যমে আরও তদন্তের জন্য আদেশ দেওয়া হয়েছে। শর্ত হচ্ছে— বিশেষজ্ঞ সংস্থার মাধ্যমে এই তদন্ত করতে হবে, যাতে গ্রেনেড হামলার আসল পরিকল্পনা ও ঘটনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঠিকভাবে চিহ্নিত করা যায়।
এই মামলায় উল্লেখযোগ্য কিছু বিষয় ছিল, যেমন মুফতি হান্নানের ২০১১ সালে দেওয়া স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি, যা পরে আদালত থেকে প্রত্যাহার করা হয়। সেই সময় তার জবানবন্দি অনুযায়ী, গ্রেনেড হামলার পরিকল্পনা এবং কার্যক্রমের জন্য একটি আন্তর্জাতিক জঙ্গি গ্রুপের সঙ্গে যোগসাজশ ছিল। তবে, হাইকোর্ট সেই জবানবন্দির প্রত্যাহারকেও বিবেচনায় নিয়েছে এবং তার প্রভাব মামলা রায়ে পড়েছে।
এছাড়া, মামলার ১১ আসামি সেনাবাহিনী ও পুলিশের সাবেক কর্মকর্তাদের সাজা ছিল। তাদের মধ্যে মেজর জেনারেল (অব.) এ টি এম আমীন, লে. কর্নেল (অব.) সাইফুল ইসলাম জোয়ারদার, সাবেক আইজিপি আশরাফুল হুদা, সাবেক ডিআইজি খান সাঈদ হাসান, এবং কয়েকজন অন্যান্য পুলিশ কর্মকর্তাও সাজাপ্রাপ্ত হয়েছেন।
২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলা মামলার বিচারিক রায় বাতিল করে হাইকোর্ট নতুন তদন্তের জন্য নির্দেশ দিয়েছে, যা এই মামলার বিচার কার্যক্রমে এক গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত। মামলার পূর্ণাঙ্গ রায়টি প্রকাশ হওয়ার পর, এখন বিশেষজ্ঞ সংস্থার মাধ্যমে আরও তদন্ত হবে এবং ন্যায়বিচারের পরিপূরক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
এমআই