মাহমুদুল হাসান, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়: করোনা মহামারির ফলে থামকে গেছে পুরো বিশ্ব। দিনের পর দিন লকডাউনের ফলে গৃহবন্দী হয়ে পড়েছে মানুষজন। দেড় বছর ধরে বন্ধ রয়েছে দেশের সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। করোনার এই সময়ে অনেক তরুণ পড়াশোনা থেকে ঝড়ে পড়েছে, অনেকে আবার শিক্ষাজীবন নিয়ে হতাশা থেকে আত্মহত্যার মতো পথও বেছে নিচ্ছে। কেউবা আসক্ত হয়ে পড়ছে পাবজি, ফি ফায়ারের মতো গেইম গুলোতে।
ঠিক এমন সময়েই কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী শাহ আলম হয়ে উঠেছেন একজন সফল তরুণ উদ্যোক্তা। তিনি তার অবসর সময়টাকে অযথা নষ্ট না করে বরং কাজে লাগিয়ে নিজে সাবলম্বী হওয়ার স্বপ্ন দেখেন। সেই স্বপ্নকে ধীরে ধীরে বাস্তবে রূপ দিয়ে তিনি আজ লাখপতি। করোনাকালের এই সময়ে তিনি প্রায় ১০ লক্ষ টাকার সেল করতে সক্ষম হয়েছেন!
সম্প্রতি তরুণ এই উদ্যোক্তার সাথে কথা হয়েছে সময় জার্নাল কুবি ক্যাম্পাস প্রতিনিধি মাহমুদুল হাসানের।
আমরা আজ তরুণ উদ্যোক্তার কাছে তার সফলতার গল্প সম্পর্কে জানতে চেষ্টা করবো।
প্রতিবেদক: সংক্ষেপে আপনার পরিচয় দিন।
মুহাম্মদ শাহ আলম: আমি মুহাম্মদ শাহ আলম। বাসা হবিগঞ্জের মাধবপুরে। বর্তমানে আমি কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে পড়াশোনা করছি। পাশাপাশি আমি উদ্যোক্তা হিসেবে বিভিন্ন দেশি পণ্য নিয়ে কাজ করছি। আমার উদ্যোগের নাম 'শিকড়-দেশী পণ্য'।
প্রতিবেদক: হটাৎ করে উদ্যোক্তা হওয়ার চিন্তা কিভাবে আপনার মাথায় এলো?
মুহাম্মদ শাহ আলম: উচ্চ শিক্ষিত হওয়ার পরেও যখন দেখতে পেলাম প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাবিহীন নেতার কাছে সামান্য একটা চাকরির জন্যও ধরনা দিতে হয় এবং দিনরাত পড়াশোনা করেও ভালো চাকরি পাওয়া কঠিন হয়ে পড়ছে ঠিক তখন থেকেই মনের ভিতরে ইচ্ছা জাগল নিজে থেকে কিছু করার। করোনার মহামারীর সময় যখন সবকিছু ছেড়ে দিয়ে বাড়িতে অবসর সময় কাটাচ্ছি তখন আমি আমার পরিবারের আর্থিক অবস্থা ভালভাবে পর্যবেক্ষণ করলাম।
তখন উদ্যোক্তা হিসাবে কাজে নেমে পড়লাম কিন্তু টাকা হাতে তেমন টাকা না থাকায় বিপাকে পড়ে গেলাম। তখন দেখলাম বাসায় কিছু সরিষার দানা আছে। আর সেই সরিষার দানা দিয়েই প্রথম ব্যবসা শুরু করে দেই৷ আলহামদুলিল্লাহ কোন টাকা ইনভেস্ট না করে আজ আমার প্রায় ১০ লক্ষ টাকার সেল হয়েছে।
প্রতিবেদক: উদ্যোগ পরিচালনা করতে কোন কোন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হয়েছে?
মুহাম্মদ শাহ আলম: উদ্যোগ পরিচালনার জন্য আমি অনেক বেশি চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়েছি। অনলাইনে কাজ করার জন্য ইন্টারনেট সবচেয়ে দরকারী উপাদান। কিন্তু গ্রামে থাকার কারণে নেটওয়ার্ক সমস্যার জন্য আমাকে অনেকটা পিছিয়ে থাকতে হয়েছে। কাস্টমারদের সাথে দ্রুত ডিল করা এবং উত্তর দেওয়া সম্ভব হতো না নেটওয়ার্ক সমস্যার জন্য।
গ্রাম থেকে আমার জেলা শহরে গিয়ে কুরিয়ারে পণ্য পাঠানো ছিল অনেক বড় একটি সমস্যা। নিজ গ্রাম থেকে জেলা শহর প্রায় ৫০/৬০ কিলোমিটার দূরে। ফলে কুরিয়ার করাটা আমার জন্য অনেক বড় ঝামেলার কাজ ছিল। তারপর আবার খাঁটি সরিষার তেল এস এ পরিবহন ব্যতীত অন্য কোন কুরিয়ার তা বহন করতো না৷
প্রতিবেদক: আপনার বিজনেস এত দূর আসার পিছনে কার অবদান সবেচেয়ে বেশি?
মুহাম্মদ শাহ আলম: আমার এই ই-কমার্স ব্যবসার ক্ষেত্রে সবচেয়ে উপকৃত হয়েছি উই গ্রুপের মাধ্যমে। এই গ্রুপে রাজিব স্যারের নির্দেশনায় একটু একটু করে বিজনেস সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন করি এবং উই গ্রুপে নিজের পরিচিতি বাড়াতে শুরু করি। তারপর থেকেই উই গ্রুপে আমার সেল শুরু হয়৷ ধীরে ধীরে আজ তা লক্ষ টাকায় পরিণত হয়েছে।
মুহাম্মদ শাহ আলম
প্রতিবেদক: আপনার উদ্যোগ নিয়ে ভবিষ্যত পরিকল্পনা কি?
মুহাম্মদ শাহ আলম: আমার উদ্যোগ নিয়ে ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা হল দেশের কৃষক এবং তাঁতিদের প্রাপ্য সম্মান দিতে একটি ই-কমার্স ইন্ড্রাস্ট্রি গড়ে তুলা। যার মাধ্যমে দেশের যেকোন প্রান্ত থেকে একজন মানুষ সরাসরি কৃষকদের কাছ থেকে কৃষি পণ্য এবং তাঁতিদের কাছ থেকে দেশী কাপড় সহজেই ক্রয় করতে পারে। এতে করে কৃষক এবং তাঁতিরা তাদের প্রাপ্য সম্মান পাবে ইনশাআল্লাহ৷
প্রতিবেদক: দেশি পণ্য নিয়ে কাজ করতে গিয়ে আপনার সবচেয়ে ভালো গল্প কি ছিলো?
মুহাম্মদ শাহ আলম: আমি যখন খাঁটি সরিষার তেল নিয়ে কাজ শুরু করতে যাই তখন গ্রামে গরুর ঘানিতে ভাঙ্গা খাঁটি সরিষার তেল ব্যবহার প্রায় বন্ধ করে দিয়েছে বললেই চলে। এমনকি ঘানিওয়ালা গরুর ঘানিতে ভাঙ্গানো তেল বিক্রি বন্ধ করে দিয়েছে৷ আমি ওনাকে সাহস দিলাম, দুজন মিলে আবার শুরু করে দিলাম। এখন আমরা একটার বদলে দুইটা ঘানি শুরু করেছি।
মানুষ দেশীয় কাপড় পড়ার বদলে বিদেশি কাপড় পড়তে শুরু করায়, দেশীয় তাঁতিরা তাদের কাপড় বিক্রি করতে পারছিল না। তাই অনেক তাঁতি কাপড় বোনা বন্ধ করে দিয়েছিল। এখন তাঁতিরা বলে, বাবা তোমরা যদি অনেক আগে থেকে এই কাজ করতে, তাহলে আমাদের আর এই অবস্থা হত না।
প্রতিবেদক: এত পণ্য থাকতে আপনি দেশি পণ্য নিয়েই কেন কাজ করা শুরু করলেন?
মুহাম্মদ শাহ আলম: খাঁটি সরিষার তেলের উপকারিতা সম্পর্কে সবাই কমবেশি জানি। কিন্তু বাজারে পাওয়া সরিষার তেল ব্যবহার করে সাধারণ মানুষ তেমন কোন উপকার পাচ্ছে না। কেননা বাজারের সরিষার তেলে থাকে ভেজাল মেশানো। তাই চিন্তা করলাম গ্রামে যে সরিষা হয় তা যদি আমি নিজে ভাঙ্গিয়ে মানুষের কাছে খাঁটি সরিষার তেল পৌঁছে দিতে পারি তাহলে ত মানুষ খাঁটি সরিষার তেলটাই পাচ্ছে। এই চিন্তা থেকেই প্রথমে সরিষার তেল নিয়েই কাজ শুরু করি।
আর একদিন সিলেটের মণিপুরী পল্লীতে ঘুরতে গিয়ে একজন তাঁতির দুঃখের কথা শুনেই মণিপুরী শাড়ি নিয়ে কাজ করা শুরু করি৷ পাশাপাশি সিলেটের ঐতিহ্যকে মানুষের সামনে তুলে ধরার চেষ্টা করি।
পড়াশোনার সুবাদে বেশিরভাগ সময় আমাকে কুমিল্লায় থাকতে হয়। তাই কুমিল্লার ঐতিহ্যকে মানুষের সামনে তুলে ধরার জন্য খাদি পাঞ্জাবি এবং খাদি গজ কাপড় নিয়ে কাজ করা শুরু করি।
প্রতিবেদক: আপনার উদ্যোক্তা জার্নির অভিজ্ঞতা থেকে যদি নতুন উদ্যোক্তাদের উদ্দেশ্যে পরামর্শ হিসেবে কিছু বলতেন।
মুহাম্মদ শাহ আলম: আমার উদ্যোক্তা জার্নি থেকে নতুনদের বলতে চাই যদি কেউ উদ্যোক্তা হতে চান তাহলে সে যেন এই বিষয়ে ১০০ দিন পড়াশোনা করে। এছাড়া কার মাঝে যদি তীব্র ইচ্ছা এবং কঠোর পরিশ্রম থাকে তাহলে সে এই তীব্র ইচ্ছা এবং কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমেই অনেক দূর এগিয়ে যেতে পারবে বলে আমি বিশ্বাস করি।
সময় জার্নাল/এমআই