বৃহস্পতিবার, ২৬ জুন ২০২৫

যেভাবে ইরানে ব্যর্থ হলো ইসরায়েল

বুধবার, জুন ২৫, ২০২৫
যেভাবে ইরানে ব্যর্থ হলো ইসরায়েল

ওরি গোল্ডবার্গ, আল জাজিরা:

১১ দিন ধরে ইরানে টানা বিমান হামলা চালানোর পর যুদ্ধবিরতিতে রাজি হয়েছে ইসরায়েল। প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু এই যুদ্ধবিরতির ঘোষণায় দাবি করেছেন—ইসরায়েল তার লক্ষ্য পূরণ করেছে। কিন্তু এই ধরনের দাবি বাস্তবতার নিরিখে কতটা গ্রহণযোগ্য, তা নিয়ে প্রশ্ন তোলাই স্বাভাবিক।

যুদ্ধের শুরুতেই নেতানিয়াহু যে দুটি লক্ষ্য ঘোষণা করেছিলেন—এক, ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচিকে সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস করা; দুই, ইরানে 'সরকার পতন' ঘটানো—এই দুই উচ্চাভিলাষী উদ্দেশ্যের কোনোটিই বাস্তবে অর্জিত হয়েছে বলে মনে হয় না।

পারমাণবিক কর্মসূচি ধ্বংসের প্রশ্নে, বাস্তবতা হলো—যুক্তরাষ্ট্র ফোরদো স্থাপনায় হামলা চালানোর আগেই ইরান সেখানে থাকা সমৃদ্ধ ইউরেনিয়াম সরিয়ে নিয়েছিল। এই মজুতই ছিল পুরো পারমাণবিক কর্মসূচির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ। ফলে বলা যায়, পারমাণবিক কর্মসূচির 'মাথা কেটে' দেয়া বা সম্পূর্ণ ধ্বংসের লক্ষ্যটি আদতে ব্যর্থ হয়েছে।

ইসরায়েল আদৌ ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচিতে কতটা ক্ষয়ক্ষতি করেছে, তা-ও স্পষ্ট নয়। ইসরায়েল যুক্তরাষ্ট্রকে রাজি করিয়ে ইরানের পারমাণবিক স্থাপনায় 'বাংকার-বাস্টার' বোমা—ম্যাসিভ অর্ডন্যান্স পেনিট্রেটর (এমওপি)—ব্যবহার করিয়েছে, কিন্তু এর বাইরে যুক্তরাষ্ট্র খুব বেশি সহায়তা দেয়নি। আর ইরান বাইরে থেকে পরিদর্শনের সুযোগ না দিলে সেই ধ্বংসের মাত্রা নির্ধারণ করাও কঠিন।

ইসরায়েল কি ইরানে 'শাসনব্যবস্থার পরিবর্তন' ঘটাতে পেরেছে? সংক্ষেপে বললে, বাস্তবে তারা তার ঠিক উল্টো ফলই অর্জন করেছে। ইরানের বিভিন্ন নিরাপত্তা কাঠামোর শীর্ষ সামরিক নেতাদের হত্যা করে ইসরায়েল একটি গণবিপ্লব উসকে দিতে চেয়েছিল। এই কৌশল ইসরায়েলের একটি দৃঢ় বিশ্বাসের ওপর দাঁড়ানো—তাদের ধারণা, কোনো শত্রুকে দুর্বল করার সবচেয়ে কার্যকর উপায় হলো তার শীর্ষ নেতৃত্বকে হত্যা করা।

কিন্তু ইতিহাস বলছে, এই পন্থা কার্যকর হয়নি। একমাত্র সম্ভবত ব্যতিক্রম বলা যেতে পারে লেবাননে হিজবুল্লাহ নেতা হাসান নাসরাল্লাহর মৃত্যুর প্রভাব, যদিও সেটিও অনেকটাই লেবাননের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটের সঙ্গে সম্পর্কিত ছিল। বাকি সব ক্ষেত্রেই ইসরায়েলের 'টার্গেটেড' হত্যাকাণ্ড কোনো বড় ধরনের রাজনৈতিক পরিবর্তন আনতে ব্যর্থ হয়েছে।

ইরানের ক্ষেত্রে দেখা গেছে, এসব হত্যাকাণ্ড উল্টো জনগণকে সরকারের চারপাশে একতাবদ্ধ করেছে। ইসরায়েল ইরানের রেভল্যুশনারি গার্ড বাহিনীর (আইআরজিসি) শীর্ষ কমান্ডারদের হত্যা করেছে—যা বর্তমান ইরানি রাজনীতির সবচেয়ে শক্তিশালী অংশগুলোর একটি হলেও, জনগণের বড় একটি অংশের কাছে তারা ঘৃণিত।

তবুও ইসলামিক প্রজাতন্ত্র কিংবা আইআরজিসি-এর ঘোর সমালোচকরাও, এই হামলার প্রেক্ষিতে তাদের সরকারের পাশে দাঁড়িয়েছেন। তারা এটিকে শুধুমাত্র 'শাসকগোষ্ঠীর ওপর আঘাত' নয়, বরং গোটা দেশের ওপর বহিরাগত আক্রমণ হিসেবে দেখেছেন।

ইসরায়েল এই যুদ্ধে কয়েকটি 'প্রতীকী স্থাপনা'তেও হামলা চালিয়েছে। যেমন—এভিন কারাগার, যেখানে রাজনৈতিক বন্দিদের ওপর নির্যাতনের অভিযোগ আছে, কিংবা ইরানের জাতীয় সম্প্রচার সংস্থা আইআরআইবি। 

ইসরায়েল এই হামলাগুলোকে 'ইরানি জনগণের পক্ষে অবস্থান' হিসেবে উপস্থাপন করার চেষ্টা করেছে। কিন্তু বাস্তবে এসব হামলা বন্দিদের অবস্থান আরও খারাপ করেছে—তাদের অনেককে অজানা জায়গায় সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। 

অন্যদিকে, ইসরায়েল যে ইরানের রাষ্ট্রায়ত্ত সম্প্রচারমাধ্যমে বোমা হামলা চালিয়েছে, সেটিও ছিল একেবারে অযৌক্তিক। ইসরায়েল এই হামলার ব্যাখ্যায় বলেছে, তারা ইসলামি প্রজাতন্ত্রের প্রোপাগান্ডা ছড়ানোর প্রচেষ্টাকে দমন করতে চেয়েছে। কিন্তু অনেক ইসরায়েলিই উল্লেখ করেছেন, এই হামলা উল্টো ইরানকে যুক্তিযুক্তভাবে দাবি করার সুযোগ দিয়েছে যে, এখন তারা ইসরায়েলের টেলিভিশন স্টেশনগুলোকেও বৈধ লক্ষ্যবস্তু হিসেবে বিবেচনা করতে পারে।

ইসরায়েল যদি যুদ্ধের ঘোষিত লক্ষ্যগুলো পূরণে ব্যর্থ হয়েই থাকে, তাহলে কি অন্তত বিশ্বের সমর্থন আদায় করতে পেরেছে? গাজার প্রসঙ্গকে পেছনে ঠেলে আবারও কি নিজেদের 'ন্যায্য যুদ্ধের' পক্ষ হিসেবে তুলে ধরতে পেরেছে? সম্ভবত তাও নয়।

হ্যাঁ, যুক্তরাষ্ট্র ইরানের পারমাণবিক স্থাপনায় হামলা চালিয়েছে। কিন্তু এই হামলা আন্তর্জাতিক আইনের একাধিক মৌলিক নিয়ম লঙ্ঘন করেছে, যার দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব পড়ার আশঙ্কা আছে। তাছাড়া, যুক্তরাষ্ট্র ইসরায়েলের সঙ্গে যুদ্ধের ময়দানে নামেনি—বরং হামলার পরপরই যুক্তরাষ্ট্রের কৌশলগত বোমারু বিমানগুলো দেশে ফিরে গেছে। 

এই হামলার আগে ও পরে ট্রাম্প বারবার বলেছেন, তিনি যুক্তরাষ্ট্র ও ইরানের মধ্যে এমন একটি চুক্তি চান, যাতে ইসরায়েলও অন্তর্ভুক্ত থাকতে পারে। এটা পরিষ্কার, মার্কিন প্রেসিডেন্ট এই সহায়তা করেছেন অনেকটা নিজের স্বার্থ এবং উপসাগরীয় মিত্রদের স্বার্থ রক্ষার জন্য।

বিশ্বের কয়েকজন নেতা—বিশেষ করে জার্মান চ্যান্সেলর ফ্রিডরিখ মার্জ—যুক্তরাষ্ট্রের হামলার পক্ষে এবং 'ইসরায়েলের আত্মরক্ষার অধিকার' সমর্থন করেছেন ঠিকই, তবে ইসরায়েলের কঠোর দাবিগুলো কেউই গ্রহণ করেননি। যেমন—ইরান কোনোভাবেই ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধ করতে পারবে না—এমন দাবি আন্তর্জাতিক মহলে সমর্থন পায়নি।

বরং বিশ্ব আবার ফিরে গেছে সেই পুরোনো অবস্থানে—'ইরান পারমাণবিক অস্ত্র বানাতে পারবে না', যার প্রতি ইরান আগেই সম্মতি জানিয়েছিল।

মধ্যপ্রাচ্যের সাম্প্রতিক কার্যক্রম বিবেচনায় এলে দেখা যায়, বিশ্ব এখন ইরানকে ব্যবসায়িক ও কূটনৈতিক অংশীদার হিসেবে গ্রহণ করার পথে। এটি ইসরায়েলের জন্য একটি বড় ক্ষতি এবং ইরানের জন্য একটি স্পষ্ট বিজয়।

ইসরায়েলের অভ্যন্তরে যে বাস্তব ও গভীর ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে, তা কোনোভাবেই উপেক্ষা করার মতো নয়। সত্য, ইসরায়েল যুদ্ধের শুরুতেই আকাশপথে ইরানের ওপর আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছিল, কিন্তু ইরানের পাল্টা ক্ষেপণাস্ত্র হামলা সেই কৃতিত্বকে দ্রুত ম্লান করে দেয়। ইরানি ক্ষেপণাস্ত্র একের পর এক ইসরায়েলের সুপরিচিত আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ভেদ করে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চলে আঘাত হানে।

ইরানের ক্রমাগত ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় ইসরায়েলের ইন্টারসেপ্টর ক্ষেপণাস্ত্র দ্রুত ফুরিয়ে আসছিল, অথচ তা পুনরায় সরবরাহ করার মতো কোনো তাৎক্ষণিক ব্যবস্থাও ছিল না।

এই হামলায় শুধু ইসরায়েলের জানমালের ক্ষয়ক্ষতি নয়, দেশটির অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডও মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। পুরো দেশ কার্যত স্তবির হয়ে পড়ে। এটি ছিল ইরানের আরেকটি বড় কৌশলগত বিজয়।

অন্যদিকে, যুদ্ধ শেষে ইরান আহত ও ক্ষতিগ্রস্ত হলেও, শত শত প্রাণহানিসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে ব্যাপক বোমাবর্ষণের পরও ইসলামি প্রজাতন্ত্র ভেঙে পড়েনি। বিশাল ইসরায়েলি সামরিক শক্তির মুখোমুখি থেকেও ইরান টিকে আছে।

তাদের ক্ষেপণাস্ত্র লক্ষ্যবস্তুতে সঠিকভাবে আঘাত হেনেছে। আন্তর্জাতিক পরিসরে ইরানের ভাবমূর্তি কলুষিত হয়নি—বরং বেশিরভাগ দেশ এটিকে ইসরায়েলের আগ্রাসনের শিকার বলেই দেখেছে। ফলে ইরানের পাল্টা প্রতিক্রিয়া জানানোর ক্ষমতা ও সুযোগ সীমিত হয়ে পড়েনি। বরং যুক্তরাষ্ট্রের কাতারে অবস্থিত ঘাঁটিতে হামলার জবাব দেওয়ার সময় তারা আগাম সতর্কবার্তা দিয়ে পরিস্থিতি উত্তপ্ত না করে কৌশলগতভাবে নিয়ন্ত্রণে রাখতে পেরেছে।

সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ দিক হলো—যখন যুদ্ধবিরতির শর্ত লঙ্ঘিত হচ্ছে বলে আশঙ্কা দেখা দিয়েছিল, তখন ইরান এতটাই প্রভাব বিস্তার করতে পেরেছিল যে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পকেও ইসরায়েলকে হামলা থেকে বিরত রাখতে আহ্বান জানাতে হয়।

ইরান যেভাবে চায়—তেমনভাবেই যুদ্ধ থেকে বেরিয়ে এসেছে: দাঁড়িয়ে থেকে, শক্ত অবস্থানে থেকে এবং ভবিষ্যতের কৌশল নির্ধারণের যথেষ্ট সুযোগ রেখেই।

কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আল জাজিরায় প্রকাশিত এই মতামতধর্মী নিবন্ধটি লিখেছেন ওরি গোল্ডবার্গ। তিনি ইরান-কেন্দ্রিক রাজনীতি ও মধ্যপ্রাচ্য বিষয়ক গবেষণা ও নিরাপত্তা বিশ্লেষণে বিশেষজ্ঞ। ওরি গোল্ডবার্গ এক সময় বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করেছেন এবং জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন। বর্তমানে তিনি একজন স্বাধীন বিশ্লেষক ও রাজনৈতিক ভাষ্যকার হিসেবে কাজ করছেন।


Somoy Journal is new coming online based newspaper in Bangladesh. It's growing as a most reading and popular Bangladeshi and Bengali website in the world.

উপদেষ্টা সম্পাদক: প্রফেসর সৈয়দ আহসানুল আলম পারভেজ

যোগাযোগ:
এহসান টাওয়ার, লেন-১৬/১৭, পূর্বাচল রোড, উত্তর বাড্ডা, ঢাকা-১২১২, বাংলাদেশ
কর্পোরেট অফিস: ২২৯/ক, প্রগতি সরণি, কুড়িল, ঢাকা-১২২৯
ইমেইল: somoyjournal@gmail.com
নিউজরুম ই-মেইল : sjnewsdesk@gmail.com

কপিরাইট স্বত্ব ২০১৯-২০২৫ সময় জার্নাল