বুধবার, ২৬ মার্চ ২০২৫

বাংলাদেশে ডিহাইড্রেটেড টমেটো পাউডারের সম্ভাবনা ও চ্যালেঞ্জ

সোমবার, মার্চ ২৪, ২০২৫
বাংলাদেশে ডিহাইড্রেটেড টমেটো পাউডারের সম্ভাবনা ও চ্যালেঞ্জ

মোহাম্মদ মুরাদ হোসেন, হাবিপ্রবি:

বাংলাদেশে টমেটো একটি অত্যন্ত জনপ্রিয় সবজি হলেও এটি মৌসুমভিত্তিক ফসল হওয়ায় সংরক্ষণের অভাবে কৃষকেরা ন্যায্য মূল্য থেকে বঞ্চিত হন এবং প্রচুর টমেটো নষ্ট হয়। টমেটোর এই অপচয় রোধ করা এবং এর বহুমুখী ব্যবহারের সুযোগ বাড়ানোর জন্য ডিহাইড্রেটেড টমেটো পাউডার উৎপাদন একটি সম্ভাবনাময় সমাধান হতে পারে। 

এ লক্ষ্যে হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (হাবিপ্রবি’র) ফুড সায়েন্স এন্ড নিউট্রিশন বিভাগের মাধ্যমে কয়েকটি গবেষণা প্রকল্প সম্পন্ন করা হয়েছে। যা টমেটো পাউডারের কার্যকারিতা, সংরক্ষণযোগ্যতা এবং বাণিজ্যিক সম্ভাবনা মূল্যায়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। এ বিষয়ে লিখেছেন বিভাগটির চেয়ারম্যান প্রফেসর ড. এন. এইচ. এম রুবেল মজুমদার, সম্পাদনা করেছেন মোহাম্মদ মুরাদ হোসেন।

গবেষণার প্রক্রিয়া ও ফলাফল-

প্রথম গবেষণাঃ ২০১১ সালে বাংলাদেশের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের গবেষণা প্রকল্পের আওতায় ৪র্থ বর্ষের একটি প্রজেক্ট গ্রুপের ৩ জন ছাত্রকে নিয়ে টমেটো পাউডার তৈরির পদ্ধতি উন্নয়ন করা হয়। গবেষণার শুরুতে আমরা টমেটো ফ্লেক্স তৈরি করি এবং পরে সেটিকে গুঁড়া করে ফাইন পাউডার উৎপাদন করি। গবেষণার ফলাফলে দেখা যায়, প্রতি ১ কেজি টমেটো থেকে প্রায় ৯২% পানি অপসারিত হয় এবং প্রক্রিয়াকরণের সময় ২-৩% অতিরিক্ত ক্ষতি হয়। ফলে ১ কেজি টমেটো থেকে মাত্র ৫০ গ্রাম পাউডার পাওয়া যায় (প্রায় ৫.২৩%)। তবে, এই প্রক্রিয়ায় টমেটোর পুষ্টিগুণের পরিবর্তন ঘটে, বিশেষত বেটা-কেরোটিন ও ভিটামিন-সি এর মানগত তারতম্য দেখা যায়। এই গবেষণার একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক ছিল পটাসিয়াম মেটাবাইসালফাইট ও ক্যালসিয়াম ক্লোরাইড দ্রবণ ব্যবহার করে প্রি-ট্রিটমেন্ট, যা টমেটোর লাল রঙের স্থায়ীত্ব বজায় রাখে এবং প্রিজারভেটিভ ছাড়াই দীর্ঘদিন সংরক্ষণযোগ্যতা নিশ্চিত করে।

দ্বিতীয় গবেষণাঃ ২০২৩-২০২৪ অর্থবছরে হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (হাবিপ্রবি) আইআরটি প্রকল্প থেকে “Utilization of Dehydrated Tomato Powder for the Preparation of Ready-to-Eat (RTE) Instant Soup” শীর্ষক গবেষণা পরিচালিত হয়।এই গবেষণায়ও ৪র্থ বর্ষের ২ টি প্রজেক্ট গ্রুপ কাজে সহায়তা করে, পাশাপাশি ফুড সায়েন্স এন্ড নিউট্রিশন বিভাগের আরো ২ জন শিক্ষকও গবেষণা সহযোগী হিসেবে কাজ করেন। গবেষণায় দেশী ও হাইব্রিড জাতের টমেটো ব্যবহার করে ৬টি ফর্মুলার ট্রায়াল চালানো হয় এবং একটি গ্রহণযোগ্য মানের Ready-to-Eat (RTE) ইনস্ট্যান্ট স্যুপ তৈরি করা হয়। তবে, যেহেতু এটি এক বছরের প্রকল্প, তাই বড় পরিসরে ট্রায়াল চালিয়ে বাণিজ্যিকীকরণের সম্ভাবনা যাচাই করা প্রয়োজন।

তৃতীয় গবেষণাঃ চলতি অর্থবছরে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের বিশেষ গবেষণা অনুদানের আওতায় “Tomato Transformation: Harnessing Environmental Benefits for Crafting a Health-Boosting Beverage through Metabolomics Analysis” প্রকল্পের মাধ্যমে টমেটো থেকে উচ্চমূল্য সংযোজিত (value-added) স্বাস্থ্যকর পানীয় তৈরির গবেষণা চলছে। এই গবেষণায় Metabolomics approach ব্যবহার করে টমেটোর Functional Ingredients চিহ্নিত করা হবে, যা উন্নত জাতের টমেটো নির্বাচন এবং টমেটো জুসের বাণিজ্যিকীকরণে সহায়ক হতে পারে। 

ডিহাইড্রেটেড টমেটো পাউডারের সম্ভাবনা-

সংরক্ষণযোগ্যতা ও সরবরাহ ব্যবস্থাঃ টমেটো মৌসুমী ফসল হওয়ায় কৃষকদের অতিরিক্ত উৎপাদিত টমেটো সংরক্ষণের সুযোগ সীমিত। Dehydrated Tomato Powder উৎপাদন করলে এই সমস্যার সমাধান সম্ভব, কারণ এটি দীর্ঘদিন সংরক্ষণ করা যায় এবং মৌসুমের বাইরে সরবরাহ নিশ্চিত করা সম্ভব হয়। প্রক্রিয়াজাত পণ্যের মাধ্যমে কৃষকরা তাদের ফসল নষ্ট না করে মূল্য সংযোজন করতে পারবেন।

বহুমুখী ব্যবহার ও প্রসারিত বাজারঃ  Dehydrated Tomato Powder-এর বহুমুখী ব্যবহার রয়েছে। এটি সস, কেচাপ, জুস, ইনস্ট্যান্ট স্যুপ, নুডলস, বিভিন্ন রেডি-টু-ইট (RTE) খাবার এবং প্রক্রিয়াজাত খাদ্যশিল্পে ব্যবহারযোগ্য। বাংলাদেশের ফুড প্রসেসিং ইন্ডাস্ট্রি দিন দিন সম্প্রসারিত হচ্ছে, যা এই পণ্যের বাণিজ্যিক সম্ভাবনাকে আরও বাড়িয়ে তুলেছে।

ফাংশনাল ফুড হিসেবে গ্রহণযোগ্যতাঃ টমেটো পাউডারে উচ্চমাত্রার লাইকোপিন ও অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট উপাদান থাকে, যা হৃদরোগ প্রতিরোধ, ক্যান্সারের ঝুঁকি হ্রাস এবং ত্বকের স্বাস্থ্য উন্নয়নে সহায়ক। বিশ্বব্যাপী Functional Food-এর বাজার ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে, এবং স্বাস্থ্য সচেতন ভোক্তারা এই ধরনের পণ্য গ্রহণ করতে আগ্রহী। সঠিক প্রক্রিয়াকরণ ও ব্র্যান্ডিংয়ের মাধ্যমে এটি বাজারজাত করা হলে দেশের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক বাজারেও জনপ্রিয়তা অর্জন করতে পারে।

শিল্পায়নের সুযোগঃ বাংলাদেশে খাদ্য প্রক্রিয়াজাত শিল্প দ্রুত বিকাশমান, এবং Dehydrated Tomato Powder এই খাতের জন্য একটি সম্ভাবনাময় নতুন পণ্য হতে পারে। সঠিক প্রযুক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে এটি একটি লাভজনক শিল্পে পরিণত হতে পারে, যা কর্মসংস্থান সৃষ্টি এবং রপ্তানির মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের সুযোগ করে দেবে।

ডিহাইড্রেটেড টমেটো পাউডার উৎপাদনের চ্যালেঞ্জ -

উৎপাদন ব্যয় ও অর্থনৈতিক বাস্তবতাঃ Dehydrated Tomato Powder তৈরির জন্য টমেটো থেকে প্রায় ৯২-৯৫% জলীয় অংশ অপসারণ করতে হয়। ফলে, প্রতি ১ কেজি টমেটো থেকে মাত্র ৫০-৬০ গ্রাম পাউডার পাওয়া যায়, যা উৎপাদন ব্যয় বাড়িয়ে দেয়। এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ চ্যালেঞ্জ, কারণ বাংলাদেশের মতো বাজারে যেখানে খাদ্যের মূল্য সংবেদনশীল, সেখানে উচ্চমূল্যের পণ্য টিকে থাকা কঠিন হতে পারে। উৎপাদন ব্যয় কমানোর জন্য উন্নত প্রযুক্তির প্রয়োগ এবং উৎপাদন প্রক্রিয়ার অপটিমাইজেশন প্রয়োজন।

পুষ্টিগুণের পরিবর্তনঃ শুকানোর প্রক্রিয়ায় টমেটোর কিছু পুষ্টিগুণ পরিবর্তিত হয়। বিশেষ করে, উচ্চতাপমাত্রায় ড্রায়িং করলে লাইকোপিন, ভিটামিন-সি, এবং অন্যান্য জলীয় দ্রবণীয় পুষ্টি উপাদানের পরিমাণ হ্রাস পেতে পারে। পুষ্টিগুণ বজায় রাখার জন্য উন্নত ড্রায়িং টেকনোলজি, যেমন ফ্রিজ-ড্রায়িং বা স্প্রে-ড্রায়িং প্রযুক্তির প্রয়োগ প্রয়োজন, যা তুলনামূলক ব্যয়বহুল।

প্রযুক্তির সীমাবদ্ধতা ও দক্ষতা উন্নয়নঃ  উন্নতমানের Dehydrated Tomato Powder তৈরির জন্য উন্নত ড্রায়িং প্রযুক্তি ও আধুনিক গ্রাইন্ডিং সিস্টেম প্রয়োজন, যা বাংলাদেশে এখনো সীমিত। অধিকাংশ ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তার পক্ষে এই ধরনের প্রযুক্তিতে বিনিয়োগ করা কঠিন। তাই, সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা, প্রশিক্ষণ এবং উন্নত প্রযুক্তির সহজপ্রাপ্যতা নিশ্চিত করা প্রয়োজন।
 
সংরক্ষণ ও প্যাকেজিং ব্যবস্থাঃ টমেটো পাউডার সংরক্ষণের জন্য আর্দ্রতা-নিয়ন্ত্রিত প্যাকেজিং প্রয়োজন, কারণ এটি উচ্চ আর্দ্রতা শোষণের প্রবণতা রাখে, যা পণ্যের গুণগত মান নষ্ট করতে পারে। উন্নত প্যাকেজিং ব্যবস্থার অভাব থাকলে দীর্ঘমেয়াদে এটি সংরক্ষণ করা কঠিন হয়ে যায়, যা বাণিজ্যিকভাবে একটি বড় চ্যালেঞ্জ।
 
বাজার মূল্য ও প্রতিযোগিতাঃ বাংলাদেশে বর্তমানে কোল্ড স্টোরেজ ব্যবস্থার মাধ্যমে টমেটো সংরক্ষণ করা সম্ভব, যা সারা বছর টাটকা টমেটোর সহজলভ্যতা নিশ্চিত করছে। এর ফলে, ভোক্তারা তুলনামূলকভাবে কম দামে টাটকা টমেটো পেতে পারেন এবং পাউডারের প্রতি আকর্ষণ কমতে পারে। এই কারণে, Dehydrated Tomato Powder-এর বাজার গড়ে তোলা ও সচেতনতা বৃদ্ধি করা প্রয়োজন, যাতে এটি ভোক্তাদের কাছে সুবিধাজনক ও কার্যকর বিকল্প হিসেবে উপস্থাপিত হয়।

বাংলাদেশে ডিহাইড্রেটেড টমেটো পাউডার একটি সম্ভাবনাময় পণ্য, যা অতিরিক্ত টমেটোর অপচয় রোধ, প্রক্রিয়াজাত খাদ্য শিল্পের উন্নয়ন এবং ফাংশনাল ফুড বাজারে নতুন সম্ভাবনা তৈরি করতে পারে। তবে, উৎপাদন ব্যয়, প্রযুক্তিগত সীমাবদ্ধতা ও বাজার চাহিদা বিবেচনায় আনলে এটি কিছু চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হবে। যদি সরকার ও শিল্প উদ্যোক্তারা বিনিয়োগ করে উন্নত ড্রাইং প্রযুক্তি, সংরক্ষণ ব্যবস্থা ও বাজার সম্প্রসারণের উদ্যোগ নেয়, তবে ডিহাইড্রেটেড টমেটো পাউডার বাংলাদেশের খাদ্য শিল্পে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারবে। তাই, বাণিজ্যিকভাবে এটি সফল করতে হলে প্রযুক্তিগত উন্নয়ন, খরচ কমানোর কৌশল ও বাজার সম্প্রসারণের জন্য সুসংগঠিত উদ্যোগ গ্রহণ করা আবশ্যক।

এমআই 


Somoy Journal is new coming online based newspaper in Bangladesh. It's growing as a most reading and popular Bangladeshi and Bengali website in the world.

উপদেষ্টা সম্পাদক: প্রফেসর সৈয়দ আহসানুল আলম পারভেজ

যোগাযোগ:
এহসান টাওয়ার, লেন-১৬/১৭, পূর্বাচল রোড, উত্তর বাড্ডা, ঢাকা-১২১২, বাংলাদেশ
কর্পোরেট অফিস: ২২৯/ক, প্রগতি সরণি, কুড়িল, ঢাকা-১২২৯
ইমেইল: somoyjournal@gmail.com
নিউজরুম ই-মেইল : sjnewsdesk@gmail.com

কপিরাইট স্বত্ব ২০১৯-২০২৫ সময় জার্নাল