শনিবার, ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৫

কুড়িগ্রাম-২: জাপার ভাটা, জমে উঠছে বিএনপি-জামায়াতের দৌড়ঝাঁপ

শনিবার, সেপ্টেম্বর ২০, ২০২৫
কুড়িগ্রাম-২: জাপার ভাটা, জমে উঠছে বিএনপি-জামায়াতের দৌড়ঝাঁপ

জাকারিয়া শেখ, ফুলবাড়ী(কুড়িগ্রাম)প্রতিনিধি :

আগামী ডিসেম্বরের প্রথমার্ধে তফসিল ঘোষণার প্রস্তুতি নিচ্ছে নির্বাচন কমিশন। ইতোমধ্যেই সারাদেশে নির্বাচনী আমেজ ছড়িয়ে পড়তে শুরু করেছে। উত্তরাঞ্চলের সীমান্তঘেঁষা কুড়িগ্রামও এর ব্যতিক্রম নয়। জেলার চারটি সংসদীয় আসনের মধ্যে সবচেয়ে বেশি আলোচনায় রয়েছে কুড়িগ্রাম-২ (ফুলবাড়ী, রাজাহাট ও কুড়িগ্রাম সদর) আসন।

একটি পৌরসভা ও ২০টি ইউনিয়ন নিয়ে গঠিত এ আসনে মোট ভোটার সংখ্যা ৫ লাখ ৬৭ হাজার ২০২ জন। এর মধ্যে পুরুষ ২ লাখ ৮০ হাজার ৭৩৬ জন, নারী ২ লাখ ৮৬ হাজার ৪৬৩ জন এবং হিজড়া ভোটার রয়েছেন ৩ জন। দীর্ঘ প্রায় চার দশক ধরে জাতীয় পার্টির শক্ত ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত এই আসন সর্বশেষ নির্বাচনে অপ্রত্যাশিত পরাজয়ের মধ্য দিয়ে নতুন রাজনৈতিক সমীকরণে প্রবেশ করেছে।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, জাতীয় পার্টির সাংগঠনিক দুর্বলতা ও জনবিচ্ছিন্নতার সুযোগ কাজে লাগিয়ে বিএনপি ও জামায়াত ইতোমধ্যে মাঠে সক্রিয় হয়ে উঠেছে। 

১৯৮০-এর দশক থেকে জাতীয় পার্টির শক্ত ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত এ আসনে ২০০৯ সালের উপনির্বাচনে একবারের জন্য আওয়ামী লীগ জয় পেলেও তা ধরে রাখতে পারেনি। সর্বশেষ ২০২৪ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের পূর্ণ সমর্থন থাকা সত্ত্বেও সাংগঠনিক দুর্বলতার কারণে জাতীয় পার্টির সাবেক এমপি পনির উদ্দিন আহমেদ বড় ব্যবধানে পরাজিত হন স্বতন্ত্র প্রার্থী ডা. হামিদুল হকের কাছে। স্থানীয় রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, এ ফলাফল স্পষ্ট করেছে যে দীর্ঘদিনের একক আধিপত্য আর অটুট নেই জাতীয় পার্টির।

বড় দল হিসেবে বিএনপি আসনটি পুনরুদ্ধারে সর্বাত্মক প্রস্তুতি নিচ্ছে জেলা বিএনপি। এ ক্ষেত্রে নেতৃত্ব দিচ্ছেন জেলা বিএনপির সদস্য সচিব সোহেল হোসেন কায়কোবাদ। ছাত্র রাজনীতি থেকে উঠে আসা এ নেতা দীর্ঘদিন ধরে দলের রাজনীতিতে সক্রিয় এবং জেলা বিএনপির বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালন করেছেন। আন্দোলন-সংগ্রামে অগ্রণী ভূমিকা ও কর্মীবান্ধব চরিত্রের কারণে তিনি সংগঠনের ভেতরে ইতিমধ্যে প্রভাবশালী অবস্থান তৈরি করেছেন।জেলা আহ্বায়ক কমিটির সদস্য সচিব হিসেবেও তিনি গ্রাম থেকে পাড়া-মহল্লা পর্যন্ত তৃণমূল সংগঠনকে সক্রিয় রাখতে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছেন। 

অন্যদিকে যুগ্ম মহাসচিব ও কুড়িগ্রামের কৃতি সন্তান রুহুল কবির রিজভী রয়েছেন সর্বাধিক আলোচনায়। দীর্ঘদিনের সাংগঠনিক অভিজ্ঞতা, নেতৃত্বগুণ ও জাতীয় পর্যায়ে তাঁর পরিচিতি তাঁকে এ আসনের অন্যতম সম্ভাব্য প্রার্থী হিসেবে এগিয়ে রেখেছে। দলের ভেতরেও অনেকে মনে করছেন— রিজভী মনোনয়ন পেলে তৃণমূল থেকে কেন্দ্র পর্যন্ত সমন্বিতভাবে কাজ করা সম্ভব হবে, যা বিএনপিকে এ আসনে শক্ত অবস্থানে দাঁড় করাতে পারে।

বিএনপি'র  মনোনয়ন প্রত্যাশী হিসেবে মাঠে রয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ছাত্রনেতা অধ্যাপক শফিকুল ইসলাম বেবু। তিনি চর উন্নয়ন কমিটি, মাদকবিরোধী কমিটি ও কুড়িগ্রাম উন্নয়ন বাস্তবায়ন কমিটির মাধ্যমে সংগঠনকে তৃণমূল থেকে শক্তিশালী করার চেষ্টা করছেন। বেবু বলেন, “চরাঞ্চলের উন্নয়ন ও মাদকমুক্ত কুড়িগ্রাম গড়তে আমাদের সুস্পষ্ট পরিকল্পনা রয়েছে।”

অন্যদিকে সাবেক কেন্দ্রীয় ছাত্রদলের সহ-সভাপতি মাহবুব মিয়া কুড়িগ্রাম-২ আসনে তরুণ প্রজন্মের আলোচিত প্রার্থী হিসেবে উঠে এসেছেন। ছাত্ররাজনীতি থেকে উঠে আসা এই নেতা দীর্ঘদিন ঢাকায় সক্রিয় থাকার পর এখন এলাকায় নিয়মিত জনসংযোগ চালাচ্ছেন। শহর থেকে প্রত্যন্ত গ্রাম—সবখানেই তার পদচারণা সাধারণ ভোটারদের নজর কেড়েছে।

বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান ঘোষিত ৩১ দফা কর্মসূচি ঘরে ঘরে পৌঁছে দেওয়া, সদস্য সংগ্রহ অভিযান এবং বিভিন্ন দলীয় কার্যক্রমে নেতৃত্ব দিয়ে তিনি সংগঠনকে গতিশীল করছেন।

উন্নয়নের ভিশনে রয়েছে—দারিদ্র্য দূরীকরণ, কর্মসংস্থান সৃষ্টি, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবার মানোন্নয়ন, নদীভাঙন ও বন্যা মোকাবিলায় কার্যকর উদ্যোগ, কৃষকদের জন্য বিশেষ প্রণোদনা এবং মেধাবী শিক্ষার্থীদের জন্য শিক্ষা বৃত্তি। পাশাপাশি শহরের অবকাঠামো উন্নয়নে স্থায়ী নৈশকোচ স্ট্যান্ড নির্মাণ, অটোরিকশা নিয়ন্ত্রণ, জরাজীর্ণ সড়ক সংস্কার ও জলাবদ্ধতা নিরসনের উদ্যোগ এবং ত্রিমোহনী থেকে শাপলা চত্বর পর্যন্ত চার লেন সড়ক নির্মাণের প্রতিশ্রুতি ভোটারদের মধ্যে আশাবাদ তৈরি করেছে।

স্থানীয় নেতৃবৃন্দ ও রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, তরুণ প্রজন্মের ভরসার প্রতীক মাহবুব মিয়া মনোনয়ন পেলে কুড়িগ্রাম-২ আসনে নতুন দিগন্তের সূচনা ঘটবে।

জামায়াত এবার নতুন কৌশলে মাঠে সক্রিয় হয়েছে। এ আসনে সবচেয়ে আলোচনায় রয়েছেন জেলা আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি ও শ্রমিক কল্যাণ ফেডারেশনের জেলা সভাপতি এডভোকেট ইয়াসিন আলী সরকার। কর্মী সমাবেশের পাশাপাশি চারা বিতরণ, অসুস্থ রোগীদের চিকিৎসায় সহযোগিতা ও জনসংযোগ কার্যক্রমের মাধ্যমে তিনি দ্রুত ভোটারদের আস্থায় জায়গা করে নিচ্ছেন। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, জামায়াতের ঐতিহ্যবাহী ভোট ব্যাংকের সঙ্গে তার ব্যক্তিগত জনপ্রিয়তা যুক্ত হলে কুড়িগ্রাম-২ আসনে তিনি হবেন বড় চ্যালেঞ্জ।

ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশও এ আসনে প্রার্থী দেয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। সম্ভাব্য প্রার্থী হিসেবে আলোচনায় রয়েছেন কুড়িগ্রাম আলিয়া মাদ্রাসার অধ্যক্ষ ও জেলা ইমান সভাপতি নূর বখত মিয়া। ধর্মীয় ও সামাজিক পরিমণ্ডলে সক্রিয় এই নেতা ইসলামপন্থী ভোটারদের একত্রিত করার পাশাপাশি শিক্ষা ও নৈতিক মূল্যবোধভিত্তিক রাজনীতির কথা তুলে ধরছেন। স্থানীয়ভাবে মাদ্রাসাশিক্ষক সমাজ এবং ধর্মভিত্তিক ভোটারদের মধ্যে তার গ্রহণযোগ্যতা বাড়ছে বলে জানা গেছে।

সম্প্রতি আলোচনায় এসেছে নাগরিক পার্টি (এনসিপি)। এ আসনে সম্ভাব্য প্রার্থী হিসেবে মাঠে রয়েছেন ড. আতিক মুজাহিদ। তিনি বিভিন্ন সভা-সমাবেশে কুড়িগ্রামের নানাবিধ সমস্যা তুলে ধরে তার সমাধানের আশ্বাস দিচ্ছেন। তরুণ ভোটারদের কাছে পৌঁছাতে তিনি বিশেষভাবে সক্রিয় এবং প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন— কুড়িগ্রামকে একটি “আত্মমর্যাদাশীল জেলা” হিসেবে গড়ে তোলা হবে। স্থানীয়ভাবে নতুন রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে এনসিপি ভোটের মাঠে ভিন্নমাত্রা যোগ করবে বলে অনেকেই মনে করছেন।

প্রার্থী ও দলের তৎপরতার পাশাপাশি সাধারণ ভোটাররাও এবার পরিবর্তনের আশা করছেন। দীর্ঘদিনের নদীভাঙন, কর্মসংস্থানের অভাব, ব্যবসা-বাণিজ্যে স্থবিরতা ও অবকাঠামোগত সমস্যা তাদের দৈনন্দিন জীবনে বড় প্রভাব ফেলছে।

ফুলবাড়ী উপজেলার ব্যবসায়ী হাবিবুর রহমান বলেন, “আসল উন্নয়ন হয়নি। প্রতিবছর নদীভাঙনে মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। আমরা এমন জনপ্রতিনিধি চাই, যিনি শুধু প্রতিশ্রুতি নয়—বাস্তবে কাজ করবেন।”

রাজাহাটের ব্যবসায়ী আবদুল মালেক যোগ করেন, “বাজার ও সড়ক-সংযোগ উন্নয়ন এখন জরুরি। রাজনীতি নিয়ে অনেক প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়, কিন্তু ব্যবসা-বাণিজ্যের বাস্তব সমস্যা কেউ সমাধান করে না। এবার আমরা চাই কার্যকর জনপ্রতিনিধি।”

রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, কুড়িগ্রাম-২ আসনে এবার মূল প্রতিদ্বন্দ্বিতা হবে জাতীয় পার্টি, বিএনপি ও জামায়াতের মধ্যে। বিএনপি যদি রিজভী বা কায়কোবাদকে প্রার্থী করে, জামায়াত যদি তাদের ঐতিহ্যবাহী ভোট ধরে রাখে এবং জাতীয় পার্টি অতীতের প্রভাব পুনরুদ্ধারের চেষ্টা করে—তাহলে এখানে হবে জমজমাট ত্রিমুখী লড়াই।

সবমিলিয়ে কুড়িগ্রাম-২ আসনের রাজনৈতিক উত্তেজনা এখন তুঙ্গে। ভোটাররা অপেক্ষা করছেন—কে হবেন এ কৌশলগত আসনের আগামী দিনের কাণ্ডারি।

একে 


Somoy Journal is new coming online based newspaper in Bangladesh. It's growing as a most reading and popular Bangladeshi and Bengali website in the world.

উপদেষ্টা সম্পাদক: প্রফেসর সৈয়দ আহসানুল আলম পারভেজ

যোগাযোগ:
এহসান টাওয়ার, লেন-১৬/১৭, পূর্বাচল রোড, উত্তর বাড্ডা, ঢাকা-১২১২, বাংলাদেশ
কর্পোরেট অফিস: ২২৯/ক, প্রগতি সরণি, কুড়িল, ঢাকা-১২২৯
ইমেইল: somoyjournal@gmail.com
নিউজরুম ই-মেইল : sjnewsdesk@gmail.com

কপিরাইট স্বত্ব ২০১৯-২০২৫ সময় জার্নাল