তাসনুভা আহমেদ:
পরিবেশের দূষণ অন্যদিকে খাদ্যে ভেজাল। বাহিরের খাবার গ্রহণ বা চারপাশের দূষণ প্রতিনিয়ত যেন বিষ ঢুকছে শরীরে। সেই বিষ বা টক্সিন যখন শরীরে বিভিন্ন অঙ্গে সঞ্চালিত তখন বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কাও বেড়ে যায় বহুগুণ। তাই শরীর থেকে বিষাক্ত পদার্থ ছেঁকে বার করে দেওয়া খুবই জরুরি। আর এই কাজে সহায়তা করতে পারে প্রাকৃতিক উপাদান। ফল-মূল, শাক-সবজি যত বেশি খাবেন তত সুস্থ থাকবে শরীর। সাথে পর্যাপ্ত পানি পান করতে হবে। যা শরীরের হাইড্রেশন বজায় রাখে।
ডিটক্স ওয়াটার কি
ফল, সবজি অথবা ভেষজের নির্যাস সমৃদ্ধ পানীয় হচ্ছে ডিটক্স ওয়াটার। একটি বড় কাচের জারে বা বোতলে খোসা না ছাড়িয়ে পছন্দের রসালো ফল, সবজি অথবা ভেষজ একসঙ্গে স্লাইস করে মিশিয়ে পানি দিয়ে ৩থেকে ৪/৫ ঘণ্টা ভিজিয়ে রেখে তৈরি করা হয় ডিটক্স ওয়াটার। এ ক্ষেত্রে বোতল বা জারটি ফ্রিজে রেখে দেওয়া যাবে। তবে আস্ত ফল ব্যবহার করা যাবে না এতে।
৩ থেকে ৪ ঘণ্টা ভিজিয়ে রাখার পর ফল, সবজি বা ভেষজ সরিয়ে ফেলতে হবে নাহলে সেগুলো পচে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে।এটিতে ক্যালোরি নেই এবং প্রয়োজনীয় পুষ্টি উপাদান রয়েছে
ডিটক্স ওয়াটার পানের কিছু উপকারিতা:
১. হজমশক্তি বাড়ায়
ডিটক্স ওয়াটার পান করার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সুবিধা হল এটি হজমশক্তি উন্নত করতে সাহায্য করে। হজম এবং মসৃণ মলত্যাগের জন্য পানি অপরিহার্য। শরীরে পানির অভাব হলে তা কোষ্ঠকাঠিন্যের কারণ হতে পারে। এর ফলে পেট ফোলা এবং অন্যান্য হজমজনিত রোগ হতে পারে। পর্যাপ্ত পরিমাণ পানি পান করলে আপনি পেটের সমস্যা দূর করতে পারেন।
২. ওজন কমানোর জন্য ডিটক্স ওয়াটার
ওজন কমানোর জন্য ডিটক্স ওয়াটার পান করা আজকাল বেশিরভাগ মানুষের কাছে পরিচিত একটি গুরুত্বপূর্ণ সুবিধা। পর্যাপ্ত পানি পান করলে, বিপাক বৃদ্ধি পায়, যা ক্যালোরি বার্ন করতে সাহায্য করেজপ। অনেকেই রয়েছেন যারা খালি পান করতে বিরক্ত বোধ করেন সেক্ষেত্রে এক টুকরো শসা, লেবু এবং কিছু পুদিনা পাতা যোগ করলে সাধারণ পানির স্বাদ উন্নত হয়।খাবারের আগে এক গ্লাস ডিটক্স জল পান করা আপনার ক্ষুধা নিবারণ করতে সাহায্য করে।
৩. নিঃশ্বাসের গন্ধ দূর করে
কোলনে ব্যাকটেরিয়া জমার ফলে নিঃশ্বাসে দুর্গন্ধ হয়। প্রচুর পরিমাণে ডিটক্স জল পান করে, আপনি আপনার অন্ত্রের অবাঞ্ছিত ব্যাকটেরিয়া এবং টক্সিন দূর করতে পারেন। এটি নিঃশ্বাসের দুর্গন্ধ কমাতে সাহায্য করে।
৪. রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা উন্নত করে
পানি শরীর থেকে ক্ষতিকারক টক্সিন এবং ফ্রি র্যাডিকেলগুলি দূর করতে সাহায্য করে, ডিটক্স ওয়াটার পান করলে ইমিউন মেকানিজমকে উপকৃত করে। পানিতে লেবু বা অন্যান্য ভিটামিন সি সমৃদ্ধ ফল এবং শাকসবজি যোগ করা হলে, সংক্রমণ এড়াতে এটি সাহায্য করে।
৫.মেজাজ এবং মেটাবলিজমে উন্নীত করে
শরীর ডিহাইড্রেশন থাকলে, ক্লান্ত বোধ হয়, যা আপনার মেজাজ এবং মেটাবলিজমকে ব্যাহত করতে পারে। প্র ডিটক্স ওয়াটার পান করলে সতেজ বোধ হয় এবং ত্বকের উজ্জ্বলতা বাড়ায়। ডিটক্স ওয়াটার পান করলপ মেজাজ উন্নীত হয়।
৬. কিডনি এবং লিভার থেকে টক্সিন পরিষ্কার করে
ডিটক্স ওয়াটার কিডনি থেকে ক্ষতিকর টক্সিন বের করে দিতে সাহায্য করে। এটি মূত্রনালীর সংক্রমণ কমাতে সাহায্য করে।একইভাবে, ডিটক্স ওয়াটার লিভারকে টক্সিন অপসারণ করতে সহায়তা করে।
কীভাবে বানাবেন ডিটক্স ওয়াটার
পছন্দের যে কোনো ফলের স্লাইস দিয়েই তৈরি করা যায় ডিটক্স ওয়াটার। সাথে দারুচিনি বা মধু যোগ করা যেতে পারে ফ্লেভারের জন্য। নিচে ওজন কমাতে, শরীরের টক্সিন দূর করতে ও স্বাস্থ্যোজ্জ্বল ত্বকের জন্য। ডিটক্স ওয়াটারের রেসিপি দেয়া হল।
১. আপেল-দারুচিনি ডিটক্স ওয়াটার
একটি আপেল পাতলা পাতলা করে স্লাইস করে কেটে নিন। সেই সঙ্গে নিন দেড় ইঞ্চির মত লম্বা একটি দারুচিনির টুকরো। কড়া ফ্লেভার চাইলে ৫০০ মি.লি পানিতে পুরোটা আপেল আর দারুচিনি রেখে দিন। আর হালকা ফ্লেভার চাইলে ৫০০ মিলি পানিতে ৩-৪ টুকরো আপেল আর এক টুকরো দারুচিনি দিন।
৩. লেবুর রস, আদা, পুদিনা ডিটক্স ওয়াটার
এক বোতল পানিতে আদা আর লেবুর পাতলা স্লাইস যোগ করুন। এরপর কিছু পুদিনা পাতাও মেশাতে পারেন৷ সকালবেলা খালি পেটে এই পানীয় খেলে হজম সংক্রান্ত সমস্যা দূর হয়।
ডিটক্স ওয়াটারের উপকারিতা
১. কমলা বা লেবুর ডিটক্স ওয়াটারে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন সি পাওয়া যায়। এটি শরীর থেকে টক্সিন দূর করে এবং ওজন কমায়।
২. দারুচিনি ও আদার ডিটক্স ওয়াটার শরীরের মেটাবলিজম ঠিক রাখে, প্রদাহ দূর করে এবং ওজন কমাতে সাহায্য করে। এ ছাড়াও দারুচিনি রক্তে শর্করার ভারসাম্য বজায় রাখে।
৩. এই পানীয় শরীরের দূষিত উপাদান দ্রুত বের করে দিতে সাহায্য করে।
৪. ডিটক্স ওয়াটার দেহেট হজম ক্ষমতা ও রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে সাহায্য করে।
৫. ত্বকের উজ্জ্বলতা বাড়ায় ও লাবণ্য ফিরিয়ে আনে।
ডিটক্স ওয়াটারের পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া
কোনও কিছুই অতিরিক্ত খাওয়া শরীরের জন্য ভাল নয়। সঠিক নিয়ম না মেনে এবং সঠিক মাত্রায় না খেলে ‘ডিটক্স ওয়াটার’ও শরীরের ক্ষতি হতে পারে।
১. প্রয়োজনের তুলনায় বেশি ডিটক্স ওয়াটার পানে অতিরিক্ত প্রস্রাবের ফলে শরীরে সোডিয়ামের মাত্রা কমতে শুরু করে। ফলে সারাদিন ক্লান্তিভাব, বমি ভাব, মাথার যন্ত্রণা হতে থাকে। শরীরের কার্যক্ষমতাও কমে যায়।
২. ডিটক্স ওয়াটার সাময়িকভাবে ওজন ঝরাতে সাহায্য করলেও দীর্ঘদিন এই অভ্যাস চলতে থাকলে বিপাকহার কমে যায়। ফলে শরীরে পেশিগুলো দুর্বল হয়ে পড়ে।
৩. যাদের কিডনির সমস্যা বা ডায়াবেটিসের মতো জটিল রোগ রয়েছে, তাদের এ ধরনের পানীয় পানের আগে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ নেয়া উচিত।
কখন পান করবেন ডিটক্স ওয়াটার
সকালে ঘুম থেকে উঠেই খালি পেটে ডিটক্স ওয়াটার না পান করাই শ্রেয়। নাহলে বুক জ্বালা অ্যাসিডিটির সমস্যা হতে পারে। পুষ্টিবিদদের মতে ডিটক্স ওয়াটার পান করার সবচেয়ে উপযোগী সময় হচ্ছে সকালে নাস্তার পর। চেষ্টা করবেন প্রতিদিন ফ্রেশ ডিটক্স ওয়াটার পান করার।
লেখক: তাসনুভা আহমেদ, পুষ্টিবিদ।