জাকারিয়া শেখ, ফুলবাড়ী (কুড়িগ্রাম) প্রতিনিধি:
আমন মৌসুমের ঠিক মধ্যভাগে এসে সার সংকটে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছেন কৃষি নির্ভর কুড়িগ্রামের হাজারো প্রান্তিক কৃষক। মাঠে সোনার ফসলের চারা দাঁড়িয়ে আছে, অথচ সেই চারার প্রাণ—সার—আজ অপ্রতুল। ইউরিয়া,ডিএপি ও এমওপি সারের পর্যাপ্ত সরবরাহ না থাকায় কৃষকের চোখে-মুখে এখন শঙ্কার কালো ছায়া।
কৃষকদের অভিযোগ, সার বিক্রেতা ডিলারের দোকানে গিয়ে খালি হাতে ফিরতে হচ্ছে। কোথাও আবার দিনের পর দিন তালা ঝুলছে গোডাউনে।তারা আরো জানান -প্রশাসনের তদারকির অভাবেই এ সারের কৃত্রিম সংকট তৈরি হয়েছে। ডিলাররা বরাদ্দকৃত সার একদিনেই গোপনে বিলি করে ফেলছে, পরে সেই সার কালোবাজারে চলে যাচ্ছে। অথচ এ বিষয়ে প্রশাসনের কোনো কার্যকর পদক্ষেপ চোখে পড়ে না।কুড়িগ্রাম জেলার বিভিন্ন উপজেলায় সার না পেয়ে ক্ষুব্ধ কৃষকরা অবরোধ, বিক্ষোভ, এমনকি কৃষি কর্মকর্তাদের অবরুদ্ধ করতেও বাধ্য হচ্ছেন।রবিবার (১৪ সেপ্টেম্বর) দুপুরে ভূরুঙ্গামারী উপজেলার সোনাহাট সেতু সংলগ্ন শহীদ মোড় এলাকায় গাছের গুড়ি ফেলে সোনাহাট স্থলবন্দর সড়ক অবরোধ করে তারা এ কর্মসূচি পালন করেন।
এ সময় বিক্ষোভকারীরা ভূরুঙ্গামারী উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তা সারোয়ার তৌহিদকে অবরুদ্ধ করে রাখেন।
ফুলবাড়ী উপজেলার খড়িবাড়ী বাজারে সকাল সাড়ে দশটায় মেসার্স প্রভাত চন্দ্র সাহা ট্রেডার্স ও মেসার্স শুভ ট্রেডার্স-এর গোডাউনে গিয়ে দেখা যায়—দরজায় তালা ঝুলছে। স্থানীয়দের দাবি, কয়েকদিন আগে ডিলাররা সার পেলেও তা সাধারণ কৃষকের হাতে পৌঁছায়নি। রাতারাতি একদিনেই উধাও হয়ে গেছে বাজার থেকে। সেই সার শেষ পর্যন্ত ঠাঁই নিয়েছে কালোবাজারি দালালের গুদামে। ফলে কৃষকরা বাধ্য হচ্ছেন দ্বিগুণ দামে খোলা বাজার থেকে সার কিনতে।
উপজেলার নওদাশ গ্রামের কৃষক আব্দুল মজিদ বলেন, “ইউরিয়া, পটাশ, ডিএপি—কোনো সারই পাওয়া যাচ্ছে না। টিএসপি এখন কেজি ৪০ টাকা, ইউরিয়া ৪০ টাকা। আগে যে দামে পেতাম, এখন তার দ্বিগুণ। জমিতে চারা লাগানো আছে, কিন্তু সার না পেলে সব ধ্বংস হয়ে যাবে।”
ধনীরাম গ্রামের কৃষক নজির হোসেন ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, “এবার বন্যা হয়নি, তাই চরাঞ্চলে আবাদ বেড়েছে। অথচ সার মেলে না। যতটুকু আসে, কালোবাজারিদের হাতে চলে যায়। ধানক্ষেত শুকিয়ে যাচ্ছে, সবজির চারা হলুদ হয়ে মরছে। আমরা কীভাবে বাঁচব?”
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, আগস্টে কুড়িগ্রামে বরাদ্দ এসেছিল ইউরিয়া ৬২৫৩ মেট্রিক টন, সেপ্টেম্বরে তা নেমে আসে মাত্র ৩৮৯৪ টনে। টিএসপি, ডিএপি ও এমওপির ক্ষেত্রেও একই অবস্থা। অথচ জেলার আমন ধানের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১ লাখ ২০ হাজার ৫০০ হেক্টর জমি, আবাদ হয়েছে তার চেয়েও বেশি—১ লাখ ২১ হাজার ৪০০ হেক্টর জমিতে। সবজির ক্ষেত্রেও আবাদ বেড়েছে লক্ষ্যমাত্রার তুলনায়।
চাহিদা বেড়েছে, কিন্তু সেই অনুযায়ী বরাদ্দ বাড়েনি—এমনটাই স্বীকার করছেন স্থানীয় কৃষি কর্মকর্তারা।
জেলায় বর্তমানে বিসিআইসির ৯৪ জন এবং বিএডিসির ১১৬ জন ডিলার আছেন। অথচ অধিকাংশ ডিলারের কোনো দেখা মেলে না। কৃষকদের অভিযোগ—ডিলাররা সার হাতে পেয়েই আত্মগোপন করেন, পরে সেই সার চলে যায় কালোবাজারে।
একজন ক্ষুব্ধ কৃষক আক্ষেপ করে বলেন, “আমরা কষ্টের টাকা দিয়ে জমিতে চারা লাগিয়েছি। কিন্তু সার নেই। অথচ কালোবাজারে গেলেই পাওয়া যায়। তাহলে কারা এই সংকট সৃষ্টি করছে—আমাদের বলার অপেক্ষা রাখে না।”
খড়িবাড়ী বাজারের খুচরা ব্যবসায়ী আতাউর রহমান ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, “ডিলাররা আমাদের খুচরা ব্যবসায়ীদের সার দেয় না। অথচ আমাদের হাতে সার এলে কৃষকরা যতটুকু দরকার ঠিক ততটুকুই কিনে নিতে পারত। তাহলে এভাবে সার সংকট তৈরি হতো না। কিন্তু বাস্তবে কী হচ্ছে—এক মাসের জন্য বরাদ্দকৃত সার একদিনেই বিলি করে ফেলা হয়। তখন সিন্ডিকেটের লোকেরা ভাড়া করা মানুষ দিয়ে সার তুলে নিয়ে যায়। পরে সেই সার বিভিন্ন এলাকায় দ্বিগুণ দামে বিক্রি করা হয়। এতে প্রকৃত কৃষক বঞ্চিত হচ্ছে, আর ফায়দা নিচ্ছে দালাল চক্র।”
কুড়িগ্রাম কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক আবদুল্লাহ আল মামুন অবশ্য দাবি করেন, “বর্তমানে জেলায় কোনো সারের সংকট নেই। প্রতিটি পয়েন্টে কর্মকর্তাদের মাধ্যমে সার বিতরণ করা হচ্ছে। এবারের কম বৃষ্টিপাতের কারণে চরাঞ্চলে আমনের আবাদ বেড়েছে। তাই চাহিদা বেড়েছে। তবে সরকার থেকে নিয়মিত বরাদ্দ আসছে এবং আমরা তা সুষ্ঠুভাবে বিতরণ করছি।”
কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন কথা বলছে। জেলার গ্রাম-গঞ্জে কৃষকরা হতাশ হয়ে ঘুরছেন, অতিরিক্ত দামে সার কিনতে বাধ্য হচ্ছেন। অনেক ক্ষেতেই চারা হলুদ হয়ে শুকিয়ে যাচ্ছে।
কৃষকরা আশঙ্কা করছেন—এই সংকট নিরসন না হলে শুধু আমন নয়, আগাম সবজি চাষও মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। কৃষি অর্থনীতির প্রাণকেন্দ্র কুড়িগ্রামে এ সংকট এখন যেন অশনি সংকেত।
সময়মতো ব্যবস্থা না নিলে, সোনার ফসলের স্বপ্ন ভেঙে গিয়ে কৃষকের ঘরে ভাত নয়—হাহাকার নেমে আসবে।
এমআই