জসীমউদ্দীন ইতি, ঠাকুরগাঁও প্রতিনিধি:
ঠাকুরগাঁওয়ের ইউনিয়ন ভূমি অফিসগুলোতে বহিরাগতদের দৌরাত্ম্য ব্যাপক হারে বেড়েছে। জমিসংক্রান্ত যেকোনো সেবা পেতে গ্রাহকদের শরণাপন্ন হতে হয় তাদের কাছে। অভিযোগ উঠেছে, অফিসের সরকারি কর্মকর্তাদের ছত্রছায়ায় থেকে তারা নিয়ন্ত্রণ করছে অনলাইনের যাবতীয় কাজ, আদায় করছে মোটা অঙ্কের টাকা। ফলে সেবা নিতে গিয়ে একদিকে হয়রানি, অন্যদিকে বারবার ঘুরেও কাঙ্ক্ষিত সেবা পাচ্ছে না সাধারণ মানুষ।
ঠাকুরগাঁও শহরের পৌর-আকচা ইউনিয়ন ভূমি অফিসে প্রবেশ করলে দেখা যায়, ভূমি কর্মকর্তার পাশে বসে প্রদীপ কুমার রায় নামের এক যুবক কম্পিউটারে কাজ করছেন। অফিসে আসা গ্রাহকদের তিনিই ভরসা। নামজারি, খাজনা দেওয়া, রেকর্ড সংশোধন—সব কিছুই তার হাত ঘুরে হচ্ছে। অথচ ওই যুবক অফিসের কোনো কর্মকর্তা বা বেতনভুক্ত কর্মচারী নন। ছয় বছর ধরে এভাবেই নিয়ন্ত্রণ করছেন অফিসের অনলাইনভিত্তিক সেবা। স্থানীয়রা তাকে চেনেন ‘কম্পিউটারম্যান’ নামে। পরিচয় দেন অফিসের স্টাফ বলে। তবে সরকারি বেতনভুক্ত কর্মচারী নন তিনি, নেই কোনো নিয়োগপত্র। তবুও প্রভাব-প্রতিপত্তি এমন যে গ্রাহকরা বাধ্য হয়ে তার দ্বারস্থ হন। অভিযোগ আছে, কর্মকর্তাদের যোগসাজশে তিনি বিভিন্ন ফাইল ম্যানেজ করে থাকেন এবং বিনিময়ে হাতিয়ে নেন মোটা অঙ্কের টাকা।
অনুসন্ধানে জানা যায়, সদর উপজেলার ইউনিয়ন ভূমি অফিসগুলোতেও একই চিত্র। তালিকায় নাম আসছে একের পর এক বহিরাগত নিয়ন্ত্রকের। সদর উপজেলা ভূমি অফিসে নাঈম, তপন, গৌতম, মুক্তারুল, রঞ্জিত ও কার্তিক। সালান্দর-জগন্নাথপুরে সাজু, বড়গাঁও-আউলিয়াপুরে জীবন রায়, বালিয়াতে মাজেদুর রহমান, গড়েয়াতে কৃষ্ণ রায়, মোহাম্মদপুরে মেহেদী হাসান, রায়পুর-জামালপুরে মামুন, রহিমানপুরে লাবু, চিলারংয়ে আজাদ, আখানগরে আব্দুস সোবহান, রাজাগাঁওয়ে আনিসুর রহমান, রুহিয়াতে নুর ইসলাম, বেগুনবাড়িতে উজ্জ্বল এবং দেবীপুরে জীবন। প্রতিটি অফিসে বহিরাগতদের দাপট এমন পর্যায়ে গেছে যে, সাধারণ মানুষ মনে করছেন ভূমি অফিস এখন ব্যক্তিগত ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে।
ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলার সালান্দর ইউনিয়ন বরুনাগাঁওয়ের কৃষক আবদুল খালেক (৫০) জমির নামজারির জন্য এক মাস ধরে চেষ্টা করে যাচ্ছেন। কিন্তু এখনো কাজ হয়নি। তিনি বলেন, ভূমি অফিসে গেলে কর্মকর্তারা সোজাসুজি বলেন, ওই ছেলেদের সঙ্গে কথা বলেন। ওদের টাকা দেন, কাজ হয়ে যাবে। আমি তিনবার টাকা দিয়েছি, তবুও কাজ হয়নি।
একই অভিযোগ আকচা ইউনিয়নের বাসিন্দা ফারুক হোসেনের। তিনি বলেন,ভূমি অফিসে কোনো কাগজপত্র করাতে গেলে কমপক্ষে কয়েক শ থেকে কয়েক হাজার টাকা লাগে। আর সেটা সরাসরি কর্মকর্তাকে না দিয়ে বহিরাগত যারা আছে, তাদের হাত দিয়ে যায়।
বহিরাগতদের নিয়ন্ত্রণ ও তাদের দৌরাত্ম্য নিয়ে কর্মকর্তাদের কাছে জানতে চাইলে এড়িয়ে যান। ইউনিয়ন ভূমি সহকারী কর্মকর্তাদের কেউই স্পষ্টভাবে স্বীকার করতে চাননি। তবে নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক কর্মকর্তা বলেন, অফিসে কাজের চাপ বেশি। আমাদের অনলাইন বিষয়ে তেমন দক্ষতা নেই। এ জন্য বহিরাগতদের সাহায্য নেওয়া হয়। কিন্তু তারা যে সাধারণ মানুষের কাছ থেকে টাকা নিচ্ছে, এটা অস্বীকার করার উপায় নেই।
সরকারি অফিসে বহিরাগতদের এমন দাপট শুধু ভোগান্তিই বাড়াচ্ছে না, ঝুঁকির মুখে ফেলছে দাপ্তরিক গোপনীয়তাও। নাগরিকদের সংবেদনশীল জমিসংক্রান্ত নথি, রেকর্ড, নামজারির তথ্য এখন বহিরাগতদের হাত ঘুরে যাচ্ছে। এ নিয়ে অনেকেই আশঙ্কা করছেন, এতে জমি দখল ও প্রতারণার ঘটনা আরো বাড়বে।
বাংলাদেশ ভূমি অফিসার্স কল্যাণ সমিতি, ঠাকুরগাঁও জেলার সাধারণ সম্পাদক হাসিবুল ইসলাম বলেন,সরকারি অফিসে বহিরাগতদের কোনো ভূমিকা থাকার কথা নয়। কিন্তু দীর্ঘদিন ধরে এরা নিয়ন্ত্রণ করছে। এতে সেবার মান কমছে, হয়রানি বাড়ছে। এ বিষয়ে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি।
ঠাকুরগাঁও জেলা প্রশাসক ইশরাত ফারজানা বলেন, গোপনীয়তা রক্ষার স্বার্থে এবং জনবান্ধব সেবা নিশ্চিত করতে খুব শিগগিরই আমরা কঠোর ব্যবস্থা নেব।
এমআই