নিজস্ব প্রতিবেদক:
খাগড়াছড়ি জেলা সদর থেকে প্রায় ৪৫ কিলোমিটার দূরে গুইমারার রামেসু বাজার। উপজেলার অন্যতম জনসমাগমের স্থান। এলাকাটির চারপাশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে আগুনের ক্ষত। দোকানপাটের পাশাপাশি আশপাশের অনেক ঘরবাড়ি সহিংসতার আগুনে পুড়ে ছাই। গতকাল সোমবার সকালেও সেখানে কিছু দোকান থেকে ধোঁয়া বের হচ্ছিল। ক্ষতিগ্রস্তদের কেউ কেউ পুড়ে যাওয়া দোকান ও ঘর থেকে ব্যবহারযোগ্য মালপত্র খুঁজে বের করার চেষ্টা করছিলেন। অনেকে নির্বাক দাঁড়িয়ে ছিলেন।
পাহাড়ি কিশোরীকে দলবদ্ধ ধর্ষণের ঘটনার জের ধরে গত রোববার বিক্ষোভ ও সহিংসতার কেন্দ্রে পরিণত হয়েছিল রামেসু এলাকা। গতকালও বাজার ও আশপাশের পরিস্থিতি ছিল থমথমে। সড়কে তেমন লোক চলাচল ছিল না।
খাগড়াছড়ি জেলা সদর এবং গুইমারা উপজেলায় টানা তৃতীয় দিনের মতো বলবৎ ১৪৪ ধারা। গতকাল কোনো সহিংসতার ঘটনা না ঘটলেও জনমনে ছিল উৎকণ্ঠা। সহিংসতার পর সতর্ক পাহারায় আছেন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা। আর অবরোধকারীরা অবস্থান নেন বিভিন্ন সড়কে।
গতকাল সোমবার দুপুর থেকে অবরোধ শিথিল হওয়ায় খাগড়াছড়ি জেলার সঙ্গে ঢাকা ও চট্টগ্রামের পথে যান চলাচল শুরু হয়েছে। তবে জুম্ম ছাত্র-জনতার ডাকা অবরোধের কারণে রাঙামাটির সঙ্গে যান চলাচল এখনও বন্ধ রয়েছে। খাগড়াছড়ির ৯ উপজেলার সঙ্গেও জেলা সদরের সড়ক যোগাযোগ বন্ধ। এসব পথে জরুরি সেবা ছাড়া অন্য কোনো যানবাহন চলাচল করছে না।
খাগড়াছড়িতে উত্তেজনা শুরু হয় গত বুধবার। আগের দিন মঙ্গলবার রাত ৯টার দিকে বাড়ি ফেরার পথে এক স্কুলছাত্রী কিশোরী দলবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হয় বলে অভিযোগ ওঠে। ওই দিন রাত ১১টার দিকে অচেতন অবস্থায় একটি ক্ষেত থেকে তাকে উদ্ধার করে স্বজনেরা। কিশোরীটির বাবা মামলা করার পর এ ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগে সেনাবাহিনীর সহায়তায় একজনকে গ্রেপ্তার করা হয়। তাঁর নাম শয়ন শীল (২১)। তাঁকে ছয় দিনের রিমান্ডের আদেশ দিয়েছেন আদালত। কিশোরী ধর্ষণের ঘটনার প্রতিবাদে জুম্ম ছাত্র-জনতা আন্দোলন শুরু করে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে শনিবার বেলা ২টার পর সদর, পৌর এলাকা ও গুইমারায় ১৪৪ ধারা জারি করে প্রশাসন। এই আন্দোলন এক সময় সহিংস হয়ে ওঠে।
‘চোখে শুধু অন্ধকার দেখছি’
গতকাল রামেসু বাজার এলাকায় পাহাড়ি তরুণী ঊর্মি মারমার সঙ্গে কথা হয়। তিনি বলেন, ‘আমার বাড়ি হাফছাড়ি এলাকায়। এখানে এক আত্মীয়র বাসায় থেকে স্থানীয় একটি প্রতিষ্ঠানে পালি ভাষায় লেখাপড়া করি। রোববার কী থেকে কী হয়ে গেল এখনও বুঝে উঠতে পারছি না। আমার আত্মীয় সাইজাহ্লা মারমা রামেসু বাজারে শাকসবজি বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করেন। কিছু লোক হঠাৎ পাড়ার অন্যান্য ঘরের মতো আমার আত্মীয়র ঘরটিতেও আগুন লাগিয়ে দেয়। চোখের সামনেই পুড়ে গেছে ঘর। কোনো কিছুই ঘর থেকে আমরা বের করতে পারিনি। এক কাপড়ে আছি। চোখে শুধু অন্ধকার দেখছি।’
ঊর্মি বলেন, ‘যারা ঘরে অগ্নিসংযোগ করেছে তাদের অনেকেই মুখোশ পরা ছিল।’
রামেসু বাজারের অর্ধশতাধিক দোকান পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। বাজারের এক পাশে একটি তিনতলা ভবন। এই ভবনে রয়েছে সরকারি-বেসরকারি ১৫টি প্রতিষ্ঠান। ভবনটিতে রোববার আগুন লাগিয়ে দেওয়ার পাশাপাশি ব্যাপক ভাঙচুর ও লুটপাট চালানো হয়েছে।
তিনতলা ভবনে থাকা যুব উন্নয়ন অধিদপ্তর, সমাজসেবা কার্যালয়, পার্বত্য উন্নয়ন বোর্ডের প্রকল্প পরিচালকের কার্যালয়, মহিলাবিষয়ক কার্যালয়, তথ্য আপা কার্যালয়, খাদ্য নিয়ন্ত্রকের কার্যালয়, সূর্যের হাসি ক্লিনিক, এনআরডিএসের অফিসও পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।
ওই ভবনের একটি ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের মালিক শিবু ঘোষ সমকালকে বলেন, ‘কারা এই কাজ করেছে, সেটা সবাই জানে। তাই আমি তাদের নাম বলতে চাই না। তবে এটি বলতে পারি, তারা পরিকল্পিতভাবে নগদ টাকাসহ লুটপাট চালানোর পাশাপাশি ভবনে অগ্নিসংযোগ করেছে। এতে ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোর অন্তত ১২ কোটি টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে।’
নাম প্রকাশ না করার অনুরোধ জানিয়ে রামেসু বাজারের একাধিক ব্যবসায়ী জানিয়েছেন, দুই পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষের মধ্যে কিছু লোক হঠাৎ এসে দোকানপাটে লুটপাট চালিয়েছে। এরপর একে একে দোকানগুলো পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।
বাজারে যেসব দোকানে আগুন দেওয়া হয় তার অধিকাংশের মালিক পাহাড়ি। কিছু প্রতিষ্ঠান বাঙালির। স্থানীয় বাসিন্দাদের তথ্যমতে, আগুনে মোটরসাইকেল পুড়েছে অন্তত ১৮টি। মানুষের ঘরবাড়িতে থাকা গরু-ছাগলও লুট করা হয়েছে।
গুইমারা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. এনামুল হক চৌধুরী বলেন, সোমবার সকাল থেকে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য সেনাবাহিনী, বিজিবি, পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর টহল রয়েছে। পরিস্থিতি এখন নিয়ন্ত্রণে রয়েছে।
তিনজনের পরিচয় শনাক্ত
রোববার গুলিতে নিহত তিনজনের পরিচয় পাওয়া গেছে। তারা সবাই গুইমারা উপজেলার বাসিন্দা। নিহত ব্যক্তিরা হলেন– উপজেলার সিন্দুকছড়ি ইউনিয়নের দেবলছড়ি চেয়ারম্যানপাড়ার আথুই মারমা (২১), হাফছড়ি ইউনিয়নের সাং চেং গুলিপাড়ার আথ্রাউ মারমা (২২) ও রামেসু বাজার বটতলার তৈইচিং মারমা (২০)।
খাগড়াছড়ির সিভিল সার্জন মোহাম্মদ সাবের বলেন, বিকেল সাড়ে ৪টার দিকে নিহত তিনজনের ময়নাতদন্ত শেষ হয়। এরপর আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও স্বজনদের উপস্থিতিতে মরদেহ হস্তান্তর করা হয়।
৮ দফা নিয়ে প্রশাসনের সঙ্গে বৈঠক
খাগড়াছড়ির পরিস্থিতি শান্ত করতে প্রশাসন গতকাল বৈঠক করেছে। খাগড়াছড়িতে অনুষ্ঠিত বৈঠকে পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক উপদেষ্টা সুপ্রদীপ চাকমা উপস্থিত ছিলেন। এ ছাড়া জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান, জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপার, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ও গোয়েন্দা কর্মকর্তারা ছিলেন। জুম্ম ছাত্র-জনতার ছয়জন প্রতিনিধিও এতে অংশ নেন।
খাগড়াছড়ির জেলা প্রশাসক এ বি এম ইফতেখারুল ইসলাম সমকালকে বলেন, পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে আমরা কাজ করছি। আশা করি দ্রুত পরিবেশ পুরোপুরি শান্ত হয়ে আসবে।
খাগড়াছড়ির পুলিশ সুপার আরেফিন জুয়েল সমকালকে বলেন, বৈঠকে অবরোধকারীরা তাদের ৮ দফা দাবির বিষয় তুলেছেন। বৈঠক ফলপ্রসূ হয়েছে। দ্রুত অবরোধ প্রত্যাহার করবে বলে আশা করছি।
পরে রাতে জুম্ম ছাত্র-জনতার পক্ষ থেকে বিবৃতিতে বলা হয়, প্রশাসন ১৪৪ ধারা প্রত্যাহার ছাড়া সব দাবি মানার কথা জানিয়েছে। হয়রানি ও গ্রেপ্তার বন্ধের আশ্বাস দিয়েছে। তবে অবরোধ প্রত্যাহার না হওয়া পর্যন্ত ১৪৪ ধারা বহাল রাখার কথা বলেছে।
বিবৃতিতে তারা আরও বলেছে, জুম্ম ছাত্র-জনতা কোনো রাজনৈতিক দল নয়, বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠীও নয়। আমাদের স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলনকে ‘ইউপিডিএফ’ বা অন্য কোনো ট্যাগ দিয়ে দমন করা যাবে না। জুম্ম কিশোরীকে ধর্ষণের ন্যায়বিচারের দাবিতে যে আন্দোলন হয়েছে, তা প্রত্যেক নাগরিকের ন্যায্য অধিকার।
দাবিগুলো দ্রুত, পূর্ণ ও সন্তোষজনকভাবে বাস্তবায়িত না হওয়া পর্যন্ত তিন পার্বত্য জেলায় সড়ক অবরোধ অনির্দিষ্টকালের চালিয়ে যাওয়ার কথা বলেছে তারা। পর্যটনসহ সংশ্লিষ্ট সব কার্যক্রম সাময়িক স্থগিত রাখার কথা জানায়।
ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্টও (ইউপিডিএফ) বিবৃতি দিয়েছে। খাগড়াছড়ি ও গুইমারায় পাহাড়িদের ওপর সংঘটিত সাম্প্রদায়িক হামলা তদন্তের জন্য জাতিসংঘের অংশগ্রহণে একটি উচ্চপর্যায়ের বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিটি গঠনসহ আট দফা দাবি জানিয়েছে তারা।
ভারত বা ফ্যাসিস্টদের ইন্ধনে অস্থিরতা
স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বলেছেন, ‘একটি মহল খাগড়াছড়িতে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরির চেষ্টা করছে। ভারত বা ফ্যাসিস্টদের ইন্ধনে এই ঘটনা ঘটছে। আমরা সর্বোচ্চ সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নিয়েছি। এখন পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আছে।’
গতকাল রাজধানীর পুরাতন রমনা থানা চত্বরে আদাবর, কদমতলী, ভাসানটেক, রমনা ও রামপুরা থানার ভবন নির্মাণের ভিত্তিফলক উন্মোচন অনুষ্ঠান শেষে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে এসব কথা বলেন তিনি। উপদেষ্টা বলেন, ‘কিছু সন্ত্রাসী পাহাড়ের ওপর থেকে গুলি চালাচ্ছে। এসব অস্ত্র অনেক সময় দেশের বাইরে থেকে আসে।’
‘ভুয়া ধর্ষণ’ বলার পর হান্নান মাসউদের দুঃখ প্রকাশ
পাহাড়ি কিশোরীকে দলবদ্ধ ধর্ষণের অভিযোগের ঘটনাকে ‘ভুয়া ধর্ষণ’ উল্লেখ করে বক্তব্য দিয়েছেন জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মুখ্য সমন্বয়ক আবদুল হান্নান মাসউদ। রোববার সন্ধ্যায় নোয়াখালীর হাতিয়ায় ‘ঐক্য ও সংহতির সমাবেশে’ তিনি বলেন, ‘শেষ ট্রাম্পকার্ড খেলছে ভারত, একটি ভুয়া ধর্ষণের ঘটনার মাধ্যমে পাহাড়ি ও বাঙালিদের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে অঞ্চলটিকে অস্থিতিশীল করে তোলার চেষ্টা চলছে।’
এদিকে খাগড়াছড়িতে ধর্ষণের অভিযোগ, পরবর্তী বিক্ষোভ-সহিংসতা ও তিনজন গুলিতে নিহত হওয়ার ঘটনায় এনসিপির বিরুদ্ধে নীরবতার অভিযোগ তুলে সোমবার সকালে পদত্যাগ করেছেন দলের কেন্দ্রীয় কমিটিতে ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর একমাত্র প্রতিনিধি অলিক মৃ। পদত্যাগের কারণ হিসেবে তিনি হান্নান মাসউদের ‘ভুয়া ধর্ষণ’ শব্দচয়নকে মিথ্যাচার উল্লেখ করে এর প্রতিবাদ জানানোর কথাও বলেছেন। পরে গতকাল দুপুরে হান্নান মাসউদ ফেসবুক পোস্টে জানান, এই অনাকাঙ্ক্ষিত শব্দ (ভুয়া ধর্ষণ) ব্যবহার করার জন্য তিনি ‘বিব্রত ও দুঃখিত’।
রাঙামাটির পরিস্থিতি
তিন পার্বত্য জেলায় অনির্দিষ্টকালের জন্য সড়ক অবরোধে কর্মসূচি ডাকা হলেও সোমবার রাঙামাটিতে অবরোধের প্রভাব পড়েনি। সব ধরনের যানবাহন চলাচল করছে। তবে রাঙামাটি-খাগড়াছড়ি এবং রাঙামাটি-মারিশ্যা গাড়ি চলাচল বন্ধ রয়েছে।
একে