ইঞ্জিনিয়ার এ কে এম রেজাউল করিম:
৩০ মে ২০২৫ — শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের ৪৪তম শাহাদাতবার্ষিকী জাতি স্মরণ করছে এমন এক সন্ধিক্ষণে, যখন ‘জুলাই বিপ্লব’-এর পর বাংলাদেশের মানুষ আবার আশার আলো দেখতে শুরু করেছে। গণতন্ত্রের পথে সাহসী অভিযাত্রায়, সত্য ও ন্যায়ের স্বপক্ষে দাঁড়িয়ে শহীদ জিয়ার আদর্শ আজ আবার প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে।
শহীদ জিয়ার রাজনৈতিক জীবন এবং কৌশল ছিল বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্মোত্তর সংকটে নেতৃত্বদানের এক অনন্য দৃষ্টান্ত। তিনি শুধু একজন মুক্তিযোদ্ধা নন, ছিলেন একজন রাষ্ট্রগঠনমূলক রাজনীতিবিদ। যাঁর দূরদৃষ্টি, আত্মত্যাগ এবং কৌশলী নেতৃত্ব বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে এক নতুন অধ্যায় সূচনা করে।
স্বাধীনতা ঘোষণা ও প্রথম রাজনৈতিক আবির্ভাব
১৯৭১ সালের ঘোরতর অন্ধকারে যখন জাতি নেতৃত্বহীনতায় দোদুল্যমান, তখন চট্টগ্রামের কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে “আমি মেজর জিয়াউর রহমান, বাংলাদেশের পক্ষে স্বাধীনতা ঘোষণা করছি”—এই ঘোষণা জাতিকে মুক্তির পথে এগিয়ে দেয়। শেখ মুজিব পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করে পাকিস্তানে বন্দী অবস্থায় থাকলেও, তরুণ মেজর জিয়া সাহস নিয়ে বিদ্রোহ করেন এবং তার সঙ্গে ছিলেন ক্যাপ্টেন এম এ ওলি। এই ঘোষণা কেবল একটি সামরিক বিবৃতি ছিল না, এটি ছিল এক রাজনৈতিক উদ্ভব, যা একজন সেনানায়ককে জনগণের নেতায় পরিণত করে।
সিপাহী-জনতা বিপ্লব ও রাজনৈতিক পথচলার সূচনা
১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর সিপাহী-জনতা বিপ্লবের মাধ্যমে তিনি বন্দিত্ব থেকে মুক্ত হয়ে জাতীয় নেতৃত্বে প্রত্যাবর্তন করেন। এই ঘটনাকে কেবল একটি সামরিক পুনরুত্থান নয়, বরং জাতির অন্তর্নিহিত শক্তির জাগরণ হিসেবে দেখতে হবে, যেখানে মেজর জিয়ার আবির্ভাব ছিল আল্লাহর কুদরতি ইঙ্গিত—একজন নেতার আবশ্যকতা যখন জাতির সর্বনাশ ঘনিয়ে আসে।
জাতীয় ঐক্য গঠন ও কৌশলগত রাষ্ট্রনির্মাণ
জিয়াউর রহমান জাতিকে পুনরায় ঐক্যবদ্ধ করতে "বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ"-এর দর্শন প্রবর্তন করেন। যেখানে ভূগোল, জাতীয় সার্বভৌমত্ব এবং ইসলামি মূল্যবোধ একত্রে জাতিসত্তার ভিত্তি তৈরি করে। তিনি বাঙালি জাতীয়তাবাদের একমাত্র ভাষাভিত্তিক এবং ছদ্মধর্মনিরপেক্ষ বিপরীতে একটি বাস্তবভিত্তিক, জনসম্পৃক্ত রাজনৈতিক আদর্শ গঠন করেন। এ কৌশল ছিল জনবিচ্ছিন্ন বামপন্থা ও পরিবারতন্ত্রবাদের বিপরীতে একটি গ্রহণযোগ্য ও সার্বজনীন রূপরেখা।
মেধাভিত্তিক প্রশাসন ও পেশাদার রাষ্ট্র কাঠামো
নেতৃত্বে এসেই তিনি সৎ, দক্ষ এবং মেধাসম্পন্ন মানুষদের রাষ্ট্র পরিচালনায় অন্তর্ভুক্ত করেন—সাবেক সিএসপি অফিসার, সেনাবাহিনীর পেশাদার সদস্য এবং অভিজ্ঞ রাজনীতিবিদদের সমন্বয়ে গঠিত হয় তাঁর প্রশাসন। তিনি সামরিক বাহিনী ও আধাসামরিক বাহিনীগুলোকে চীনের সহায়তায় আধুনিকায়ন করেন এবং সিভিল সার্ভিসে নিয়োগ ও প্রশিক্ষণের সুনির্দিষ্ট কাঠামো তৈরি করেন।
বহির্বিশ্বে কৌশলগত বন্ধুত্ব
পূর্ব-পশ্চিম বিভক্ত বিশ্বরাজনীতির সুযোগ নিয়ে তিনি যুক্তরাষ্ট্র, চীন, সৌদি আরব, পাকিস্তানসহ মুসলিম বিশ্বের সঙ্গে ভারসাম্যপূর্ণ ও কৌশলগত সম্পর্ক গড়ে তোলেন। তিনি ছিলেন দক্ষিণ এশীয় আঞ্চলিক সহযোগিতা সংস্থা (SAARC)-এর অন্যতম প্রবর্তক, যার মাধ্যমে বাংলাদেশ আঞ্চলিক রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিতে শুরু করে।
বহুদলীয় গণতন্ত্রের প্রবর্তন
শেখ মুজিবের বাকশাল প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে ধ্বংসপ্রাপ্ত বহুদলীয় রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে পুনরুজ্জীবিত করেন শহীদ জিয়া। তিনি জাতীয় গণভোটের মাধ্যমে রাষ্ট্রপতি হন এবং তার পর সামরিক শাসন প্রত্যাহার করে রাজনৈতিক দল গঠনের পরিবেশ সৃষ্টি করেন। বিএনপি প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে তিনি একটি সংগঠিত জাতীয়তাবাদী রাজনৈতিক শক্তি গড়ে তোলেন, যা এখনো দেশের অন্যতম রাজনৈতিক প্ল্যাটফর্ম হিসেবে কাজ করছে।
শহীদ জিয়াউর রহমানের রাজনৈতিক কৌশল এবং রাষ্ট্রীয় দৃষ্টিভঙ্গি আজকের প্রেক্ষাপটে আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে অধিক প্রাসঙ্গিক। তিনি ছিলেন এক দূরদর্শী সৈনিক নেতা, যিনি রাজনীতির নোংরা কাদায় পা না ছুঁইয়ে একটি জাতিকে এগিয়ে নিয়ে গিয়েছেন। আজ তাঁর ৪৪তম মৃত্যুবার্ষিকীতে, যখন গণতন্ত্রের পুনর্জাগরণ ঘটছে, তখন আমাদের প্রার্থনা—আল্লাহ তাঁকে জান্নাতুল ফিরদাউস দান করুন, এবং তাঁর আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে আমরা একটি স্বাধীন, সার্বভৌম ও ন্যায়ভিত্তিক বাংলাদেশ গড়ার কাজে দৃঢ় থাকি।
শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায়, শহীদ জিয়া—আপনি ইতিহাসের এক অমর সন্তান।
লেখক: ইঞ্জিনিয়ার এ কে এম রেজাউল করিম
চেয়ারম্যান - বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী গবেষণা কেন্দ্র।