নিজস্ব প্রতিবেদক:
ডেমোক্রেটিক ও রিপাবলিকান পার্টির আইনপ্রণেতারা গুরুত্বপূর্ণ একটি অর্থবরাদ্দ বিল নিয়ে সমঝোতায় পৌঁছাতে ব্যর্থ হওয়ায় যুক্তরাষ্ট্রে কেন্দ্রীয় সরকারের কার্যক্রম বন্ধ বা 'শাটডাউন' শুরু হয়েছে। আজ বুধবার থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে এই অচলাবস্থা কার্যকর হয়।
এর ফলে আবশ্যক নয় এমন কিছু সরকারি পরিষেবা সাময়িকভাবে বন্ধ হয়ে যাবে এবং লাখ লাখ সরকারি কর্মীর বেতন আটকে যাবে। তবে অতীতের শাটডাউনের চেয়ে এবার পরিস্থিতি আরও জটিল। কারণ, ট্রাম্প প্রশাসন কর্মীদের সাময়িক ছুটিতে (ফার্লো) পাঠানোর পরিবর্তে স্থায়ীভাবে ছাঁটাইয়ের নজিরবিহীন হুমকি দিয়েছে। অতীতে শাটডাউনের সময় কর্মীদের ছুটিতে পাঠানো হলেও পরে তারা বকেয়া বেতনসহ চাকরিতে পুনর্বহাল হতেন।
কেন এই শাটডাউন?
যুক্তরাষ্ট্রে নতুন অর্থবছর ১ অক্টোবর থেকে শুরু হলেও কংগ্রেস এখন পর্যন্ত প্রয়োজনীয় স্বল্পমেয়াদি তহবিল বিল অনুমোদন করতে পারেনি। রিপাবলিকানরা কংগ্রেসের উভয় কক্ষ নিয়ন্ত্রণ করলেও বিল পাসের জন্য প্রয়োজনীয় ৬০ ভোট সিনেটে জোগাড় করতে পারেনি। সিনেটে রিপাবলিকানদের আসন ৫৩ এবং ডেমোক্র্যাটদের ৪৭। অন্যদিকে, প্রতিনিধি পরিষদে রিপাবলিকানদের ২২০ আসনের বিপরীতে ডেমোক্র্যাটদের আছে ২১২টি আসন।
রিপাবলিকানদের প্রস্তাবিত বিলে ২১ নভেম্বর পর্যন্ত সরকারি কার্যক্রম পরিচালনার জন্য অর্থ বরাদ্দের কথা বলা হয়েছে। কিন্তু স্বাস্থ্যসেবা খাতে বরাদ্দ নিয়ে মতবিরোধের কারণে ডেমোক্র্যাটরা এই বিলের বিরোধিতা করছে।
বিরোধের মূলে স্বাস্থ্যসেবা
লন্ডনের ওয়েস্টমিনস্টার বিশ্ববিদ্যালয়ের যুক্তরাষ্ট্র সরকার ও রাজনীতি বিষয়ের এমেরিটাস অধ্যাপক জন ওয়েনসের মতে, এই অচলাবস্থার মূল কারণ হলো 'অ্যাফোর্ডেবল কেয়ার অ্যাক্ট' বা 'ওবামাকেয়ার'-এর জন্য অর্থায়ন অব্যাহত রাখা। নিম্ন আয়ের মানুষদের স্বাস্থ্যসেবা দেওয়ার এই আইনটি ভোটারদের কাছে বেশ জনপ্রিয়।
ডেমোক্র্যাটদের দাবি, ট্রাম্পের অধীনে গত জুলাই মাসে পাস হওয়া একটি বিলের মাধ্যমে মেডিকেড (সরকারি স্বাস্থ্যসেবা) খাতে যে বরাদ্দ কমানো হয়েছে, তা পুনর্বহাল করতে হবে। এর পাশাপাশি, স্বাস্থ্যবিমার খরচ কমাতে বিশেষ ট্যাক্স ক্রেডিটের মেয়াদ বাড়ানোর দাবিও জানিয়েছে তারা, যা চলতি বছরের শেষে শেষ হয়ে যাবে।
সিনেটে ডেমোক্র্যাটরা ৭ থেকে ১০ দিনের একটি স্বল্পমেয়াদী তহবিল বিলের প্রস্তাব দিলেও রিপাবলিকানরা তা প্রত্যাখ্যান করেছে। কোনো পক্ষই ছাড় দেওয়ার লক্ষণ দেখাচ্ছে না। চলতি সপ্তাহের শুরুতে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ডেমোক্র্যাট নেতাদের দাবিকে 'অযৌক্তিক' আখ্যা দিয়ে তাদের সঙ্গে আলোচনা বাতিল করেন।
রাজনৈতিক দোষারোপ ও 'ডিপফেক' ভিডিও
সোমবার কংগ্রেস নেতাদের সঙ্গে ট্রাম্পের বৈঠক কোনো সমাধান ছাড়াই শেষ হয়। ডেমোক্র্যাট নেতা চাক শুমার এবং হাকিম জেফ্রিস এই অচলাবস্থার জন্য রিপাবলিকানদের দায়ী করেছেন।
বৈঠকের কয়েক ঘণ্টা পর ট্রাম্প তার 'ট্রুথ সোশ্যাল' প্ল্যাটফর্মে শুমার এবং জেফ্রিসের একটি এআই-জেনারেটেড 'ডিপফেক' ভিডিও প্রকাশ করেন, যেখানে বিকৃত অডিও জুড়ে দেওয়া হয়। ভিডিওতে জেফ্রিসকে মেক্সিকান টুপি ও গোঁফ পরা অবস্থায় দেখা যায় এবং শুমারকে বলতে শোনা যায়, 'আমরা যদি সব অবৈধ অভিবাসীকে স্বাস্থ্যসেবা দিই, তাহলে হয়তো তারা আমাদের পক্ষে ভোট দেবে।'
ডেমোক্র্যাটরা এই ভিডিওকে মেক্সিকানদের বিরুদ্ধে 'বর্ণবাদী উসকানি' হিসেবে নিন্দা জানিয়েছে। জেফ্রিস বলেন, 'এটি একটি জঘন্য ভিডিও। ধর্মান্ধতা দিয়ে কোনো লাভ হবে না। আমরা আমেরিকান জনগণের স্বাস্থ্যসেবা রক্ষার জন্য লড়াই করছি।'
অচলাবস্থা নিরসনের সম্ভাবনা কতটা?
অধ্যাপক ওয়েনস মনে করেন, স্বাস্থ্যসেবা তহবিল নিয়ে এই মতবিরোধ সহজে মিটবে না। তার মতে, সিনেটে কোনো সমঝোতা হলেও তা প্রতিনিধি পরিষদে অনুমোদন পাওয়া কঠিন হবে, যেখানে ট্রাম্পের কট্টর অনুসারীরা সংখ্যাগরিষ্ঠ।
আগামী নভেম্বরে মধ্যবর্তী নির্বাচন থাকায় রিপাবলিকান সিনেটরদের ওপর চাপ রয়েছে। ট্রাম্প নিজেও এই অচলাবস্থা নিরসনের বিষয়ে আশাবাদী নন। সিবিএস নিউজকে তিনি বলেন, 'আমি জানি না আমরা কীভাবে এই সমস্যার সমাধান করব।'
ক্রিপ্টো-ভিত্তিক পূর্বাভাস বাজার 'পলিমার্কেট'-এ মঙ্গলবার সরকার শাটডাউনের সম্ভাবনা ৮৬ শতাংশ বলে উল্লেখ করা হয়।
'শাটডাউন' কী এবং এতে কী ঘটে?
তহবিলের অভাবে যখন সরকারের অপরিহার্য নয় এমন সংস্থাগুলোর কার্যক্রম বন্ধ করে দিতে হয়, তখন তাকে সরকারি শাটডাউন বলা হয়। যুক্তরাষ্ট্রের আইন অনুযায়ী, এ সময় সংস্থাগুলোকে তাদের অপরিহার্য নয় এমন কর্মীদের 'ফার্লো' বা ছুটিতে পাঠাতে হয়। ২০১৯ সালের আইন অনুসারে, অচলাবস্থা শেষে তারা বকেয়া বেতন পেয়ে থাকেন।
তবে জীবন ও সম্পত্তি রক্ষার মতো কাজে নিয়োজিত 'অপরিহার্য কর্মীরা' কাজ চালিয়ে গেলেও অচলাবস্থা শেষ না হওয়া পর্যন্ত বেতন পান না। এবারের অচলাবস্থায় প্রায় ৯ লাখ ফেডারেল কর্মী কর্মহীন হয়ে পড়তে পারেন বলে মনে করেন অধ্যাপক ওয়েনস।
তবে সশস্ত্র বাহিনী, এফবিআই, সিআইএ এবং এয়ার ট্র্যাফিক কন্ট্রোলাররা কাজ চালিয়ে যাবেন। সোশ্যাল সিকিউরিটি এবং মেডিকেয়ারের মতো বাধ্যতামূলক খরচের খাতগুলো ও মার্কিন ডাক পরিষেবা, যা করের টাকায় চলে না, সেটিও চালু থাকবে।
অতীতের অচলাবস্থা
এর আগেও যুক্তরাষ্ট্রে সরকার অচল হওয়ার ঘটনা ঘটেছে। ট্রাম্পের প্রথম মেয়াদে ২০১৮-১৯ সালে যুক্তরাষ্ট্র-মেক্সিকো সীমান্তে প্রাচীর নির্মাণের অর্থ বরাদ্দ নিয়ে মতবিরোধের জেরে ৩৫ দিনের আংশিক শাটডাউন হয়েছিল, যা যুক্তরাষ্ট্রের আধুনিক ইতিহাসে দীর্ঘতম।
এর আগে বারাক ওবামার সময়ে ২০১৩ সালে 'ওবামাকেয়ার' নিয়ে বিতর্কের জেরে ১৬ দিনের জন্য সরকার অচল হয়েছিল। এ ছাড়া বিল ক্লিনটন, রোনাল্ড রিগ্যান ও জিমি কার্টারের সময়েও একাধিকবার শাটডাউনের ঘটনা ঘটেছে।
এবারের অচলাবস্থা আগেরগুলোর চেয়ে কঠোর হতে পারে। হোয়াইট হাউসের 'অফিস অব ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড বাজেট' (ওএমবি) ২৪ সেপ্টেম্বর একটি মেমো জারি করে সরকারি সংস্থাগুলোকে বড় আকারের কর্মী ছাঁটাইয়ের জন্য প্রস্তুত থাকতে বলেছে। এই নির্দেশনা অনুযায়ী, কর্মীদের স্থায়ীভাবে বরখাস্ত করা হবে এবং সরকার চালু হলেও তারা চাকরিতে ফিরতে পারবেন না।
কংগ্রেসের ডেমোক্র্যাট নেতারা এই পদক্ষেপের তীব্র নিন্দা জানিয়েছেন। চাক শুমার এটিকে 'ভয় দেখানোর চেষ্টা' বলেও অভিহিত করেন।
অন্যান্য খাতে সম্ভাব্য প্রভাব
'স্ন্যাপ' এবং 'উইক' কর্মসূচির অধীনে তহবিল থাকা সাপেক্ষে খাদ্য সহায়তা চালু থাকবে। এয়ার ট্র্যাফিক কন্ট্রোলার ও ট্রান্সপোর্টেশন সিকিউরিটি অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (টিএসএ)-এর বেশিরভাগ কর্মী বেতন ছাড়াই কাজ চালিয়ে যাবেন।
ক্ষুদ্র ব্যবসা প্রশাসন নতুন ঋণ অনুমোদন বন্ধ রাখবে, তবে দুর্যোগ পুনরুদ্ধারের জন্য ঋণ চালু থাকবে। অন্যদিকে ফেডারেল ইমার্জেন্সি ম্যানেজমেন্ট এজেন্সি (ফেমা)-র দুর্যোগ ত্রাণ তহবিলে অর্থ থাকলেও সংস্থার প্রায় ৪ হাজার কর্মীকে ছুটিতে পাঠানো হবে।
এমআই