এম.পলাশ শরীফ, বাগেরহাট:
দেশের দক্ষিণাঞ্চল মানেই যেন সারি সারি চিংড়ি ঘের। এই অঞ্চলের লবণাক্ত এলাকায় ফসল উৎপাদনের বিষয়টি একসময় কল্পনাও করা যেত না। আর এখন সেই লবণাক্ত জমিতেই ফলছে রেড বীট, ফুলকপি, টমেটাসহ নানা ফসল ও সবজি। এ যেন অন্য রকম এক সবুজের সমারোহ। এভাবে অনাবাদি জমিকে আনা হচ্ছে চাষাবাদের আওতায়। যার ফলে ভাগ্য বদলাচ্ছে উপকূলীয় জেলা বাগেরহাটের কৃষকের। এদেরই একজন উমা রায়। ৩০ বছর বয়েসি এই নারী বসবাস করেন বাগেরহাটের রামপাল উপজেলার বাসেরহুলা গ্রামে। একটা সময় তাদের গ্রামে চিংড়ি মাছ ছাড়া কিছুই হত না। এখন নিজ বাড়ীর আঙ্গিনায় ৭ শতাংস জমিতে রেড বীট, ফুলকপি বাঁধা কপি, টমেটাসহ নানা ধরনের সবজির চাষ করছেন তিনি। তার মত এই গ্রামের অনেক নারী ও পুরুষ তাদের অনাবাদি জমিতে এখন বিভিন্ন ধরনের সবজির চাষ করে নিজেদের চাহিদা মেটানোর পাশাপাশি হাট-বাজারে সবজি বিক্রি করে নিজেদের ভাগ্য ফিরিয়েছেন।
উমা রায় বলেন, দাতা সংস্থা কর্ডএইড এর কোস্টস প্রকল্পের মাধ্যমে আমিসহ আমার মত অসংখ্য কৃষক লবন জমিতে কি ভাবে সবজি চাষ করতে হয় সে বিষয়ে প্রশিক্ষণ পেয়েছি। এছাড়া কোস্টস প্রকল্পের মাধ্যমে আমাদের বিনামূল্যে লবন সহিষ্ণু সবজির বীজ, ফেরমন ফাঁদসহ নানা উপকরন সরবারহ করা হয়েছে। যে কারনে সহজে আমারা জমিতে বিভিন্ন সবজি উৎপাদন করতে পাচ্ছি। চলতি মৌশুমে আমি ১৫ হাজার টাকা ব্যায় করে ৪৫ হাজার টাকার সবজি বিক্রি করেছি। ইতি মধ্যে আমার ৩০ হাজার টাকা লাভ হয়েছে।
উমার স্বামী অনিরুদ্ধ বালা বলেন, আমি পেশায় একজন দোকানী। এছাড়া আমার কয়েকটি চিংড়ি ঘের রয়েছে, যার আয় দিয়ে আমার সংসার চলতো। একটা সময় আমাদের এখানে মাত্রাতিরিক্ত লবন পানির অধিক্যের কারনে কোন ধরনের ফসল হত না। তবে ধিরে ধিরে আমরা চিংড়ি চাষিরা সে অবস্থা থেকে বেড়িয়ে আসচ্ছি। আমরা এখন কর্ডএইড এর কোস্টস প্রকল্পের মাধ্যমে লবন মাটিতে সবজিসহ বিভিন্ন ফসল কি ভাবে উৎপাদন করতে হয় সেটা শিখেছি। এখন আমাদের গ্রামের অধিকাংশ কৃষক এখন চিংড়ির পাশাপাশি ঘের পাড়ে সবজি চাষ করে লাভবান হচ্ছেন।
একই গ্রামের বাসিন্দা তুষার কান্তি বালা বলেন, পরিবারের চাহিদা মেটানোর জন্য দুই বছর আগেও আমাদের বাজার থেকে সবজি ক্রয় করে চলতে হতো। এখন আর সেই দিন নেই, এখন আমরা নিজেরা সবজি উৎপাদনের পাশাপাশি বাজারে বিক্রি করছি। কোস্টস প্রকল্পের ভাইয়েরা আমাদের বীজ, সার, সুপেয় পানির ট্যাংকসহ নানা উপকরন দিয়ে সহায়তা করেছেন। আমাদের গ্রামের অধিকাংশ কৃষক এখন চিংড়ির পাশাপাশি সবজি চাষ করছেন।
কোস্টস প্রকল্পের বাগেরহাটের সমন্বয়কারী কৃষিবিদ মোঃ জয়নাল আবেদীন বলেন, কোস্টস একটি সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্ব ভিত্তিক প্রকল্প। যেখানে কর্ডএইড হচ্ছে নেতৃত্বদানকারী সংস্থা। প্রাইভেট সেক্টর পার্টনার হিসেবে রয়েছে লালতীর সীড লিমিটেড, একাডেমিক পার্টনার হিসেবে রয়েছে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় এবং বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে রয়েছে মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউট। প্রকল্পটি বিগত জুলাই ২০২০ সাল হতে বাংলাদেশের উপকূলীয় ৪টি বিভাগের (খুলনা, বাগেরহাট, বরগুনা এবং পটুয়াখালী) ৮টি উপজেলায় কাজ করে আসছে যার লক্ষ্য হল ২০২৪ সালের মধ্যে বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলের উপকূলীয় লবণাক্ত পতিত জমির ৫ হাজার হেক্টর জমি টেকসইভাবে ব্যবহার করা। ইতি মধ্যে আমরা বাগেরহাট সদর, শরণখোলা ও রামপাল উপজেলায় ২ হাজার ৫শ কৃষককে প্রশিক্ষণ ও জীব, সারসহ নানা উপকরন দিয়ে সহায়তা করেছি। যার ফলে জেলার ৯শ ৫০ হেক্টার অবনাক্ত অনাবাদি জমি চাষের আওতায় এসেছে।
বাগেরহাট কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক শংকর কুমার মজুমদার বলেন, আমাদের এই রামপাল উপজেলা একটি লবনাক্ত এলাকা। এখানে মাটির লবনাক্ততার পরিমান মাঝে মাঝে ৮ থেকে ১০ ডিএস হয়ে যায়। এছাড়া প্রতি বছর জুন থেকে অক্টোবর পর্যন্ত সাগরের লোনাপানি উপকূলীয় এলাকায় ঢুকে কৃষি জমিকে আরও লবণাক্ত করে তুলছে। জোয়ারের কারণেও উপকূলীয় বিস্তীর্ণ এলাকা লবণাক্ত হচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সমুদ্রের পানি তীর থেকে উপকূলের ১৮০ কিলোমিটার পর্যন্ত ঢুকে পড়েছে। ফলে এ অঞ্চলের উর্বর জমি ধীরে ধীরে লবণাক্ত হয়ে চাষের অনুপযোগী হয়ে পড়ে। আমরা আশা করি বিভিন্ন উন্নয়ন সংস্থা ও কৃষি বিভাগের আন্তরিক প্রচেষ্টায় অনাবাদি কৃষি জমি চাষাবাদের আওতায় আসবে।
উল্লেখ্য, বাংলাদেশ মৃত্তিকা সম্পদ ইনস্টিটিউট (এসআরডিআই) এর সর্বশেষ জরিপ অনুযায়ী, দেশের দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের সাতক্ষীরা, খুলনা, বাগেরহাট, বরিশাল, পটুয়াখালী, বরগুনাসহ ১৮টি জেলার ৯৩টি উপজেলায় লবণাক্ত জমির পরিমাণ ১০ লাখ ৫৬ হাজার হেক্টর। যা গত এক দশকের তুলনায় ২৩ হাজার হেক্টর বেড়েছে। আর ১৯৭৩ সালে লবণাক্ত জমির পরিমাণ ছিল ৮ লাখ ৩৩ হাজার হেক্টর। এই হিসেবে ক্রমাগত লবণাক্ত জমির পরিমাণ বাড়ছে।
এমআই