আরমান হোসেন পার্থ : স্যার আইজ্যাক ভিভিয়ান আলেকজান্ডার রিচার্ডস, বোলারদের জন্য মূর্তিমান এক আতংকের নাম নাম।অনেকের কাছে ক্রিকেটের আসল "মাস্টার ব্লাস্টার" এই ক্যারিবিয়ান গ্রেট।হেলমেট নয়, মেরুন রঙের টুপি মাথায় দিয়ে চুইনগাম চিবুতে চিবুতে কিং ভিভ উইকেটে এসে দাড়াতেন। এরপর একেবারে প্রথম বল থেকেই প্রতিপক্ষের বোলারদের উপর চড়াও হতেন। শুরু থেকে শেষপর্যন্ত আক্রমণই ছিল তার ব্যাটিংয়ের শেষ কথা। ক্রিকেট ইতিহাসের সবচেয়ে আগ্রাসী আর খুনে মেজাজের ভিভ প্রতিপক্ষের বোলিং লাইন আপকে স্রেফ খুন করতেন। ফাস্ট বোলারদের স্বর্নযুগে তিনি ছিলেন ফাস্ট বোলারদের জম। ডেনিস লিলি কিংবা জেফ থমসন অথবা ইমরান খান কিংবা কপিল দেব কেউই ভিভের হাত থেকে রক্ষা পায় নি। এমনকি ঘরোয়া ক্রিকেটে সতীর্থ ম্যালকম মার্শাল, মাইকেল হোল্ডিং জোয়েল গার্নার বা এন্ডি রবার্টসের মত দানবদের নিয়েও ছেলেখেলা করেছেন ।
হুক আর পুল শটে ভিভকে সর্বকালের সেরাদের একজন মনে করা হয়। অনসাইডে ফ্লিক ছিল ভিভের ট্রেডমার্ক শট। পারফেক্ট টাইমিং, পাওয়ার হিটিংয়ে অসামান্য দক্ষতা, দুর্দান্ত রিফ্লেক্স,নিখুঁত স্ট্যন্স এই জায়গাগুলোতে ভিভ ছিল সবার চেয়ে আলাদা, যুগের চেয়েও এগিয়ে । অফ স্ট্যাম্পের বাইরের গুড লেন্থের বলকে মূহুর্তেই সীমানা ছাড়া করতেন। ভিভ সব সময় "অ্যাক্রস দ্য লাইনে" শট খেলতে সাচ্ছন্দ্যবোধ করতেন তাই নিজের আত্নজীবনীর নাম ও দিয়েছিলেন "হিটিং অ্যাক্রস দ্য লাইন"
ভিভের ব্যাটিং সৌন্দর্যের দিকগুলো নিয়ে উইজডেনের মূল্যায়ন , “He was attacking, aggressive but not a slogger. His trademark shot was hitting across the line but his cover drives were gorgeous. He was a poet capable of violent poetry. A subtle artist who had the gift of ferocious performance. A man who made chewing gum a style statement. A man who defined swagger.”
ওয়াসিম আকরামের ভাষায়, “মার্টিন ক্রো, গাভাস্কারদের বিপক্ষে বল করা কঠিন ছিল, কিন্তু ভিভকে বল করতে গেলে রীতিমতো গলা শুকিয়ে আসত আমার।”
শুধু বোলাররা নয় প্রতিপক্ষের ফিল্ডাররা পর্যন্ত ভিভকে বিশেষ সমীহের চোখে দেখত। সাবেক উইকেটরক্ষক জেফ্রি ডুজনের ভাষায়, “নতুন ব্যাটসম্যান ক্রিজে আসলে সাধারণত ফিল্ডাররা দুই ধাপ এগিয়ে আসে। কিন্তু ভিভের বেলায় দেখেছি তার ঠিক উল্টো। ভিভ নামলে ফিল্ডাররা বরং দুই ধাপ পিছিয়ে যেত।”
ব্যাট হাতে শুধু মারমুখীই ছিলেন না, ছিলেন অসম্ভব রকমের ধারাবাহিক। ১৯৭৬ থেকে ১৯৮৮ পর্যন্ত টেস্টে একমাত্র ব্যাটসম্যান হিসেবে ৫৫ গড়ে রান করেছেন ভিভ। তার ধারাবাহিকতার ব্যাপারে স্বচ্ছ ধারনা পেতে এই একটা পরিসংখ্যানই যথেষ্ট।
তখনকার সময়ে টেস্টে ৮৬ স্টাইক রেটে ১৮২ ইনিংসে তুলেছেন ৮,৫৪০ রান। গড় যেখানে ৫০.২৪। আছে ২৪ সেঞ্চুরি এবং ৪৫ হাফ সেঞ্চুরি। অধিনায়ক হিসেবেও ভিভ ছিলেন দুর্দান্ত তার অধীনে খেলা ৫০ টেস্টের ২৭ টিতেই জিতেছে ওয়েস্ট ইন্ডিজ। হেরেছে মাত্র আটটিতে বাকিগুলো ড্র। তবে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য দিক হল তার অধীনে খেলা ১২ সিরিজের একটিতেও হারে নি তার দল, যা একটি বিশ্বরেকর্ড।
ওয়ানডেতে ক্যারিয়ার জুরে প্রায় ৯০ স্ট্রাইক রেটে ব্যাট করে গেছেন। তখনকার ক্রিকেটে যা ছিল অবিশ্বাস্য। ১৬৭ ইনিংসে ৪৭ গড়ে রান করেছেন ৬৭২১। একদিনের ১১ শতক আর ৪৫ অর্ধশতকের মালিক কিং ভিভ। তিনি ছিলেন সত্যিকারের ম্যাচ উইনার ১৮৭ ওয়ানডেতে ৩১ বার হয়েছেন ম্যাচসেরা। গড়ে ৬ ম্যাচে একবার। ম্যাচ এবং ম্যাচসেরার অনুপাতে যেটি সর্বোচ্চ।
তার সময়ে টেস্টে এবং ওয়ানডেতে সবচেয়ে কম বলে সেঞ্চুরির রেকর্ড ও ছিল তার। ওয়ানডেতে ৭২ বলে এবং টেস্টে ৫৬ বলে সেঞ্চুরি হাকিয়েছিলেন। ভিভ ছিলেন বড় ম্যাচের বড় প্লেয়ার যে কোনো টুর্নামেন্টের ফাইনলে ভিভের গড় ৫৬। বিশ্বকাপের প্রথম আসরে খুব একটা সুবিধা করতে পারে নি ভিভের ব্যাট।
দ্বিতীয় আসরেই নিজেকে স্বমহিমায় মেলে ধরেন ভিভ। ৭৯ এর বিশ্বকাপে এজবাস্টনে ভারতের বিপক্ষে অপরাজিত ২৮ রানের ইনিংস দিয়ে বিশ্বকাপ শুরু করা ভিভ ফাইনালে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে লর্ডসে ১৩৮* ম্যাচ উইনিং ইনিংস খেলে দলকে দ্বিতীয় বারেরমত বিশ্বকাপ শিরোপা জেতায়। ফাইনালের ম্যান অফ ম্যাচের পুরস্কার ও উঠেছিল ভিভের হাতে। সেমিফাইনালে পাকিস্তানের বিপক্ষে খেলেছিলেন ৪২ রানের মহামূল্যবান ইনিংস।সেই আসরে গর্ডন গ্রিনিজের পর দ্বিতীয় সর্বোচ্চ রান করেছিলেন ভিভ। ৪ ম্যাচে করেছিলেন ২১৭ রান। যার দুই ইনিংসেই ছিলেন অপরাজিত।
৮৩ বিশ্বকাপেও দারুন ছন্দে ছিল ভিভের উইলো গ্রুপপর্বে ভারতের বিপক্ষে ১১৯ পরের ম্যাচেই আবার অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে অপরাজিত ৯৫। দুটি ইনিংসই দলকে সেমিফাইনালে তুলতে দারুন ভূমিকা রেখেছিল। এরপর সেমিফাইনালে পাকিস্তানের বিপক্ষে ভিভের অপরাজিত ৮০ রানের উপর ভর করে ফাইনালের টিকিট কাটে ওয়েস্ট ইন্ডিজ। যদিও ফাইনালে ভারতের কাছে হেরে হ্যাট্রিক শিরোপা থেকে বঞ্চিত হয় ক্লাইভ লয়েডের দল। ৮৩ সালের বিশ্বকাপেও দ্বিতীয় সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক ছিলেন ভিভ। ৮ ম্যাচে ৭৩.৪০ গড়ে ভিভের রান ৩৬৭।
৮৭ এর বিশ্বকাপের শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ১২৫ বলে ১৮১ রানের বিস্ফোরক ইনিংসটি তার ওয়ানডে ক্যারিয়ারের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ রানের ইনিংস। এছাড়াও ওই বিশ্বকাপে পাকিস্তানের বিপক্ষে দুটি ম্যাচে ভিভের রান ছিল যথাক্রমে ৫১ এবং ৬৭। ১৭ বছরের আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারে ৪ টি বিশ্বকাপ খেলেছেন ভিভ। বিশ্বকাপে সব মিলিয়ে ২১ ম্যাচে ৬৩.৩১ গড়ে ভিভের রান ১০১৩। যেখানে ৩ শতকের সাথে আছে ৫ অর্ধশতক।
১৯৯১ সালে লর্ডসে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ম্যাচ দিয়ে আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারের ইতি টানেন এই অল টাইম গ্রেট।
শেষ করব হেলমেট না পড়া নিয়ে ভিবের মূল্যায়ন দিয়ে। সম্প্রতি সাবেক অজি অলরাউন্ডার শেন ওয়াটসনের সাথে পডকাস্টে এক আলাপচারিতায় ভিভ জানয়েছেন তার হেলমেট ছাড়া মাঠে নামার কারন। এ প্রসংগে ভিভ বলেন, "খেলার জন্য আমার ভালোবাসাটা ছিল এমন যে ওটা (হেলমেট না পরা) করতে গিয়ে মরলেও কোনো আক্ষেপ থাকত না। খেলাটা আমি ভালোবাসি। আর সেটি যদি ওভাবে করতে চাই তবে এর চেয়ে ভালো আর কী হতে পারে।"
এ প্রসংগে ভিভ আরো বলেন, ‘অনেক পুরুষ ও নারী ক্রীড়াবিদদের এই ঝুঁকি নিতে দেখেছি। আমি তাদের সম্মান করি। ফর্মুলা ওয়ান চালানোর ঝুঁকি তো এর (হেলমেট না পরে ব্যাটিং) চেয়েও বেশি?’ ভিভের এ কথা বলার পর ওয়াটসনের পাল্টা প্রশ্ন, ‘কোনটা? হেলমেট ছাড়াই ঘণ্টায় ১৫০ কিমি গতির বল খেলা?’
এর আগের এক সাক্ষাৎকারে ভিভ জানিয়েছিলেন মুখের সুরক্ষার জন্য এক দন্ত চিকিৎসক তাকে গার্ড রাখার পরামর্শ দিয়েছিলেন। সেটিও তিনি নির্দিধায় অগ্রায্য করেছেন। তার মতে গার্ড রাখলে চুইংগাম চিবুতে অসুবিধা হয় তাই ওটা কয়েকবার চেস্টা করেও সিদ্ধান্ত পাল্টাতে বাধ্য হয়েছি। তাছাড়া মাঠে প্রতিপক্ষের ১১ জন, সাথে আম্পায়ার সব মিলিয়ে নিজেকে সংখ্যালঘু মনে হত, তাই একমাত্র সংগী হিসেবে ওটাই মুখে থাকত। এজন্যই মূলত কখনও মুখে গার্ড পড়া হয় নি।
১৯৫২ সালে ৭ মার্চ অ্যানটিগায় জন্মানো ভিভ আজ ৬৯ বয়সে পা দিলেন। ভিভকে জন্মদিনের শেষ শুভেচ্ছে।